সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের জীবনাচার আর আবেগের সম্পূর্ণ কথকতা; স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাঙ্ময় কলধবনি এবং মৌন প্রার্থনার বহিঃপ্রকাশ। আর স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার যা কিছু প্রাকৃতিক, যা কিছুতে মাটি ও মানুষের স্বতঃস্ফুর্ততা-তার সাথেই আছে লোকসংস্কৃতির উৎসের ঠিকানা। বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতির স্বরুপ সন্ধান করতে চাইলে এ জনপদের ঐতিহ্যমন্ডিত উৎসের দিকে তাকানো প্রয়োজন । সংস্কৃতির অনুষঙ্গগুলি শনাক্তকরনের জন্য বিমূর্ত ও মূর্ত দু’ধারার সংস্কৃতিকে পৃথকভাবে  উপস্থাপনকেই যৌত্তিক বিবেচনা করছি।

সংস্কৃতির ভাবগত শাখা অনুসন্ধানঃ

লোকসংস্কৃতির বস্তুগত শাখাটিকে সনাক্তকরণ কিছুটা সহজকরন হলেও বিমূর্ত শাখাটিকে সনাক্তকরণ এবং সংক্ষিপ্ত পরিসরে জনসমক্ষে তা উপস্থাপন মোটেই সহজ নয় বরং জটিল ও দুরুহ। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখবো ব্রক্ষপুত্রের পূর্বপারের মানুষের কথা বলা এবং পশ্চিমপারের মানুষের কথা বলায় স্বরাঘাত (Extent) এক নয়, এমনকি পাশাপাশি দুটি উপজেলার মানুষের কথা বলার ক্ষেত্রে স্বরাঘাত ও প্রক্ষেপণে বিস্তর ফারাক। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল, জামালপুর-কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুরের ফারাকের প্রসঙ্গটি যথাস্থানে বলাই বাহুল্য। আবার বিমূর্ত শাখার লোকসংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গের প্রচুর মিলও অঞ্চল ভেদে লক্ষনীয়। উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি টাঙ্গাইলের কালিহাতি অঞ্চলের দু’টি লোক ছড়ার কথা-

১) ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি
মোদের বাড়ি যাইও
আমাদের চেংরাডারে
ঘুম দিয়া যাইও।

২) আড়ি আড়ি আড়ি
কাল যাব বাড়ি
পরশু যাব ঘর
কি করবি কর
মাথা কুটে মর।

একই বিষয় ও বক্তব্যের দু’টি ছড়া ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা অঞ্চলে প্রচলিত আছে সামান্য পরিবর্তিত রুপে-

১) ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি
মোদের বাড়ি যাইও খাট নাই পালং নাই
খোকার চোখে বইও।

২) হাড়ি হাড়ি হাড়ি
কাল যাবো বাড়ি
পরশু যাব ঘর
হনুমানের লেঙ্গুর ধইরা
টানাটানি কর।

অথবা- জামালপুর অঞ্চলের প্রবাদ –প্রবচন হিসেবে প্রচলিত-

 ‘সাধতে জামাই কাঠাঁল খায়না,পাগারে গিয়া কৈতি চাটে’

ময়মনসিংহ অঞ্চলে-
‘সাধতে জামাই খায়না,পাগারে পইরা ভূত্তা চাডে’ প্রচলিত আছে।

কিংবা টাঙ্গাইল অঞ্চলের হেয়ালী-

 আড্ডি বেইচ্যা মুণ্ডু খাই
চামড়া বেইচ্যা পয়সা পাই।

ময়মনসিংহ অঞ্চলে-

হাড্ডি পুড়ি পাতা খাই
চামড়া বেইচ্যা পয়সা পাই।

অথবা টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আংগারিয়া গ্রামে মোঃ কিতাব আলী বয়াতীর গাওয়া ঘাটু গান-

কে দিল পীরিতের বেড়া
লিচু কামলার বাগানে
ও লিচু কমলার বাগানে গো, লিচু কমলার বাগানে(২)।

হাইরে মনে যদি ইচ্ছা করি
বেড়া ভাইঙ্গা যাইতে পারি

কমলার বাগানে…।।

কমলার বাগানেতে যাইয়া গো কমলা খাব দু’জনে
কে দিল পিরিতের বেড়া…।।

একই গান ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার আইড়াদির ঘাটু শিল্পীরা গায়-

কে দিল পিরিতের বেড়া, লেচুর বাগানে  (এ অংশ ঘাটু গাইবে)
লেচুর বাগানে সই গো লেচুর বাগানে।

(এ অংশ দল গাইবে)

ছোট ছোট লেচু’গুলি বঁধু তুলে আমি তুলি
বঁধু দেয় আমার মুখে, আমি দেই বঁধুর মুখে।

(ঘাটু গাইবে )

লেচুর বাগানে সইগো…।।

লোককাহিণী নির্ভর কিস্‌সাপালার ক্ষেত্রে লক্ষ করলে দেখা যায় একই কাহিনীর কিস্‌সাপালা অঞ্চলভেদে বয়াতী ভেদেবেশ কিছুটা পরিবর্তন। এমনই ফারাকের উদাহরন অসংখ্য। এসব ছোট খাটো পার্থক্য চিহ্নিত করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রচলিত লোকছড়া,প্রবাদ-প্রবচন, পথকবিতা, বাউল- ভাটিয়ালী, জারি-সারি, মেয়েলী বিয়ের গীত, হাইট্টারা গীত, কিস্‌সা- পালা, ইত্যাদির বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়ে মোটামুটি ভাবে জনপদের বিভিন্ন আঙ্গিকের লোকসংস্কৃতির বিমূর্ত শাখাটীকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো। জেলা ধরে নয় বরং বিষয় ধরে। তবে সবার আগে ভাষা।

চলবে …

সুত্রঃ
বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান,
ফরিদ আহমদ দুলাল