মানুষ কোন না কোন সংস্কৃতিতে জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে। আমরা মূলত সাংস্কৃতিক বলয়ের বাইরের কেউ নই। সেদিক থেকে বলা যায়- আমরা যা তাই হচ্ছে সংস্কৃতি। বায়ু সমুদ্রে ডুবেও আমরা যেমন ভুলে যাই বায়ুর অস্তিত্বের কথা তেমনি সাংস্কৃতিক বলয়ে বেড়ে উঠেও আমরা ভুলে যাই আমাদের সংস্কৃতির কথা। সংস্কৃতি একটি পরিশ্রুত জীবনচেতনা। ব্যক্তিচিত্তেই এর উদ্ভভ ও বিকাশ। এ কখনো সামগ্রিক বা সমবায় সৃষ্টি হতে পারে না। এ জন্য দেশে কালে এর প্রসার আছে কিন্তু বিকাশ নেই। অর্থাৎ এ জাতীয় কিংবা দেশীয় সম্পদ হতে পারে কিন্তু ফসল হবে ব্যক্তিমনের। কেননা সংস্কৃতি ও কাব্য চিত্র বৈজ্ঞানিক অবিক্রিয়ার মতো স্রষ্টার সৃষ্টি। কৃতিত্ব স্রষ্টার বা উদ্ভাবকের। তা অনুকৃত বা অনুশীলিত হয়ে দেশে পরিব্যপ্ত ও জাতে সংক্রমিত হতে পারে এবং হয়ও। সমগ্র জাতির চিন্তাধারা ভাবধারা ও কর্মধারার গৌরব ও সমুন্নতি তিল তিল সফল করে সৃষ্টি হয় সংস্কৃতির ধারা। সমগ্র জাতির চিন্তাধারা ভাবধারা ও কর্মধারার গৌরবময় প্রতিচ্ছবিই হল তার সংস্কৃতি।
মানবীয় আচার পদ্ধতি শিক্ষা দীক্ষা মানসিক উন্নতি পারিপাশ্বিকতার প্রভাব এসবের ধারা সমন্বয়ে সৃষ্ট এক অপূর্ব জীবনধারাই হচ্ছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মূল কথা হল নিজেকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে গড়ে তোলা এবং অপরের নিকট নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। জন্মের সময় আমরা একটি জীব হয়ে জন্মাই। কিন্তু সংস্কৃতিই আমাদের মানুষে পরিণত করে। পরিণত করে সামাজিক জীবে। সংস্কৃতি দিয়েই মানুষ মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণার, মন-মানসিকতার অধিকারী হয়। বিদগ্ধ রুচির সুশীল মানুষে পরিণত হয়। ইংরেজী ‘Culture’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল সংস্কৃতি। ইংরেজি ‘Culture’ শব্দটি ল্যাটনি শব্দ ‘Colere’ থেকে এসেছে। ‘Colere’ শব্দের অর্থ হল কর্ষণ করা। সর্বপ্রথম ইংরেজি সাহিত্যে ‘Culture’ শব্দটি ব্যবহার করেন ফ্রান্সিস বেকন। তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেন ষোল শতকের শেষার্ধে।
এ যাবৎ সংস্কৃতির সর্বজন গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা কেউ প্রদান করতে পারেনি। সংস্কৃতির ধারণা খুবই ব্যাপক। কাজেই এক কথায় এর কোন সংজ্ঞা দেওয়া চলে না। তারপরও সংস্কৃতির বহুল আলোচিত একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ই. বি টেইলর। তিনি বলেছেন, “ জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার-বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবোধ, আইন-কানুন এবং অনুশীলন ও অভ্যাস যেসব মানুষ কোন এক সমাজের পরিবেশে আয়ত্ব করে সেসবের সমষ্টিই হল সংস্কৃতি। ” সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা, প্রকৃতি সংসারও মানব সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা, কাব্য পাঠের মারফতে ফুলের ফোটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা, আকাশের নীলিমায় তৃণগুল্মের শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে মহরতের জীবনদানে বাঁচা, প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা, বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা। সংস্কৃতি আমাদের জীবন চেতনা।
গভীর অর্থে সংস্কৃতি হচ্ছে পরিশীলিত জীবনবোধ। শিক্ষা ও সভ্যতার আলোকতীর্থে স্নাত হয়ে এ জীবনবোধ জন্ম নিয়ে থাকে। সংস্কৃতির মধ্যে যেমন আছে তার সামগ্রিকতার সমানাধিকার তেমনি আছে তার কৃতিত্বময়তার দিক। যে জাতি জীবিত আছে সে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলেছে একটি জীবন্ত সংস্কৃতির বহমান ধারা। সংস্কৃতি জাতীয় প্রাণময়তার সামগ্রিক অভিব্যক্তি। মানুষ তার কথায়-বার্তায়, চলনে-বলনে, পোশাকে-পরিচ্ছদে, খেলা-ধুলায়, আমোদ-প্রমোদে, প্রতি মুহূর্তে তার বিচিত্র সংস্কৃতির ধারা রচনা করে চলেছে। রক্ষা করে চলেছে সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবহমানতা। যে জাতির সংস্কৃতির রূপান্তর বা ক্রমবিবর্তন নেই তার সংস্কৃতি মৃত, সে জাতিও মৃত। কারণ সংস্কৃতির মধ্যেই ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হয় সমগ্র জাতির প্রানের স্পন্দন।
অপসংস্কৃতি কী এবার আসা যাক সে প্রসঙ্গে। সংস্কৃতির বিপরীত হল অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি জাতির এক মানসিক ব্যাধি। এ অসুন্দরেরই ছদ্মবেশ। এর স্পর্শে মানুষের মন কলুষিত হয়। পরিশীলিত, মার্জিত ও উন্নতবোধের হয় অপমৃত্যু। অপসংস্কৃতি অসুন্দরের জন্ম দেয়। চিন্তায় কর্মে ও আচরণে জীবনের অসুন্দর ও অশোভন অভিব্যক্তিই হল অপসংস্কৃতি। বিদেশি সংস্কৃতিকে আমরা একবাক্যে অপসংস্কৃতি বলে অবিহিত করে থাকি। আসলে কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। বিদেশের সবকিছুই আমাদের জন্য অপসংস্কৃতি তা নয়। তবে বিদেশের কোন কিছুকে গ্রহণ করার আগে দেখতে হবে তা আমাদের জীবনকে সুন্দর ও উন্নত করছে কিনা। যা আমাদের জীবনকে পরিশীলিত করে তা অপসংস্কৃতি নয়। কিন্তু আমরা যদি ডিসকো গান, নাচ পাশ্চাত্য মডেলের পোশাকের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি তাহলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই অপসংস্কৃতি হবে।
ভাষাও সংস্কৃতির অংশ। ভাষার ক্ষেত্রে যেমন মিথস্ক্রিয়া হয় তেমনি আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অবলীলায় ঘটে মিথস্ক্রিয়া। নদীর জল সমুদ্রে মিশার ফলে যেমন তা আর সহজে আলাদা করা যায় না, তেমনি অন্য দেশের সংস্কৃতিও । তবে কথা থাকে যে, তা সত্যিকার অর্থেই গ্রহণযোগ্য কিনা এবং তা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মানানসই কিনা কিংবা আমাদের সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ কিনা।
বাংলার সংস্কৃতির মূলে রয়েছে চমকপ্রদতা। মৌলিক সংস্কৃতি মানেই সৃজনধর্মী। এজন্য সংস্কৃতি কখনো পুরনো হতে পারে না। বাংলার সংস্কৃতির উদ্ভবের মূলে রয়েছে তার অফুরন্ত প্রাণ-প্রাচুর্য্য এবং তার প্রকৃতির অবারিত দাক্ষিণ্য। আমরা বাঙালিরা সংস্কৃতিবান হয়েছি, এগিয়ে চলেছি সৃজন করে নয়, গ্রহণ করেই। আমাদের ধর্ম এসেছে উত্তর ভারত ও আরব থেকে। ভাষাটাও উত্তর ভারতের। প্রশাসনিক ঐতিহ্যও উত্তর ভারত, উত্তর এশিয়া ও ইউরোপ থেকে পাওয়া। আজকের ব্যবহারিক জীবনের সব উপকরণ এবং মানস জীবনের সব প্রেরণা এসেছে ইউরোপ থেকে। আর্য, শক, হুন্দল, পাঠান, মোঘল, ইংরেজ – বাঙালি কাউকেই দূরে সরিয়ে রাখেনি। সে সবাইকে গ্রহণ করেছে। সকলের সংস্কৃতি তিল তিল সোনা সংগ্রহ করে সে রচনা করেছে অনবদ্য তিলোত্তমা মূর্ত-বাংলা বা বাঙালি সংস্কৃতি। এখানেই বাঙালি সংস্কৃতির অনন্যতা।
এদেশীয় সংস্কৃতির পরিচয়ের প্রারম্ভেই বলতে হয় যে- প্রকৃতির বিচিত্র মহিমাই বাংলার সংস্কৃতিকে বিশিষ্ট মর্যাদায় ভূষিত করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির মূলে আছে এক সুগভীর ধর্মবোধ, ধর্মপ্রাণতা। পারস্পরিক বিরোধে নয়, সমন্বয়ের বিশ্বাসেই গড়ে উঠেছে এক সুবিশাল সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির অমলিন স্বাক্ষর তার পট, অঙ্কনে, গৃহনির্মাণের পদ্ধতিতে, মৃৎশিল্পে, অলংকার শিল্পের নিপুণ কারুকার্যে, চাল-চিত্রের রঙ রেখায়, আল্পনায়, গৃহসজ্জায়। বাহারি কারিগরের মতো আট-চালা নির্মাণের নৈপুণ্য আর কারো নেই। বাংলার মেয়েদের আঁকা নকশীকাঁথা আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এছাড়া হাড়ি, কলসি, বাসন ও বস্ত্রের সূক্ষ্ম শিল্পকর্মে, স্বর্ণকারের জড়োয়া শিল্পে, শাঁখারীর শঙ্খ শিল্পকর্মে, শীতল পাটি, যাদুর মোড়া ও আসন তৈরিতে বাঙালি সংস্কৃতির রয়েছে স্মরণীয় স্বাক্ষর!। তার ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গও সংস্কৃতির অন্যান্য স্বাক্ষর। বাঙালি সংস্কৃতিই বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার হাতিয়ার। সমগ্র বাংলার বিস্তৃত পরিসর জুড়ে রয়েছে এর বসবাস। নিঃশ্বাসের বায়ু যেমন আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রাখে, তার অস্তিত্ব অনুভব করি অথচ তাকে দেখতে পাইন, সংস্কৃতিও তেমনি।
সময়ের ঘূর্ণাবর্তে বর্তমান তরুণ সমাজেও দেখা দিয়েছে অপসংস্কৃতির ব্যাপক কুপ্রভাব। আজকের তরুণরাই দেশের আগামী দিনের অমূল্য সম্পদ। তারাই দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য অপসংস্কৃতি তাদের জীবনকে ধ্বংশের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তরুণরা এমন কিছু বিষয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে যা জীবনকে সুন্দর করে বিকাশের ক্ষেত্রে মোটেও সহায়ক নয়। বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের দেশে যে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে তার মূলে রয়েছে দুর্নীতি। যে সমাজে দুর্নীতি রয়েছে সে সমাজ থেকে নিজস্ব সংস্কৃতি আশা করা যায় না। তাই অপসংস্কৃতি এখন সংস্কৃতির আসন দখল করে নিয়েছে। ফলে সত্য ও সুন্দর বিসর্জন দিয়ে তরুণরা উগ্র জীবনবোধে মাতাল হয়ে ওঠেছে। বর্তমানে টেলিভিশন ও প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় যেসব ছবি দেখানো হচ্ছে তার অধিকাংশ আমাদের সমাজ ও মন-মানসিকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অশ্লীল ছবির মাত্রা আমাদের জীবনের সাথে এতই সম্পর্কিত হয়ে উঠেছে যে, অচিরেই এর একটা ভয়ংকর পরিণতি শুরু হয়ে যাবে।
ভারতীয় সিরিয়াল প্রীতি আমাদের দেশের নারীদের নিত্যনৈমেত্তিক সিলেবাস হয়ে ওঠেছে। ফলে একদিকে যেমন তারা দেশীয় নাটক, নাটিকা, ডকুমেন্টারি, টেলিসিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি বঞ্চিত হচ্ছে দেশীয় দেশীয় চলচিত্র এ নাটকের প্রকৃত মাহত্ম্য থেকে। এটা বলা বাহুল্য যে, ভারতীয় সিরিয়াল অনেকটা মাদকের মতোই আমাদের নারীদেরকে গ্রাস করে ফেলেছে। তারা প্রয়োজনে মারা যাবে তবুও সিরিয়াল চলাকালে অন্যকে রিমোট দিবে না! বিষয়টি তুচ্ছ এবং হাস্যকর মনে হলেও প্রকৃত অর্থে তুচ্ছ নয়। এসব সিরিয়াল নিয়মিত দেখে একদিকে যেমন তারা বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তেমনি আয়ত্ব করে ফেলছে তাদের প্রাত্যহিক রুচিবোধ। এর ফলে প্রায়ই দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন পরিবারগুলোতে। অবম্য এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতাগুলোও কম দায়ী নয়। ভারতীয় কোন চ্যানেলে বাংলাদেশী চ্যানেল নিষিদ্ধ থাকলেও বাংলাদেশে ভারতীয় কোন চ্যানেল নিষিদ্ধ নয়। এতে করে আমাদের অতিরিক্ত ভারতপ্রীতিই প্রকাশ পায়! অন্যদিকে বাংলাদেশের নাট্য নির্মাতা ও চলচিত্র নির্মাতাদের সৃষ্টিশীল কর্মের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারছে না এদেশের সর্বস্তরের সচেতন দর্শক। ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক বিপর্যয় আবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেছে।
আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবও আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এজন্য দরকার প্রকৃত অর্থে দেশের প্রতি দরদ; সেই সাথে নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সন্তুষ্ট হওয়া। নিজের সংস্কৃতিকে তুচ্ছ করার অর্থ হল প্রকারান্তরে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা।
অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের তালিকায় ফেসবুক টুইটারের ভূমিকাও কম নয়। গ্লোবালাইজেশনের ফলে সমস্ত দুনিয়াই এখন ছোট হয়ে আসছে। একেবারেই যেন হাতের মুঠোয়! ফলে মুহূর্তেই আমরা খবর পাচ্ছি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের। সেই সাথে আমরা অবলোকন করতে পারছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, পোশাকপরিচ্ছদ সহ নিত্য নৈমেত্তিক জীবন যাবনের স্টাইল। আমাদের পারিবারিক বা সামাজিক আদর্শিক অভাবের কারণেই কিংবা আমাদের সংস্কৃতির প্রতি দরদ কম থাকার কারণেই আজ অনেক তরুণ-তরুণীরাই আকৃষ্ট হচ্ছে তাদের নিত্যনৈমেত্তিক লাইফ স্টাইলের প্রতি। মনে রাখতে হবে আন্দদায়ক হলেও সবকিছু গ্রহণযোগ্য নয়। তেল আর জল যেমন মিশ খায় না, তেমনি অপসংস্কৃতিও।
এ তো গেল একদিক। অন্যদিকের কথা বলি। আজকাল অনেক তরুণকে মেয়েদের মতো হাতে বালা বা পিতলের কড়া এবং কানে দুল পরতে দেখা যায়. দেখা যায় মেয়েদের মতো লম্বাচুল রেখে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখতে। এসব ফ্যাশন করে তাদের মনে আনন্দ জাগে, তবু এটা অপসংস্কৃতিরই নামান্তর। আবার মেয়েদেরেকেও অনেক সময় ছেলেদের মতো শার্ট, টাইট জিন্স প্যান্ট, চুলের বয়কার্ট, চলাফেরায় ছেলেদের মতো আচার-আচরণ লক্ষ্য করা যায়, এর কোনটাই কিন্তু সুখকর নয়। এদেশের সঙ্গীতেও অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যে কারণে আমরা দেখতে পাই দেশীয় লালনগীতি, পল্লিগীতি, নজরুলগীতির স্থান আজ দখল করে নিচ্ছে পশ্চিমা ঢংয়ের সঙ্গীত। যেখানে বাজনার ভিড়ে গান হারিয়ে যায়। আমাদের তরুণ সমাজ অপসংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে শৃঙ্খলহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয় পড়ছে।
বিশেষ করে যে তরুণ সমাজ দেশ ও জাতির অফুরন্ত প্রাণশক্তি তার কর্মপ্রেরণা, তার অগ্রগতি- সেই তরুণ সমাজের এক গরিষ্ঠ অংশই আজ অপসংস্কৃতি কবলিত। এর দুর্নিবার নেশায় আজ তরুণ সমাজের এক গরিষ্ঠ অংশ ছুটে চলছে অনিশ্চয়তার পানে। তলিয়ে যাচ্ছে নানা রকম নেশার সামগ্রীর মধ্যে। অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে নানাবিধ মাদকাশ্রয়ী ওষুদ ও সুরাপানে। সাহিত্যের নামে, অশ্লীল ও কুরুচিকর বইয়ের সয়লাবের কারণে তরুণ সমাজ সে দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তরুণ সমাজ তথা যুব সমাজের এই অপসংস্কৃতি প্রিয়তা সুস্থ সমাজ বিকাশে বিরাট অন্তরায়।
সময় এসেছে স্থির হয়ে ভেবে দেখার। তরুণ সমাজের তারুণ্য ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয় আর শুদ্ধি অভিযান। বর্তমান দুদকের দুর্নীতি বিরোধী রালীর মতো আর কি! চারাগাছের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য যেমন উপযুক্ত মাটি ও জলবায়ু প্রয়োজন তেমনি আমাদের তরুণদের বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। সুন্দর সুষ্ঠু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবেশ তরুণদের প্রজ্ঞাকে করতে পারে আরও শানিত। যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুব সমাজের এই বিপথগামীতা- সেই পরিবেশের আমূল সংস্কার অপরিহার্য। শুধু পরিকল্পনা করেই কিছু করা যায় না, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তরিক হওয়া উচিত সর্বাগ্রে। সমাজ থেকে অপসংস্কৃতি দূর করতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রথমে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
এটা খুবই স্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে যেমন শিক্ষিত শ্রেণির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তেমনি রয়েছে সমাজের সকল সচেতন লোকের। সমাজে আনতে হবে নবজাগরণ। অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আজ যারা আটকে গিয়ে অলস তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, কিংবা অসচেতনতার কারণে বিপথগামী- একটু সঠিক পথ নির্দেশনা পেলে তারা পুনরায় পাবে দুর্মর প্রাণশক্তি। অবশ্য অপংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে তরুণসমাজকে রক্ষার জন্য সরকারও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সময়ের দাবিতে-তা আরও জোরদার হওয়া উচিত।
মুনশি আলিম
প্রভাষক (বাংলা বিভাগ), ইছামতি ডিগ্রি কলেজ ও
সাহিত্য সম্পাদক এক্সপ্রেসটাইমস২৪.কম
সার্বিক যোগাযোগ: ০১৭৪১৪৩৬৮৫১