লোকভাষার ব্যবহারঃ বর্তমান কিশোরগঞ্জ অঞ্চল সুদূর অতীতে হাজরাদি পরগণাধীন আসাম-কামরুপ রাজ্যভুক্ত ছিল। আসাম- কামরুপের শাসনাধীন এই এলাকা স্থানীয় কোচ-হাজোং সামন্ত শাসকদের কর্তৃক শাসিত হত। তাদের শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনে এবং নৃ-গোষ্ঠীর বসত, চলাচল ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এই এলাকায় কোচ, হাজোং জনগোষ্ঠীর সাথে পার্শ্ববর্তী ভাওয়াল গড়াঞ্চলের মান্দি, হদি, রাজবংশী প্রভৃতি আদি জনগোষ্ঠীর ভাষার নিবিড় মিশ্রন ঘটে। এর সাথে সংযোজন ঘটে এতদএলাকায় বিভিন্ন সময় আগত মুসলিম ধর্মপ্রচারক, ব্যবসায়ীদের ভাষা। পরবর্তীকালে মুসলিম সুলতানী শাসনের প্রয়োজনে আরবি, মুঘল শাসনে রাজভাষার ভাষার ফারসি এবং সব শেষে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনের প্রভাবে ইংরেজীর ব্যবহারে এই এলাকার ভাষাকে নানা মাত্রা দেয়। যে কারনে এইসব ভাষারুপের সাথে স্থানীয় লোকজ ভাষার মিথষ্ক্রিয়ায় কিশোরগঞ্জের একটি নিজস্ব আদল নির্মিত হয়েছে।

এই জেলার ভাষায় পূর্ববর্তী সুনামগঞ্জ-হবিগঞ্জের কতিপয় শব্দরুপ, দক্ষিনে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, নরসিংদী-গাজীপুরের অনেক শব্দ  ও ধবনিতাত্ত্বিক প্রতিরুপ বা আংশিক বিবর্তিত রুপ লক্ষ করা যায়।

সারা দেশসের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অতি স্বল্প সংখ্যক নগর কেন্দ্রিক জীবন যাপন করে। আর সে অল্প সংখ্যকের কিয়দংশ আদর্শ চলিত নামের সমন্বিত বাংলা ভাষা (যা কার্যত কৃত্রিম) ব্যবহার করে থাকেন এবং একে প্রমিত বাংলার তক্‌মা এটেঁ এর একচেটিয়া আভিজাত্য জাহিরের প্রয়াস চলে। এই মানসিকতাজাত মন্তব্য-ফসলই  গ্রামীণ ভাষাকে ‘উপভাষা’র সংকীর্ণ অভিধান। সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে থাকেন, সে ভাষাকে আসল ভাষা না বলে ‘উপভাষা’র তাচ্ছিল্য প্রকাশ কতটা সুবিবেচনা প্রসূত, তা ভাবতে পন্ডিত মহলের প্রতি অনুরোধ রইল। আপাতত এই বিতর্কে না গিয়ে বিশাল প্রাকৃতজ জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষাকে আমরা ‘লোকভাষা’ বলে সন্মান জানাতে চাই।

ভাষা ব্যবহারে সামান্যকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই জেলার সর্বত্র যেমন সর্বাধিক সামঞ্জস্যশীলতা রয়েছে, তেমনি দু-একটা সম্পূর্ন অন্যরকম কৃত্রিম উদ্ভাবিত ভাষাও রয়েছে। জেলার কোন  কোন  থানাঞ্চলের ক্ষুদ্র কোণ পাড়া কেন্দ্রিক  ‘ছিকঅ ছিকঅ ছি’আ’… টাইপের দুর্বোধ্যপ্রায় মেয়েলি ভাষা যেমন আছে, তেমনি আছে অষ্টগ্রামের ‘ছুহুম’ নামের লোকভাষা।

অষ্টগ্রামের ছুহুম ভাষাঃ

জাতীয় প্রমিত ও আঞ্চলিক কথ্যভাষার পরিচয় পার্থক্যে শুধু নয়, কিশোরগঞ্জে আঞ্চলিকেরও ক্ষুদ্রায়তন আঞ্চলিক ভাষা আছে । যেমন অষ্টগ্রাম থানার ক্ষুদ্রতর এলাকা বিশেষে এক প্রকার কৃত্রিম মিশেল ভাষা আছে, যা ছুহুম ভাষা নামে পরিচিত। একে সুকুন বা সুহ্ম ভাষাও বলা হয়। জানা যায় দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীকালে (সম্ভবত বিশ শতকের ইংরেজ শাসনামলেও খানিকটা সম্প্রসারিত) সংস্কৃত আরবি, ফারসি এমনকি ইংরেজীর সংমিশ্রনে এই সঙ্কর ভাষা গড়ে উঠে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, অষ্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ট এলাকাসহ গোটা কিশোরগঞ্জ জেলার অন্যত্র এ ভাষার প্রচলন নেই। এর সামান্য কিছু উদাহরণ-

‘দুইন্যাডার মাইজে দিত অইবার সংগেই সাইরার ফিদর নেছ অইয়া গেল। দুসরার খানি এস্তাইয়া জিন্দেগী করলাম’।

এর প্রমিত বাংলা রুপঃ জন্ম হওয়ার সাথে সাথে বাবা মারা গেলেন। অন্যের জমিতে কাজ করে জীবন কাটাই।

ছুহুম ভাষার কতিপয় শব্দ বিশ্লেষনঃ দস্তানী’ (পিটুনী) ফারসি ‘দস্ত’ বা হাতের ব্যবহারকে নির্দেশ করে। নেশ জবাই বা প্রস্তান সম্ভবত নাশ বা শেষ অথবা সমাপ্তি- এর ভাবগত অর্থে প্রযুক্ত। উঠান থেকে টুহিয়ে (কুড়িয়ে) কুড়ানোর কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক শব্দ টুহানি। বলা (পুলিশ) বল প্রয়োগকারী বা আইনের শক্তি প্রয়োগকারী হিসেবে ভাবগত অর্থের প্রয়োগ হয়ে থাকে। ‘রোস্‌নাই’ সুর্য বা আলো বা দিন অর্থে ব্যবহার করা হয়। মাদাইন্যা- মধ্যাহ্ন এই সংস্কৃত শব্দের স্থানিয় রুপ ব্যবহার করা হয়।

‘খাহি দস্তায়ে মানে হাত চালিয়ে ব্যবহারিক অর্থে কাজ সেরে অর্থ বুঝায়। বদনে আবি মানে গোসল সারা। এখানে বদন আরবি শব্দ, যার অর্থ শরীর আর আবি ফারসি আব (যার অর্থ- পানি) শব্দে ই প্রত্যয় যুক্ত করে উচ্চারণ করা হয়।

ফিদর মানে পিতা যা ইংরেজি Father এর আংশিক বিকৃত রুপে ব্যবহার হয়ে থাকে। গজাগিরি ধোঁকাবাজি বা প্রতারণা। তরিক কইর‍্যা মানে কৌশল করে বা চালাকির পথ অবলম্বন করে ব্যবহার হয়ে থাকে।  চলবে ।।

সুত্রঃ কিশোরগঞ্জের লোকজ প্রথা ও লোকভাষা # মোঃ রফিকুল আখন্দ