কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের ভোগবেতাল নামকস্থানে রয়েছে কিশোরগঞ্জের প্রাচীন জিঁওর গোপীনাথ মন্দির। এটি খ্রীষ্টীয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত বাংলাদেশের একটি প্রাচীন বিখ্যাত দেব দেউল। প্রাচীন স্থাপত্যরীতি ধারায় দেশী ছনের চৌচালা ঘরের প্যাটার্নে তৈরী মন্দিরের জীর্ণ প্রাচীন প্রাচীরে একটি শিলালিপি রয়েছে।আজো মন্দির গাত্রে ফরাশি ভাষায় উৎকীর্ণ এ শিলা লিপিটি মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। তবে এর পাঠোদ্বার হলে হয়ত প্রকৃত ইতিহাসের আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।
জনশ্রুতি রয়েছে চারিপাড়ার এককালের প্রাচীন তান্দ্রিক সামন্তরাজ নবরঙ্গ রায় কর্তৃক এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে দেয়াল ঘেরা মূল ফটক দুটি।কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালে মূল মন্দির সহ পুরাতন মন্দির ছিল সাতটি।প্রায় অর্ধমাইল ছিল গোপীনাথ জিঁওর মন্দিরের অবস্থান এলাকা। বর্তমানে ২ টি মন্দির, ১ টি রন্ধনশালা, ৩ টি অতিথি শালা, টি শিব মন্দির,১ টি ঝুলন মন্দির,১ টি ভান্ডার ঘর, ১ টী নাথ মন্দির, ১ টি পুকুর, ১ টি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ও ১ টি অফিস কক্ষ রয়েছে। পুকুরের পাশে একটি প্রাচীন ‘হাতির পুল’ নামে একটি জীর্ণ রাস্তা সহ প্রাচীন পুলের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। জানা যায় এককালে এ পুলের উপর দিয়ে হাতি ঘোড়া পারাপার হতো বলে এটি ‘হাতির পুল’ নামে পরিচিত ছিল। আজ মূল মন্দির সহ এই হাতির পুল সবই জীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় কালের চক্রে ভগ্নদশায় শুধু প্রাচীন স্মৃতি কীর্তির সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
মন্দির থেকে একটু দুরে রয়েছে দোলমঞ্চ, কৃত্রিম পাহাড় ও পুষ্পোদ্যান। গোপীনাথের মাসীর বাড়ী, পিসির বাড়ী বলে খ্যাত দুটি বাড়ী আজও দুটি সুউচ্চ মাটির পাহাড় ন্যায় ঢিবি রয়েছে।গোপীনাথের শশুর বাড়ী ১ টি পুকুর ও নিজ বাড়িতে দুটি পুকুর রয়েছে।এ ত বিশাল আয়তনের আখড়া এ জেলায় দ্বিতীয়টি আর নেই।বর্তমানে এ মন্দিরে নিম কাঠের তৈরী ৩ টি মূর্তিসহ বেশ কটি পিতলের মূর্তি রয়েছে, জানা যায় – মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত আদি কষ্টি পাথরের তৈরী বিরাট আকারের মূর্তি সুভদ্রা, বলারাম ও রাধিকার বিগ্রহ গুলি চুরি অথবা পাচার হয়ে গেছে। বর্তমানে এগুলি কাঠের দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দির এবং মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের নামে অনেক ‘লাখেরাজ’জমি ছিল। এই লাখেরাজ বিস্তর জমি জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান বীর ঈশা খাঁ দান করেছিলেন।
জনশ্রুতি রয়েছে-শ্রী চৈতন্যদেবের সম সাময়িককালে তারই এক অন্যতম ভক্ত শিষ্য ভারতের উড়িষ্যার পুরী নিবাসী শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেব স্বপ্ন যোগে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে আচমিতার এই গহীন জঙ্গলে এসে উপস্থিত হন। এখানে এসে তিনি বিগ্রহের পূজার জন্য ভোগের ব্যবস্থা করেন। ঠিক ঐ সময়ে পাশ দিয়ে দ্বোয়ান ঈশা খাঁ হয়তো জঙ্গলবাড়ী অথবা এগারসিন্দুর অথবা এগারসিন্দুর যাওয়ার পথে জগন্নাথ সন্নাসীর ভোগের ঘ্রাণে বেতাল সুগন্ধি ছড়িয়ে দেওয়ানের নাকে ঘ্রাণে আকৃষ্ট ও অস্থির হয়ে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের সাথে দর্শন লাভ করে। ঘটনাক্রমে সন্নাসী জগন্নাথ গোসাই এর কাছ থেকে সবকিছু জেনে দেওয়ান ঈশা খাঁ নিজ ব্যয়ে বিগ্রহসহ মন্দির ও বিস্তর ‘লাখেরাজ’ সম্পত্তি দান করেন। অন্যদিকে চারিপাড়া তান্ত্রিক সামন্তরাজ নবরঙ্গ রায়ের সঙ্গে বীর ঈশা খাঁর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে সামন্তরাজ নবরঙ্গ রায় পরাজিত হলে চারিপাড়া সহ এলাকার সমস্ত ভূমি বীর ঈশা খাঁ অধিকারে আসে। আজো আচমিতার চারিপাড়া গ্রামে সামন্তরাজ নবরঙ্গ রায়ের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ও বিশাল আয়তনের কুটামন দিঘী দেশ বিদেশের বহু পর্যটকদের দৃষ্টী আকর্ষন করে।
এক কালে এ দেবালয়টি ছিল বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অন্যতম আকর্ষনীয় তীর্থস্থান। ভারতের উড়িষ্যার পুরীতে জগন্নাথ দেবের রথ যাত্রার পরি ছিল আচমিতা ভোগ বেতালের স্থান।আজও এখানে একটি প্রাচীন প্রবাদ প্রচলিত আছে-‘পুরীর জগন্নাথ আর বঙ্গের গোপীনাথ’।
পাঁচশত বছর পূর্বে এ উপমহাদেশের বিভিন্ন শিল্পীদের দ্বারা কারুকাজ খচিত ১৬ টি চাকা বিশিষ্ট একটি প্রাচীন রথ তৈরী করা হয়েছিল। জানা যায় উচ্চতার দিক থেকে এ রথটি এ জেলার সর্বোচ্চ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রথ যাত্রা হিসেবে পরিগণিত হতো। রথের সন্মূখে ছিল কাঠের তৈরী দুটি সারথী এবং এদের জন্য দুটি কাঠের তৈরো ঘোড়া। রথটি মোট তিন ধাপে নির্মিত।প্রতিটি ধাপে কারুকার্যের বারান্দা। সর্বোচ্চ ছিল পিতলের তৈরী দোলনা।
রথ উপলক্ষে গোপীনাথ,বলরাম ও রাধিকার মূর্তি স্থাপন করা হয়।এককালে স্থানীয় জমিদার,তালুকদার তাদের হাতি ঘোড়া দিয়ে রথ টেনে মাসি-পিসির বাড়িতে আনা নেওয়া হতো। গোপীনাথ জিঁওর হতে ১ কিঃমিঃ গুন্ডিচা বাড়ী পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ পথ রথ যাত্রার ইতিহাসে ভোগ বেতাল আজও বিখ্যাত। বিগত ১৮৯৭ খ্রীঃ শ্রীবেদ্র ভূমিকম্পে মূল মন্দিরটির বারান্দা সহ বেশ কয়েকটি মন্দিরসহ মন্দিরের বিভিন্ন সংশ ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীকালে পূর্বাংশে একটি নতুন মন্দির নির্মাণ করে মূল মূর্তি গুলি সেখানে স্থাপন করা হয়। মন্দিরের কাঠের দরজা গুলি প্রাচীন আমলের তৈরী।বিভিন্ন সময়ে বর্তমান রথটি সংস্কার করার পর বর্তমানে এটি ৯ চাকা বিশিষ্ট রথ হিসেবে পরিচিত।
প্রতি বছর গোপীনাথ রথ যোগে তার গুচিন্ডা নামক বাড়ী গমন করেন। সপ্তাহ কাল পরে নিজ বাড়িতে অর্থাৎ মন্দিরে ফিরে আসেন। পথের মধ্যে গোপীনাথ মাসীর বাড়ি এবং পিসির বাড়ী অবস্থান করেন। গোপীনাথের ১ টি পুকুর নিয়ে স্থানীয় ভাবে মামলা রয়েছে।রথযাত্রা মেলা উপলক্ষে আচমিতা ভোগ বেতাল গোপীনাথ জিওর মন্দির সংলগ্ন বিস্তর এলাকায় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটে। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে এ মেলার ঐতিহ্য হয়ে উঠে লক্ষ মানুষের মিলনমেলা। এ মেলার প্রধান আকর্ষন হয়ে উঠে বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালির সংগ্রহ ও সংরক্ষন।যেমন – ময়না, টিয়া, শ্যামা, পিক হলদে পাখি ইত্যাদি।দেশের দূর দূরান্ত থেকে ক্রেতারা পাখি সংগ্রহ করতে এ মেলায় ছুটে আসসেন। এ ছাড়াও মাঘ মাসেরপ্রথম দিক থেকে ৫৬ প্রহর ব্যাপী অর্থাৎ ৭ মাঘ পর্যন্ত রাত দিন একনাগারে একনাম বা হরিনাম সংকীর্তনে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ নারী-পুরুষ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে উৎসবে অংশগ্রহন করেন।
শত শত বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান টি সেবায়তের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে।কিন্তু বিগত ১৯৮৩ সালে মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি ট্রাস কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি দ্বারা বর্তমানে মন্দির বা আখড়ার আয় ব্যয়সহ সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানে কমিটির সভাপতি কটিয়াদী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। সাধারণ সম্পাদক বাবু দিলীপ কুমার সাহা, সহ সাধারণ সম্পাদক বাবু বেনী মাধব ঘোষ,চিত্তরঞ্জন বনিক ও মধুবনিক সহ কমিটির অন্যান্য নিবেদিত প্রাণ সদস্যগণের সক্রিয় সহযোগিতায় প্রাচীন এ দেবালয়টি সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হয়ে এটি একটি আনন্দ ধাম হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আলোকিত কিশোরগঞ্জ জেলার ভোগ বেতাল গোপীনাথ জিঁওর মন্দির ও আখড়াটি এ অঞ্চলের আলোক বর্তিকা হিসাবে সমাজ সংস্কার ও সাংস্কৃতিতে ধর্ম চর্চায় আগামী দিনেও অবদান রাখবে বলে প্রত্যাশা করি।
জনশ্রুতি রয়েছে-গোপীনাথ বাড়ীর নিকট এককালে ‘বাউল সাগর’ নামের একটি ছোট নদী ছিল। কিন্তু সে নদীর ঠিকানা আজ কোথায় এর কোন সঠিক তথ্য জানা আজ আর সম্ভব নয়।
Very informetive. We need to go around all primary school and high school of kishorgonj and let our next genaretion know about rich cultures of আমাদের কিশোরগঞ্জ। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।