কারুকার্জ করা সুন্দর সুরমাদানি থেকে অদ্ভুত কায়দায় সুরমা কাঠিটা চোখের দুই পাতা’র মাঝাখানে আলতো চেপে বাবা বলতেন- জানো সুরমা কোথা থেকে আসে, তুর পাহাড়! যখন মুসা নবী আল্লাহ কে দেখতে চাইলেন ভীষণ রকমের আলোকচ্ছটায় পুড়ে ছাই হলো তুর পাহাড় আর ঐ পাহাড়ের ছাই হয়ে গেলো সুরমা। চোখের জন্য খুবি উপকারী।
বাবা গত হওয়ার পর জোড় জবরদস্তিতে সুরমা দিলেও সুরমা’র চেয়ে যার জন্য পাহাড় পুড়ে ছাই হলো তাঁকে ঘিরেই আমার কৌতুহলটা ছিলো বেশী। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে আর বাড়ীতে বিভিন্ন মৌলুদ মিলাদে মুসা নবীর বেশ সাহসিকতা বডি বিল্ডার দৌহিক বর্ননা, বক্ষাব্দি ঝোলা দাড়ি, হাতের লাঠিকে সাপ বানানো, নীল নদকে কে পানি শূন্য করে বরাবর রাস্তা বানিয়ে দলবল নিয়ে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদিতে অনেক পুলকিত হতাম। কল্পনার মুসা নবী আমার অবচেতন কিশোরমনে খুঁজে বেড়াতে থাকে রক্তমাংসে ধরা ছোঁয়া’র “মুসা সম” কোন একজন!
কোন এক বর্ষাকালে মা যাচ্ছেন উনার সই বাড়ীতে- নাইওর। রঙ্গীন নৌকার ছই এর নীচে শুয়ে আড়াআড়ি আকাশ দেখছি, হালে যে লোকটা বসা, বক্ষাব্দি কাঁচা দাড়ি, বৈঠা টানার সাথে সাথে টান টান পেশী বেনিয়াম গেঞ্জি ফেটে ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পালে বাতাস পাওয়ার সাথে সাথে কালো পানির নদীটা পাড় হতে হতে “ হেই আলী.. আলী.. আলী” বলে কষে একহাতে হাল এক হাতে পালের রশি-গলার দু’ধারের রগ ফুলে উঠেছে; ঝোলা দাড়ি বাতাসে লেপ্টে যাচ্ছে বুকের সাথে পেছনে রৌদ্র ঝলমলে আকাশ, বিরাট বপু’র – ফিরোজ আলী মিয়া। আমার হ্রদয়ে মানসপটে ধরা দিলেন খানিক মুসা আদলে।
দাদা, বাবা সবাই ডাকতেন ফিরোজ আলী মিয়া । আমি ডাকি ফিরোজ আলী কাক্কু। মুলতঃ পারিবারিক রঙ্গীন নৌ্কার প্রধান মাঝি। পরিবারের বাজার হাট থেকে শুরু করে বাপ চাচা’দের ভ্রমন সঙ্গী এমন কি গভীররাতব্দি বাড়ীর চারিদিকে পাহারা দেয়া ছাড়াও উনার দায়িত্বের অন্তঃছিলো না। ফিরোজ আলী কাক্কুর সাহসিকতার কথা ছিলো এলাকা জোরা। মাল কুস্তি, এক ঘুসিতে দেহুন্দা গায়ের একজন কে কুপোকাত। রাজাকার তাঊক্কা মুন্সি কে দাবড়িয়ে বেড়ানো। হাওড় নৌকাডুবিতে গভীর রাতে হীজল গাছে পেত্তর, পেত্নী দের সাথে রাত কাটানোর দারুন দারুন সব ঘটনা।
মান্দাল গাছের ডালায় বাধা মাটির কলসটার কাছে মা শালিক’টা বেশ চেচামেচি করছে, আর কলসটার ভেতর থেকে মাঝে মাঝে গলা বের করে তীঘ্ন স্বরে ডাকছে শালিক ছানা গুলো। একটা চিল অনেক উপর থেকে ঘুরে ঘুরে একদম কলসটার ডালে ছোঁ মারার চেষ্টা করছে। দৃশ্যটা দেখে নিজের অপারগতায় খারাপ লাগছে। কিছুই করার নাই। হঠাত ফিরোজ আলী কাক্কু কোথা থেকে জেনো মাল কাছু মেরে তরতর করে দুইলাফে মান্দাল গাছের সেই ডালে। অদ্ভুত ভাবে কলস নিয়ে একদম আমার কাছে। এই না হলো মুসার কাজ!
-বাবাজী বাচ্চা দুটো কলসেই থাকুক, কাল পরশু খাঁচা নিয়া আসমু।
আমি তো খুশিতে আত্মহারা যে সে পাখি না, ভাত শালিকের ছানা।
-কাক্কু, খাবে কি! সদাহাস্য ফিরোজ আলী কাক্কু জবাব দেয়
-হলুদ বিরান (ভাজা) দিয়ে ভাত।
শালিক ছানা’তে ভাগ বসানোর ফিকির ফন্দি’তে আমার প্রতি বন্ধুদের আদর তোষামোদি বাড়ার সাথে সাথে যোগ হয় গোটা তিনেক নতুন বন্ধু। ওরা দুষ্টমিতে আমার কয়েক র্যাংক উপড়ে।
পরের দিন দুপুরে আমাদের সবাইকে অবাক করে ফিরোজ আলী কাক্কু আমাদের কে রান্না ঘরে লাইন ধরে বসিয়ে হুলুদ বিরান দিয়ে ভাত দেন। আমি বলি, হুলুদ ভাত তো শালিকের জন্যে। উনি বলেন হলুদ ভাত প্রথমে আমরা না খেলে শালিক ছানা খাবে না, তাই আমদেরকেই প্রথম খেতে হবে। যাক, হলুদ বিরান এর ভাত আমাদের কে কেনো খেতে হয়েছিলো কারনটি পরে জানতে পারলেও সেই হলুদ বিরান এর স্বাদটা এখনো লেগে আছে। শালিক ছানা কে হলুদ ভাত খাওয়ানো শেষে ফিরোজ আলী কাক্কু জানালেন ভাতের পাশাপাশি ওদের কে ফংকা (ঘাস ফরিং) বিশেষ করে মালপোকা (ঝিঝি পোকা) খাওয়াতে হবে। মুহুর্তে একলাফেই এই দুধরনের পোকার আবাস্থল সন্ধান দিয়ে দেয় নতুন বন্ধুত্রয়।
বাড়ী থেকে অদূরেই ঝিরঝিরে নালা’টা তে হাটূ পানি ভেঙ্গে ভিটাবাড়ির ঘাশে লুকিয়ে থাকা ঘাশ ফরিং ধরি। ভিটাবাড়ির আশপাশটা নিয়ে মেছো দেও থেকে শুরু করে ভুত পেত্নীর অনেক কির্তীকলাপের কথাতে সন্ধ্যারাতে ঐখানটায় ঝিঝি পোকার সন্ধানে গিয়েও ফিরে আসি কয়েকবার।
দেখতে দেখতে কোরবানী’র ঈদ। বাড়ীর রেওয়ানুযায়ী কোরবানির পর গরুর চামরাবিহীন শিং সহ মাথাটা ঝুলানো হয় গোহাল(গোশালা) ঘরের দরজার উপর। বছরাব্দি মাথাটা ওখানেই ঝুলে থাকে। এবার ঈদের দু’দিন পর থেকে ঝুলানো মাথা উধাও! ঈদের দিন পাঁচেক পর বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে সন্ধ্যার ঠিক খানিক পরে ঝিঁঝিঁ পোকার জন্য হাটু পানির মাঝ নালাতে আসতেই দেখি আবছা আলো আঁধারে ভিটাবাড়ির বাঁশঝাড়ের নীচের ঘরটার বেরাতে একটা কালো ছায়া মুর্তি ক্রমশঃ লম্বা হচ্ছে। সেকেন্ড পাঁচেক দৃশ্যটা দেখে সারা গা শিঊরে উঠতেই এক দৌড়ে বাড়ীতে, বরাবরের মতো আমাকে নিম পাতা আর সোনা রুপা বিধৌত পানি তে গোসল করানো হয়। ব্যাপারটী নিয়ে হৈ চৈ আর আমাকে ঘিরে সবার উৎকণ্ঠার মাঝেই আমাদের ফিরোজ আলী কাক্কু পারলে হারিক্যান নিয়ে তৎক্ষণাৎ সরজমিন তদন্তে বেরোয়। স্বগতঃ উক্তিতে ফিরোজ আলী কাক্কু বলে যেতে থাকে উনার স্বীয় সাহসিকতার বীরত্ব গাথা-
“আরে জীবনে কত দেও দানবেরে সাইজ করলাম…হালাল বন্দের (হাওড়ের) দেও’ডারে কিলাইয়া হুতায়ালছি (ধরাশায়ী) আর তরা আচছ বাড়ীর পিছের হাচামুচিডারে (ছোট) লইয়া”-ইত্যাদি।
নতুন বন্ধুত্রয়ের একজন, ভুট্টূ মিয়া তো রিতীমতো আমাকে ভিতু “কাপুরুষ” এর পর্যায়ে নিয়ে যেতেও দ্বিধা করল না। সারারাত ব্যপারটা আমাকে ভাবিয়ে তূলে।
পরের দিন দুপুরে সদলবলে ঘাশফরিং এর খোজে নালা পেরিয়ে ভিটাবাড়িতে। দুই চারটা ফরিং ধরতেই দেখি পাড়ার সন্ডা মার্কা কালো কুকুরটা ছোট বাঁশঝাড়ের নিচের ঘরটার বেরাতে দু’পায়ে দাড়িয়ে নিখোঁজ হওয়া ঝুলানো গরুর মাথাটা আপ্রানে ধরার চেষ্টায়। যতই ওর চেষ্টা বাড়ছে ততই কুকুরটা দৈর্ঘ্যে বাড়ছে!! ব্যাপারটা নিজের মধ্যেই রাখি। গরুর মাথা এখানে কে এনে ঝোলালো এটা না ভেবে ভাবতে থাকি অন্ততঃ গত রাতের রহস্য জটাজাল তো ভেদ হলো! হুট করে মাথায় পরিকল্পনা আর ফন্দি এসে ভর করে। কুকুর ছায়া’তে ফিরোজ আলী কাক্কু এবং ভূট্টো গং দের সাহসিকতার অগ্নি পরীক্ষায়-
মাগরিবের আযান শেষ, ঝানকর্তাল নিয়ে সন্ধ্যা কীর্তন বেরিয়েছে। আবছা আলো আধারি। বাড়ির বড় বাঁশঝাড়টায় পাখপাখালীর কোলাহল থেমে গিয়ে নীরব। ফিরোজ আলী কাক্কু লুঙ্গিটা দুভাজ করে সাইজে নিজের চে’ লম্বা একহাতে বেন্দা লাঠিটা আরেক হাতে বায়োজিদ মার্কা হ্যারিকেন নিয়ে প্রস্তুত। আমাদের কে ভুত পেত্তর সম্বন্ধে নির্ভয় থাকার ব্রিফিং দিয়ে আমাদেরকে এই বয়সে “ব্যাডা” (পুরুষ) হতে বলার কথা স্মরন করিয়ে উনার পেছনে লাইনআপ করতে বললেন।
নালাটা তে নামা মাত্রই সন্ডা কুকুরের ছায়াবয়াব দেখা গেলো আমি বললাম,
– কাককু ঐ যে!
উনি আস্তে করে উনার ডানহাত টা উচু করে ঈশারাতে আমাদের কে দাঁড়াতে বললেন। আমরা সবাই হল্ট পজিশনে। লাইনে ঊনার পেছনেই আমি, আমার দু’জন পর ছিলো মহাসাহসী ভূট্টো। সবাই ঠায় দাঁড়িয়ে। কুকুর ছায়ামুর্তি খানিকটা ছোট হয়ে যেই আবার একটু লম্বা হলো, শুনলাম- ফিরোজ আলী কাক্কু শুধু উচ্চারন করলো- লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা…ধরাশ করে মাটি আর নালার পানিতে ধরাশায়ী। ততক্ষনে হাতের বায়োজিদ হারিক্যান পেছনে ফেলা বাঁশঝাড়ের উপর দিয়ে ভোঁ করে ঊড়ে যাচ্ছে। কাদামাটিতে উবু মুখে গড়াগড়িতে তখনো আমাদেরকে বলে চলছে- “ডরাইস না, এইতা কিছতা না… লা হাওলা…কু আতা।
অদূরে শোনা গেলো ভূট্টো মিয়ার আর্ত চিৎকার…মা’য়া… গো… ও… মা’য়া…
ছবিঃ-আমি। “বার্নিং বুশ” (মুসা)।