হারামজাদা এইখানে দোকান বসাইতে তরে কিডা কইছে? মাফলারওয়ালা জিগাইলো লোকমানকে!
-খালি জায়গা পাইছি তাই বইসা পড়ছি! লোকমান ভয়ে ভয়ে বলে।
-ঠিক আছে বিকেলে যাওনের সময় ৩০ টেকা দিয়ে যাস? রোগা পটকা মাফ্লার আবার কইলো।
-আপনি কেডা? আপনারে টেকা দিমু কেন? লোকমান চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
লোকমান লোকটাকে দেখলো। রোগা-পটকা একটা মানুষ। চোখের নীচে কালি জমে আছে আর চোখে সাদা কেতর। এক থাপ্পড় দিলে আরেক থাপ্পড় দেওনের জায়গা নাই।
লোকমান কইলোঃ এক টেকাও দিমুনা!
-তর বাপের জায়গা?
-খানকির পুলা আমার বাপ তুইল্লা কথা কইলি কেন?
দিলো সজোরে ধাক্কা। পাশের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলো পটকা রোগা। এক পা দুই পা করে এগিয়ে গিয়ে একটা ইট হাতে দাঁড়ালো। রোগা পটকা আবছা অন্ধকারে চুরি চালানোর চেষ্টা করলো। লোকমান বসিয়ে দিলো আধা ইট পটকার মাথায়। ওমাআআআআআআআআআআআআআ আর কোনো শব্দ নেই………………………নীথর চারদিক!
ভ্যাভাচ্যাকা খেয়ে লোকমান দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যে হয়-হয়। মানুষজনের চলাফেরা এই রাস্তায় এম্নিতে অনেক কম। এতোক্ষনে খেয়াল করলো পটকা রোগার পিছনে আরো একজন ছিলো। লোকমান আধো অন্ধকারে তার দিকে তাকাতেই দিলো দৌঁড়। লোকমান নিজের ক্ষুদে দোকানের বাক্স গোঁছাতে লেগে গেলো। মাত্র কয়েক প্যাকেট সিগারেট-দেশলাই আর দুই বয়াম চকলেট দিয়ে সাজানো দোকান। এখুন কি বিপদ। রোগা পটকা নড়া চড়া করছেনা। মইরে গেলো না তো! লোকমান ভাবতে থাকে-মরলেই কি! এখন কেটে পড়তে পারলেই বাঁচে।
না সেদিন লোকমান কেটে পড়তে পারেনি। একটু পরেই চার-পাঁচজন এসে ধরলো। আর রোগা পটকার চোখে একটু পানির ঝাপ্টা দিতেই পটকা উঠে দাঁড়ালো। কপালে হাল্কা রক্তের দাগ। বার বার তেড়ে আস্তেছে লোকমানের দিকে।
-তোরে আইজকা আমি খাইছি বান্দির পুত। তুই আমারে চিনস? আমি এই এলাকার…………তোরে আমি খুন কইরা ফেলবাম! দলের মধ্যে একজন ছিলো একটু দেখতে ভদ্র মোটা সোটা। সে কইলোঃ লতিইফফা লাফা-লাফি কম কর। বস কইছে ধইরা নিয়া যাইতে। যা করার বস করবে। বেশী উলটা পালটা করলে চটকনা খাবি বান্দিরপুত। লতিইফফা নামের রোগা পটকাও পিছনে পিছনে চলছে। একটু গিয়েই তারা ছেড়ে দিলো লোকমানকে। লোকমানের তাগড়া শরীর দেইখা তারাও একটু সমীহ করছে। গলির পর গলি পার হয়ে বস্তির মাঝা মাঝি একটা টিনশেড পাকা বাড়ীর সামনে দাঁড়ায় পাঁচ ছয়জনের দল! মোটা সোটা ভিতরে ঢুকে। একটু পরে বের হয়ে লোকমানকে হাত ইশারা করে ভিতরে যেতে বলে।
-লতিইফফা তুইও যা।
একটা দশ ফিট বাই দশ ফিট ঘরের মেঝেতে একজন বসে আছে। ছোকরা মতো। বয়স লোকমানের কাছা-কাছি কিংবা দুই এক বছরের বড় হবে। হাতে ধরা একটা সিগারেট। ধোঁয়া খুব শান্ত ভঙ্গীতে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। লোকমানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রোগা পটকাকে জিজ্ঞেস করলোঃ
-কি হইছে লতিইফফা?
-টেকা দিতে কইছি ডেইলী তিরিশ টেকা-দেয় নাই! মার খাওয়ার কথা চেপে যাচ্ছে লতিইফফা।
-তোরে নাকি মাইর দিছে? কইয়াই হা হা করে হাসি।
-মারলা কেন? এবার লোকমানের দিকে তাকায়।
-আমার বাপরে গালি দিলো ক্যান? লোকমানের মাথা তখনো গরম হয়ে আছে।
-তোমার বাপরে গালি দিছে? তোমার বাপ কিডা? কি করে?
-আমার বাপজান মইরা গেছে আমারে দুই বছরের রাইখ্যা। লোকমান বলতে থাকে!
-তো? ছোকরা আবার জিগায়!
-আমার মরা বাপরে গালি দিবো ক্যান?
-তোমারে গলিতে দোকান দিতে কেডা কইছে?
-কেউ কয় নাই-আমার গেরামে ছুডু একটা দোকান আছিলো-বিকালে বাজারের এক কোনায় বিড়ি-সিগ্রেট বেচতাম; ঢাকায় আইছি গাঁও-গেরামে কাম নাই তাই। তাকি রাস্তার উল্টাদিকের রিক্সাওয়ালা মেসে-আমাগো গাঁয়ের এক ছাওয়ালের লগে। গার্মেন্টসের চাকরী করুম; চাকরী পাওন পর্যন্ত এই কাজ বেচা কিনার কাম করতে চাইছিলাম। লোকমান এই নিঃশ্বাসে বলে উঠে।
-গার্মেন্টসে চাকরী কে দিবো?
-আমার এক মামাতো ভাই আছে।
-আমাদের এখানে কাম করবা? ছোকড়া জিগাইলো।
ছোকরার কথায় কেমুন জানি ভরসা পেলো লোকমান। বুকের ভেতর অভিমান জেগে উঠছে। ছোকরাকে বড় আপন মনে হচ্ছিলো।
-এরা আমার দোকানডা আনতেও দিলোনা; লুট হয়ে গেলো কিনা কে জানে?
-কতো টেকার মাল ছিলো দোকানে? চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ছোকরা।
-প্রায় তিনশ টেকার বিড়ি-সিগ্রেট।
-এই নেও আমার সাথে কাম করবা-পারবানা? কি নাম তোমার?
-আমার নাম লোকমান।
লোকমান হাত বাড়িয়ে নিলো। অনেক টেকা। চারটা ফ্যাকাসে পাঁচশ টাকার নোট। দুই হাজার টাকা। লোকমানের বুকের ধ্বক করে উঠে। এতো টেকা।
লোকমান আর ফিরে নাই। সেই ছোকড়া গুরু তারে টানতে টানতে আসমানের কাছে নিয়া গেছে। গঞ্জে দোকান দেওয়ার শখ উবে গেছে। শুধু টেকা আসে-রক্ত উঠে আসে হাতে-অনেক মানুষের ঘৃনা বুকে বিঁধে-শরীরি খেলা ধমনীতে ঢেউ খেলে যায়; জুয়া খেলা-সিনেমা দেখা-তাড়ি খাইয়া মাতলামি-নাভীর নীচে তাকাইয়া দুনিয়া দেখা সব হইছে। গেরামে টিনের ছালের ঘর হইছে-জমিন হইছে-ছোট ভাই মেম্বার হইছে-বইনদের বিয়া হইছে। লোকমান আগের মতোই আছে। টেকা কামায় আর উড়ায়!
-শুনেন আপনেরা ব্যবসা-বানিজ্য করবেন হিল্লী-দিল্লী ঘুরবেন আর আমরা হুদাই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরুম? মোবাইলে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে লোকমান।
-কি করতে হবে আমার কাছে কি চাও?
-আমি লোকমান- আমার কিছু পোলাপাইন জেলে আছে; কিছু টেকা পয়সা যে দিতে হয়!
-লোকমান নামে কাউরে তো আমি চিনিনা।
-চিনবেন যখন আপনার থুক্কু আপনেনা আপনার ম্যানেজারের ভুড়ি নামাইয়া দিমু-তখন বুঝবেন আমি কিডা কিংবা লোকমান কিডা?
-কতো চাও তুমি?
-মাত্র পাঁচ লাখ। বিনিময়ে আপনার উপকার করুম স্যার। কেউ আপনার ফ্যাক্টরীর দিকে তাকাইলে চউক্ষু হাতে ধরাইয়া দিয়াম।
-না দুই লাখ পাইবা!
-ঠিক আছে স্যার দুই লাখ সই! লোকমান ২ লাখ টেকার কথা শুনে নরম হয়ে যায়। স্যার সম্ভোধন চলে আসে!
-তোমার লোক পাঠাইয়া দিও অফিসে সকালবেলায়-টাকা নিয়ে যাইতে বলবা। ফোন কেটে দেয় লোকটা।
মজা পায় লোকমান! টাকা চাইলেই টেকা দিয়ে দেয়। হা হা হা হা করে হাস্তে থাকে। গ্লাসে তলানিতে থাকা তাড়ি গলায় চালান কইরা সিগারেট ধরিয়ে দেয় টান। দামি সিগারেটে! কালকে দুই লাখ টেকা পাইলে কিছু টেকা গ্যাটিসদেরকে আর নিজে কিছু জামা কাপড় আর কালকের রাইত কাটবে রোশ্নীর বুক আর নাভীর নীচে!
-তুই আমারে ছাড়া আর কাউরে দিস?
-না! ওরে আমার ভাতার। খিল খিল কইরা হাসে রোশনী।
-হাছা কইরা ক’? ঝাপটে ধরে লোকমান।
-কইতামনা। আবার খিল খিল হাসি রোশনীর।
নরম রোশনীর ভিতরে ডুবে যেতে যেতে লোকমান ঘুম-ঘুম চোখে কারো হাটা-চলা অনুভব করে ঘরের বাইরে। সতর্ক হয়ে হাত বাড়ানোর আগেই টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে বাইরে। অন্ধকার বস্তিতে শেষ রাতে সবাই ঘুমে অচেতন। শুধু হালকা চান্দের আলো। হিস হিসিয়ে উঠে একটা গলাঃ ফকিন্নীর পুত বড় বাড় বাড়ছে। আমাগো রাস্তায় খাড়াইবার শক্তি পাইবিনা। ওইপারে যাইয়া মাস্তানী করিস!
দুইটা ভোঁতা আওয়াজ! মুখে তখনো লেগে আছে রোশনীর বুকের গন্ধ। ভয় পাচ্ছেনা লোকমান। মাথা পুরাই বিলা হইয়া যাইতে যাইতে তদবা খাইয়া পইড়া গেলো লোকমান। কেমুন জানি অসাঢ় লাগতেছে ডান পায়ের নীচের দিক আর বুকের কাছে। চান্দের দিকে চাইয়া দেখলো-একা একা চাদ বইসা আছে ঝিম মাইরা। আইজকা শরীরের আগুন নিভাইতে যাইয়া জীবনের আগুন নিভে যাইতাছে। মাল খাওনে মাথা কাজ করছেনা।
একি জীবন!
কেনো জানি মনে হলো জীবন আরো সুন্দর হইতে পারতো। ছোট্ট একটা ঘর-দুই চারডা পুলা-মাইয়া। একটা কইতরের ঘর আর দুই একটা শীমের ঝাড় কিংবা ছোটো একটা মুরগীর খোয়াড়। বাড়ীর দক্ষিনে থাকতো ঢেউখেলানো মাঠ আর সফেদ মটরশুঁটি আর শীতে খেজুরগাছে রস খেতে আসা দুই একটা হলুদ পাখি।
জীবন হইলো-রসের জীবন-রস খাও আর মইরা যাও!!
লিখেছেনঃ অনিমেষ রহমান