ঋতুতে ঋতুতে যে ভেদ সে কেবল বর্ণের ভেদ নহে , বৃত্তিরও ভেদ বটে । মাঝে মাঝে বর্ণসংকর দেখা দেয়— জ্যৈষ্ঠের পিঙ্গল জটা শ্রাবণের মেঘস্তূপে নীল হইয়া উঠে , ফাল্গুনের শ্যামলতায় বৃদ্ধ পৌষ আপনার পীত রেখা পুনরায় চালাইবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃতির ধর্মরাজ্যে এ- সমস্ত বিপর্যয় টেঁকে না ।
গ্রীষ্মকে ব্রাহ্মণ বলা যাইতে পারে । সমস্ত রসবাহুল্য দমন করিয়া , জঞ্জাল মারিয়া তপস্যার আগুন জ্বালিয়া সে নিবৃত্তিমার্গের মন্ত্রসাধন করে । সাবিত্রী-মন্ত্র জপ করিতে করিতে কখনো বা সে নিশ্বাস ধারণ করিয়া রাখে , তখন গুমটে গাছের পাতা নড়ে না ; আবার যখন সে রুদ্ধ নিশ্বাস ছাড়িয়া দেয় তখন পৃথিবী কাঁপিয়া উঠে । ইহার আহারের আয়োজনটা প্রধানত ফলাহার ।
বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বলিলে দোষ হয় না । তাহার নকিব আগে আগে গুরুগুরু শব্দে দামামা বাজাইতে বাজাইতে আসে — মেঘের পাগড়ি পরিয়া পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয় । অল্পে তাহার সন্তোষ নাই । দিগ্বিজয় করাই তাহার কাজ । লড়াই করিয়া সমস্ত আকাশটা দখল করিয়া সে দিক্চক্রবর্তী হইয়া বসে । তমালতালী-বনরাজির নীলতম প্রান্ত হইতে তাহার রথের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায় , তাহার বাঁকা তলোয়ারখানা ক্ষণে ক্ষণে কোষ হইতে বাহির হইয়া দিগ্বক্ষ বিদীর্ণ করিতে থাকে , আর তাহার তূণ হইতে বরুণ-বাণ আর নিঃশেষ হইতে চায় না । এ দিকে তাহার পাদপীঠের উপর সবুজ কিংখাবের আস্তরণ বিছানো , মাথার উপরে ঘনপল্লবশ্যামল চন্দ্রাতপে সোনার কদম্বের ঝালর ঝুলিতেছে , আর বন্দিনী পূর্বদিগ্বধু পাশে দাঁড়াইয়া অশ্রুনয়নে তাহাকে কেতকীগন্ধবারিসিক্ত পাখা বীজন করিবার সময় আপন বিদ্যুন্মণিজড়িত কঙ্কণখানি ঝলকিয়া তুলিতেছে।
আর শীতটা বৈশ্য । তাহার পাকা ধান কাটাই-মাড়াইয়ের আয়োজনে চারিটি প্রহর ব্যস্ত , কলাই যব ছোলার প্রচুর আশ্বাসে ধরণীর ডালা পরিপূর্ণ । প্রাঙ্গণে গোলা ভরিয়া উঠিয়াছে , গোষ্ঠে গোরুর পাল রোমন্থ করিতেছে , ঘাটে ঘাটে নৌকা বোঝাই হইল , পথে পথে ভারে মন্থর হইয়া গাড়ি চলিয়াছে ; আর ঘরে ঘরে নবান্ন এবং পিঠাপার্বণের উদ্যোগে ঢেঁকিশালা মুখরিত ।
এই তিনটেই প্রধান বর্ণ । আর শূদ্র যদি বল সে শরৎ ও বসন্ত । একজন শীতের , আর একজন গ্রীষ্মের তলপি বহিয়া আনে । মানুষের সঙ্গে এইখানে প্রকৃতির তফাত । প্রকৃতির ব্যবস্থায় যেখানে সেবা সেইখানেই সৌন্দর্য , যেখানে নম্রতা সেইখানেই গৌরব । তাহার সভায় শূদ্র যে , সে ক্ষুদ্র নহে , ভার যে বহন করে সমস্ত আভরণ তাহারই । তাই তো শরতের নীল পাগড়ির উপরে সোনার কলকা , বসন্তের সুগন্ধ পীত উত্তরীয়খানি ফুলকাটা । ইহারা যে-পাদুকা পরিয়া ধরণী-পথে বিচরণ করে তাহা রঙ -বেরঙের সূত্রশিল্পে বুটিদার ; ইহাদের অঙ্গদে কুণ্ডলে অঙ্গুরীয়ে জহরতের সীমা নাই ।
এই তো পাঁচটার হিসাব পাওয়া গেল । লোকে কিন্তু ছয়টা ঋতুর কথাই বলিয়া থাকে । ওটা নেহাত জোড় মিলাইবার জন্য । তাহারা জানে না বেজোড় লইয়াই প্রকৃতির যত বাহার । ৩৬৫ দিনকে দুই দিয়া ভাগ করো — ৩৬ পর্যন্ত বেশ মেলে কিন্তু সব-শেষের ঐ ছোট্টো পাঁচ-টি কিছুতেই বাগ্ মানিতে চায় না । দুইয়ে দুইয়ে মিল হইয়া গেলে সে মিল থামিয়া যায় , অলস হইয়া পড়ে । এইজন্য কোথা হইতে একটা তিন আসিয়া সেটাকে নাড়া দিয়া তাহার যত রকম সংগীত সমস্তটা বাজাইয়া তোলে । বিশ্বসভায় অমিল-শয়তানটা এই কাজ করিবার জন্যই আছে — সে মিলের স্বর্গপুরীকে কোনোমতেই ঘুমাইয়া পড়িতে দিবে না ; সেই তো নৃত্যপরা উর্বশীর নূপুরে ক্ষণে ক্ষণে তাল কাটাইয়া দেয় — সেই বেতালটি সামলাইবার সময়েই সুরসভায় তালের রস-উৎস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে ।
ছয় ঋতু গণনার একটা কারণ আছে । বৈশ্যকে তিন বর্ণের মধ্যে সব নীচে ফেলিলেও উহারই পরিমাণ বেশি । সমাজের নীচের বড়ো ভিত্তি ঐ বৈশ্য । এক দিক দিয়া দেখিতে গেলে সংবৎসরের প্রদান বিভাগ শরৎ হইতে শীত । বৎসরের পূর্ণ পরিণতি ঐখানে । ফসলের গোপন আয়োজন সকল-ঋতুতেই কিন্তু ফসলের প্রকাশ হয় ঐ সময়েই । এই জন্য বৎসরের এই ভাগটাকে মানুষ বিস্তারিত করিয়া দেখে । এই অংশেই বাল্য যৌবন বার্ধক্যের তিন মূর্তিতে বৎসরের সফলতা মানুষের কাছে প্রত্যক্ষ হয় । শরতে তাহা চোখ জুড়াইয়া নবীন বেশে দেখা দেয় , হেমন্তে তাহা মাঠ ভরিয়া প্রবীণ শোভায় পাকে , আর শীতে তাহা ঘর ভরিয়া পরিণত রূপে সঞ্চিত হয় ।
শরৎ-হেমন্ত-শীতকে মানুষ এক বলিয়া ধরিতে পারিত কিন্তু আপনার লাভটাকে সে থাকে-থাকে ভাগ করিয়া দেখিতে ভালোবাসে । তাহার স্পৃহনীয় জিনিস একটি হইলেও সেটাকে অনেকখানি করিয়া নাড়াচাড়া করাতেই সুখ । একখানা নোটে কেবলমাত্র সুবিধা , কিন্তু সারিবন্দি তোড়ায় যথার্থ মনের তৃপ্তি । এইজন্য ঋতুর যে অংশে তাহার লাভ সেই অংশে মানুষ ভাগ বাড়াইয়াছে । শরৎ-হেমন্ত-শীতে মানুষের ফসলের ভাণ্ডার , সেইজন্য সেখানে তাহার তিন মহল ; ঐখানে তাহার গৃহলক্ষ্মী । আর যেখানে আছেন বনলক্ষ্মী সেখানে দুই মহল — বসন্ত ও গ্রীষ্ম । ঐখানে তাহার ফলের ভাণ্ডার , বনভোজনের ব্যবস্থা । ফাল্গুনে বোল ধরিল , জ্যৈষ্ঠে তাহা পাকিয়া উঠিল । বসন্তে ঘ্রাণ গ্রহণ , আর গ্রীষ্মে স্বাদ গ্রহণ ।
ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা একমাত্র । তাহার জুড়ি নাই । গ্রীষ্মের সঙ্গে তাহার মিল হয় না ; গ্রীষ্ম দরিদ্র , সে ধনী । শরতের সঙ্গেও তাহার মিল হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই । কেননা শরৎ তাহারই সমস্ত সম্পত্তি নিলাম করাইয়া নিজের নদীনালা মাঠঘাটে বেনামি করিয়া রাখিয়াছে । যে ঋণী সে কৃতজ্ঞ নহে ।
মানুষ বর্ষাকে খণ্ড করিয়া দেখে নাই ; কেননা বর্ষা-ঋতুটা মানুষের সংসারব্যবস্থার সঙ্গে কোনো দিক দিয়া জড়াইয়া পড়ে নাই । তাহার দাক্ষিণ্যের উপর সমস্ত বছরের ফল-ফসল নির্ভর করে কিন্তু সে ধনী তেমন নয় যে নিজের দানের কথাটা রটনা করিয়া দিবে । শরতের মতো মাঠে ঘাটে পত্রে পত্রে সে আপনার বদান্যতা ঘোষণা করে না । প্রত্যক্ষভাবে দেনা-পাওনার সম্পর্ক নাই বলিয়া মানুষ ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া বর্ষার সঙ্গে ব্যবহার করিয়া থাকে । বস্তুত বর্ষার যা-কিছু প্রধান ফল তাহা গ্রীষ্মেরই ফলাহার-ভাণ্ডারের উদ্বৃত্ত ।
এইজন্য বর্ষা-ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু । কেননা কবি গীতার উপদেশকে ছাড়াইয়া গেছে । তাহার কর্মেও অধিকার নাই ; ফলেও অধিকার নাই । তাহার কেবলমাত্র অধিকার ছুটিতে ; কর্ম হইতে ছুটি , ফল হইতে ছুটি ।বর্ষা ঋতুটাতে ফলের চেষ্টা অল্প এবং বর্ষার সমস্ত ব্যবস্থা কর্মের প্রতিকূল । এইজন্য বর্ষায় হৃদয়টা ছাড়া পায় । ব্যাকরণে হৃদয় যে লিঙ্গই হউক , আমাদের প্রকৃতির মধ্যে সে যে স্ত্রীজাতীয় তাহাতে সন্দেহ নাই । এইজন্য কাজ-কর্মের আপিসে বা লাভ লোকসানের বাজারে সে আপনার পালকির বাহির হইতে পারে না । সেখানে সে পর্দা-নশিন ।
বাবুরা যখন পূজার ছুটিতে আপনাদের কাজের সংসার হইতে দূরে পশ্চিমে হাওয়া খাইতে যান , তখন ঘরের বধূর পর্দা উঠিয়া যায় । বর্ষায় আমাদের হৃদয়-বধূর পর্দা থাকে না । বাদলার কর্মহীন বেলায় সে যে কোথায় বাহির হইয়া পড়ে তাহাকে ধরিয়া রাখা দায় হয় । একদিন পয়লা আষাঢ়ে উজ্জয়িনীর কবি তাহাকে রামগিরি হইতে অলকায় , মর্ত হইতে কৈলাস পর্যন্ত অনুসরণ করিয়াছেন।
বর্ষায় হৃদয়ের বাধা-ব্যবধান চলিয়া যায় বলিয়াই সে সময়টা বিরহী বিরহিণীর পক্ষে বড়ো সহজ সময় নয় । তখন হৃদয় আপনার সমস্ত বেদনার দাবি লইয়া সম্মুখে আসে । এ দিক ও দিকে আপিসের পেয়াদা থাকিলে সে অনেকটা চুপ করিয়া থাকে কিন্তু এখন তাহাকে থামাইয়া রাখে কে ?
বিশ্বব্যাপারে মস্ত একটা ডিপার্টমেন্ট আছে , সেটা বিনা কাজের । সেটা পাব্লিক ওআর্কস ডিপার্টমেন্টের বিপরীত । সেখানে যে-সমস্ত কাণ্ড ঘটে সে একেবারে বেহিসাবি । সরকারি হিসাবপরিদর্শক হতাশ হইয়া সেখানকার খাতাপত্র পরীক্ষা একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছে । মনে করো , খামখা এতবড়ো আকাশটার আগাগোড়া নীল তুলি বুলাইবার কোনো দরকার ছিল না — এই শব্দহীন শূন্যটাকে বর্ণহীন করিয়া রাখিলে সে তো কোনো নালিশ চালাইত না ।
তাহার পরে , অরণ্যে প্রান্তরে লক্ষ লক্ষ ফুল একবেলা ফুটিয়া আর-একবেলা ঝরিয়া যাইতেছে , তাহাদের বোঁটা হইতে পাতার ডগা পর্যন্ত এত যে কারিগরি সেই অজস্র অপব্যয়ের জন্য কাহারও কাছে কি কোনো জবাবদিহি নাই ? আমাদের শক্তির পক্ষে এ সমস্তই ছেলেখেলা , কোনো ব্যবহারে লাগে না ; আমাদের বুদ্ধির পক্ষে এ সমস্তই মায়া , ইহার মধ্যে কোনো বাস্তবতা নাই ।
আশ্চর্য এই যে , এই নিষ্প্রয়োজনের জায়গাটাই হৃদয়ের জায়গা । এইজন্য ফলের চেয়ে ফুলেই তাহার তৃপ্তি । ফল কিছু কম সুন্দর নয় , কিন্তু ফলের প্রয়োজনীয়তাটা এমন একটা জিনিস যাহা লোভীর ভিড় জমায় ; বুদ্ধি বিবেচনা আসিয়া সেটা দাবি করে ; সেইজন্য ঘোমটা টানিয়া হৃদয়কে সেখান হইতে একটু সরিয়া দাঁড়াইতে হয় । তাই দেখা যায় তাম্রবর্ণ পাকা আমের ভারে গাছের ডালগুলি নত হইয়া পড়িলে বিরহিণীর রসনায় যে রসের উত্তেজনা উপস্থিত হয় সেটা গীতিকাব্যের বিষয় নহে । সেটা অত্যন্ত বাস্তব , সেটার মধ্যে যে প্রয়োজন আছে তাহা টাকা-আনা-পাইয়ের মধ্যে বাঁধা যাইতে পারে ।
বর্ষা-ঋতু নিষ্প্রয়োজনের ঋতু । অর্থাৎ তাহার সংগীতে তাহার সমারোহে , তাহার অন্ধকারে তাহার দীপ্তিতে , তাহার চাঞ্চল্যে তাহার গাম্ভীর্যে তাহার সমস্ত প্রয়োজন কোথায় ঢাকা পড়িয়া গেছে । এই ঋতু ছুটির ঋতু । তাই ভারতবর্ষের বর্ষায় ছিল ছুটি — কেননা ভারতবর্ষে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একটা বোঝাপড়া ছিল । ঋতুগুলি তাহার দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া দর্শন না পাইয়া ফিরিত না । তাহার হৃদয়ের মধ্যে ঋতুর অভ্যর্থনা চলিত ।
ভারতবর্ষের প্রত্যেক ঋতুরই একটা – না – একটা উৎসব আছে । কিন্তু কোন্ ঋতু যে নিতান্ত বিনা-কারণে তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে তাহা যদি দেখিতে চাও তবে সংগীতের মধ্যে সন্ধান করো । কেননা সংগীতেই হৃদয়ের ভিতরকার কথাটা ফাঁস হইয়া পড়ে ।বলিতে গেলে ঋতুর রাগরাগিণী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের । সংগীত-শাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব — কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত । ব্যবহারে দেখিতে পাই বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার — আর বর্ষার জন্য মেঘ , মল্লার , দেশ , এবং আরো বিস্তর । সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে বর্ষারই হয় জিত ।
শরতে হেমন্তে ভরা-মাঠ ভরা-নদীতে মন নাচিয়া ওঠে ; তখন উৎসবেরও অন্ত নাই , কিন্তু রাগিণীতে তাহার প্রকাশ রহিল না কেন ? তাহার প্রধান কারণ , ঐ ঋতুতে বাস্তব ব্যস্ত হইয়া আসিয়া মাঠঘাট জুড়িয়া বসে । বাস্তবের সভায় সংগীত মুজরা দিতে আসে না — যেখানে অখণ্ড অবকাশ সেখানেই সে সেলাম করিয়া বসিয়া যায় ।
যাহারা বস্তুর কারবার করিয়া থাকে তাহারা যেটাকে অবস্তু ও শূন্য বলিয়া মনে করে সেটা কম জিনিস নয় । লোকালয়ের হাটে ভূমি বিক্রি হয় , আকাশ বিক্রি হয় না । কিন্তু পৃথিবীর বস্তুপিণ্ডকে ঘেরিয়া যে বায়ুমণ্ডল আছে , জ্যোতির্লোক হইতে আলোকের দূত সেই পথ দিয়াই আনাগোনা করে । পৃথিবীর সমস্ত লাবণ্য ঐ বায়ুমেণ্ডলে । ঐখানেই তাহার জীবন । ভূমি ধ্রূব , তাহা ভার ী , তাহার একটা হিসাব পাওয়া যায় । কিন্তু বায়ুমণ্ডলে যে কত পাগলামি তাহা বিজ্ঞ লোকের অগোচর নাই । তাহার মেজাজ কে বোঝে ? পৃথিবীর সমস্ত প্রয়োজন ধুলির উপরে , কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত সংগীত ঐ শূন্যে — যেখানে তাহার অপরিচ্ছিন্ন অবকাশ ।
মানুষের চিত্তের চারি দিকেও একটি বিশাল অবকাশের বায়ুমণ্ডল আছে । সেইখানেই তাহার নানারঙের খেয়াল ভাসিতেছে ; সেইখানেই অনন্ত তাহার হাতে আলোকের রাখি বাঁধিতে আসে ; সেইখানেই ঝড়বৃষ্টি , সেইখানেই ঊনপঞ্চাশ বায়ুর উন্মত্ততা , সেখানকার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না । মানুষের যে অতিচৈতন্যলোকে অভাবনীয়ের লীলা চলিতেছে সেখানে যে-সব অকেজো লোক আনাগোনা রাখিতে চায় — তাহারা মাটিকে মান্য করে বটে কিন্তু বিপুল অবকাশের মধ্যেই তাহাদের বিহার । সেখানকার ভাষাই সংগীত । এই সংগীতে বাস্তবলোকে বিশেষ কী কাজ হয় জানি না — কিন্তু ইহারই কম্পমান পক্ষের আঘাত-বেগে অতিচৈতন্যলোকের সিংহদ্বার খুলিয়া যায় ।
মানুষের ভাষার দিকে একবার তাকাও । ঐ ভাষাতে মানুষের প্রকাশ ; সেই জন্যে উহার মধ্যে এত রহস্য । শব্দের বস্তুটা হইতেছে তাহার অর্থ । মানুষ যদি কেবলমাত্র হইত বাস্তব , তবে তাহার ভাষার শব্দে নিছক অর্থ ছাড়া আর কিছুই থাকিত না । তবে তাহার শব্দ কেবলমাত্র খবর দিত — সুর দিত না । কিন্তু বিস্তর শব্দ আছে যাহার অর্থপিণ্ডের চারি দিকে আকাশের অবকাশ আছে , একটা বায়ুমণ্ডল আছে । তাহারা যেটুকু জানায় তাহারা তাহার চেয়ে অনেক বেশি — তাহাদের ইশারা তাহাদের বাণীর চেয়ে বড়ো । ইহাদের পরিচয় তদ্ধিত প্রত্যয়ে নহে , চিত্তপ্রত্যয়ে । এই সমস্ত অবকাশওয়ালা কথা লইয়া অবকাশবিহারী কবিদের কারবার। এই অবকাশের বায়ুমণ্ডলেই নানা রঙিন আলোর রঙ ফলাইবার সুযোগ — এই ফাঁকটাতেই ছন্দগুলি নানা ভঙ্গিতে হিল্লোলিত হয়।
এই – সমস্ত অবকাশবহুল রঙিন শব্দ যদি না থাকিত তবে বুদ্ধির কোনো ক্ষতি হইত না কিন্তু হৃদয় যে বিনা প্রকাশে বুক ফাটিয়া মরিত । অনির্বচনীয়কে লইয়া তাহার প্রধান কারবার ; এই জন্য অর্থে তাহার অতি সামান্য প্রয়োজন । বুদ্ধির দরকার গতিতে , কিন্তু হৃদয়ের দরকার নৃত্যে । গতির লক্ষ্য — একাগ্র হইয়া লাভ করা , নৃত্যের লক্ষ্য — বিচিত্র হইয়া প্রকাশ করা । ভিড়ের মধ্যে ভিড়িয়াও চলা যায় কিন্তু ভিড়ের মধ্যে নৃত্য করা যায় না । নৃত্যের চারিদিকে অবকাশ চাই । এইজন্য হৃদয় অবকাশ দাবি করে । বুদ্ধিমান তাহার সেই দাবিটাকে অবাস্তব এবং তুচ্ছ বলিয়া উড়াইয়া দেয় ।
আমি বৈজ্ঞানিক নহি কিন্তু অনেকদিন ছন্দ লইয়া ব্যবহার করিয়াছি বলিয়া ছন্দের তত্ত্বটা কিছু বুঝি বলিয়া মনে হয় । আমি জানি ছন্দের যে অংশটাকে যতি বলে অর্থাৎ যেটা ফাঁকা , অর্থাৎ ছন্দের বস্তু অংশ যেখানে নাই সেইখানেই ছন্দের প্রাণ — পৃথিবীর প্রাণটা যেমন মাটিতে নহে , তাহার বাতাসেই । ইংরেজিতে যতিকে বলে pause — কিন্তু pause শব্দে একটা অভাব সূচনা করে , যতি সেই অভাব নহে । সমস্ত ছন্দের ভাবটাই ঐ যতির মধ্যে — কারণ যতি ছন্দকে নিরস্ত করে না নিয়মিত করে । ছন্দ যেখানে যেখানে থামে সেইখানেই তাহার ইশারা ফুটিয়া উঠে , সেইখানেই সে নিশ্বাস ছাড়িয়া আপনার পরিচয় দিয়া বাঁচে ।
এই প্রমাণটি হইতে আমি বিশ্বাস করি বিশ্বরচনায় কেবলই যে সমস্ত যতি দেখা যায় সেইখানে শূন্যতা নাই , সেইখানেই বিশ্বের প্রাণ কাজ করিতেছে । শুনিয়াছি অণু পরমাণুর মধ্যে কেবলই ছিদ্র — আমি নিশ্চয় জানি সেই ছিদ্রগুলির মধ্যেই বিরাটের অবস্থান । ছিদ্রগুলির মুখ্য , বস্তুগুলিই গৌণ । যাহাকে শূন্য বলি বস্তুগুলি তাহারই অশ্রান্ত লীলা । সেই শূন্যই তাহাদিগকে আকার দিতেছে , গতি দিতেছে , প্রাণ দিতেছে । আকর্ষণ-বিকর্ষণ তো সেই শূন্যেরই কুস্তির প্যাঁচ । জগতের বস্তুব্যাপার সেই শূন্যের , সেই মহাযতির , পরিচয় । এই বিপুল বিচ্ছেদের ভিতর দিয়াই জগতের সমস্ত যোগসাধন হইতেছে — অণুর সঙ্গে অণুর , পৃথিবীর সঙ্গে সূর্যের , নক্ষত্রের সঙ্গে নক্ষত্রের । সেই বিচ্ছেদমহাসমুদ্রের মধ্যে মানুষ ভাসিতেছে বলিয়াই মানুষের শক্তি , মানুষের জ্ঞান , মানুষের প্রেম , মানুষের যত কিছু লীলাখেলা । এই মহাবিচ্ছেদ যদি বস্তুতে নিরেট হইয়া ভরিয়া যায় তবে একেবারে নিবিড় একটানা মৃত্যু ।
মৃত্যু আর কিছু নহে — বস্তু যখন আপনার অবকাশকে হারায় তখন তাহাই মৃত্যু । বস্তু তখন যেটুকু কেবলমাত্র সেইটুকুই , তার বেশি নয় । প্রাণ সেই মহাঅবকাশ — যাহাকে অবলম্বন করিয়া বস্তু আপনাকে কেবলই আপনি ছাড়াইয়া চলিতে পারে ।বস্তুবাদীরা মনে করে অবকাশটা নিশ্চল কিন্তু যাহারা অবকাশরসের রসিক তাহারা জানে বস্তুটাই নিশ্চল , অবকাশই তাহাকে গতি দেয় । রণক্ষেত্রে সৈন্যের অবকাশ নাই ; তাহারা কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া ব্যূহরচনা করিয়া চলিয়াছে , তাহারা মনে ভাবে আমরাই যুদ্ধ করিতেছি । কিন্তু যে-সেনাপতি অবকাশে নিমগ্ন হইয়া দূর হইতে স্তব্ধভাবে দেখিতেছে , সৈন্যদের সমস্ত চলা তাহারই মধ্যে । নিশ্চলের যে ভয়ংকর চলা তাহার রুদ্রবেগ যদি দেখিতে চাও তবে দেখো ঐ নক্ষত্রমণ্ডলীর আবর্তনে , দেখো যুগ-যুগান্তরের তাণ্ডব নৃত্যে । যে নাচিতেছে না তাহারই নাচ এই – সকল চঞ্চলতায় ।
এত কথা যে বলিতে হইল তাহার কারণ , কবিশেখর কালিদাস যে আষাঢ়কে আপনার মন্দাক্রান্তাচ্ছন্দের অম্লান মালাটি পরাইয়া বরণ করিয়া লইয়াছেন তাহাকে ব্যস্ত-লোকেরা ‘ আষাঢ়ে ‘ বলিয়া অবজ্ঞা করে । তাহারা মনে করে এই মেঘাবগুণ্ঠিত বর্ষণ-মঞ্জীর-মুখর মাসটি সকল কাজের বাহির , ইহার ছায়াবৃত প্রহরগুলির পসরায় কেবল বাজে কথার পণ্য । অন্যায় মনে করে না । সকল কাজের বাহিরের যে দলটি যে অহৈতুকী স্বর্গসভায় আসন লইয়া বাজে কথার অমৃত পান করিতেছে , কিশোর আষাঢ় যদি আপন আলোল কুন্তলে নবমালতীর মালা জড়াইয়া সেই সভার নীলকান্তমণির পেয়ালা ভরিবার ভার লইয়া থাকে , তবে স্বাগত , হে নবঘনশ্যাম , আমরা তোমাকে অভিবাদন করি । এসো এসো জগতের যত অকর্মণ্য , এসো এসো ভাবের ভাবুক , রসের রসিক ,- আষাঢ়ের মৃদঙ্গ ঐ বাজিল , এসো সমস্ত খ্যাপার দল , তোমাদের নাচের ডাক পড়িয়াছে । বিশ্বের চির-বিরহবেদনার অশ্রু-উৎস আজ খুলিয়া গেল , আজ তাহা আর মানা মানিল না । এসো গো অভিসারিকা , কাজের সংসারে কপাট পড়িয়াছে , হাটের পথে লোক নাই , চকিত বিদ্যুতের আলোকে আজ যাত্রায় বাহির হইবে — জাতীপুষ্প-সুগন্ধি বনান্ত হইতে সজল বাতাসে আহ্বান আসিল — কোন্ ছায়াবিতানে বসিয়া আছে বহুযুগের চিরজাগ্রত প্রতীক্ষা!
– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর