কোকিল বাংলার একটি সুপরিচিত পাখি। এরা চমৎকার গান গেয়ে বসন্তকালকে মুখরিত করে তোলে। বংশবিস্তারের জন্য এরা অন্য কোনো পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। এ জন্যই ‘কাকের বাসায় কোকিলের ডিম’ কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কোকিল কখনোই ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটায় না। মাতৃস্নেহবঞ্চিতই থেকে যায় কোকিলছানাদের শৈশব। প্রকৃতিগত কারণেই এরা পুরোপুরিভাবে ধাত্রী পাখিদের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে কাক, বুলবুলি, বাঘাটিকি, বনছাতারে এমনকি বসন্ত বাউরির বাসাকে এরা আগে থেকেই ডিম পাড়ার উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্বাচন করে রাখে এবং অতি কৌশলে সেখানে গিয়ে দ্রুততার সঙ্গে ডিম পাড়ে। কোকিল কখনো বাসা বাঁধে না বলে প্রজননকালে এরা পরনির্ভরশীল পাখি।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি এবং পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক জানান, এদের এশীয় কোকিল বলা হয়। ইংরেজি নাম অংরধহ কড়বষ এবং বৈজ্ঞানিক নাম Eudynamys scolopaceus. গঠন মাঝারি আকারের। এদের দৈর্ঘ্য ৪৩ সেন্টিমিটার, ওজন প্রায় ১৭০ গ্রাম। ডানা ২২ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৩.৩ সেন্টিমিটার, পা ৩.৫ সেন্টিমিটার এবং লেজ ২০ সেন্টিমিটার লম্বা। এদের ঠোঁট শক্ত ও বাঁকা। পুরুষ পাখির চেহারা স্ত্রী পাখির চেয়ে বেশ ভিন্ন। পুরুষ কোকিলের শরীরে চকচকে কালো রঙের মধ্যে নীল ও সবুজের আবহ থাকে। আর স্ত্রী পাখির পিঠে বাদামির ওপর সাদা ও পীতাভ চিতি রয়েছে। ছেলে ও মেয়ে উভয় প্রজাতির চোখ টকটকে লাল এবং ঠোঁট আপেল-সবুজ।
ইনাম আল হক আরো জানান, এশীয় কোকিল বেশ চুপিসারে থাকে। ফলদ গাছ যেমন- ডুমুর ও অন্য রসালো ফল খায়। কখনো শুঁয়োপোকা ও ছোট পাখির ডিম খায়। মার্চ থেকে জুলাই এদের প্রজনন মাস। পুরুষ পাখি একটি মাত্র শব্দে তীব্র চিৎকারে বারবার ডাকে, ‘কো-এল’। কখনো কখনো স্ত্রী পাখিও উত্তরে ‘উক-উক-উক’ করে। এরা বাসা তৈরি, ডিম ফোটানো এবং ছানার যত্ন নেয় না। পৃথিবীতে এরা একটি মাত্র প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশে এরা বিরল নয়। পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিস্তৃতি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘কুহুকুহু সুরেলা ডাকের জন্য বিখ্যাত কাকিল। কোকিল বলতে আমরা যেটা বলি সেটার একটাই প্রজাতি রয়েছে। তবে আরো ৯-১০টা নিকট প্রজাতি আছে এর। কোকিলের স্বভাব হলো এরা অন্য পাখির বাসায় চুরি করে ডিম পাড়ে। এদের বাসা-পরজীবীও বলা যায়। এরা অভিনব কায়দায় ডিম পাড়ে। স্বাচ্ছন্দ্যে ডিম পাড়া যায় সে রকম একটি পোষক পাখির উপযুক্ত বাসা কোকিল দম্পতি খুঁজে বের করে। পুরুষ কোকিলটা আগে থেকেই ডিমের মধ্যে বসা পোষক পাখিটিকে বারবার বিরক্ত করতে থাকে।
বিরক্তির একপর্যায়ে ডিমে বসে থাকা পাখিটা ওই পুরুষ কোকিলকে ধাওয়া করে। এই সুযোগে স্ত্রী কোকিল ঝটপট ওই পাখির বাসায় গিয়ে একটা ডিম নিচে ফেলে দিয়ে নিজের একটা ডিম ওখানে পেড়ে আসে। কিছুদিন পর ওই ডিম ফুটে ছানা বের হয়। মজার ব্যাপার হলো, একসময় দেখা যায়, ডিম ফুটে যে ছানা বের হয় সেটি ওই পোষক পাখিটির চেয়ে আকারে অনেক বড়। এর পরও কোকিল ছানাটিকে লালন-পালন করে পোষক পাখিটি। প্রজনন মৌসুমে পোষক পাখিরা বুঝতে পারে না যে এটি অন্য ঘরের ছানা। কোকিলা প্রজনন মৌসুমে বেশি ডাকাডাকি করে। এরা বন, বৃক্ষভূমি, আবাদি জমি, গ্রামাঞ্চল, শহর ও রাস্তার ধারে বিচরণ করে। বন উজাড়, খাদ্য সংকট, পরিবেশ দূষণ নানা কারণে কোকিলের বংশবিস্তার এখন কিছুটা কমে আসছে।’
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের অধ্যাপক বারহেডের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী কোকিলের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, ডিম পাড়ার সময় হওয়ার পরও তা অতিরিক্ত সময় পেটে ধরে রাখার অসামান্য সক্ষমতার কারণেই কোকিল অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়তে পারে। ডিম পাড়ার চূড়ান্ত সময় হওয়ার পরও মা কোকিল আরো অতিরিক্ত ২৪ ঘণ্টা সময় তার গর্ভে ডিম ধরে রাখতে পারে।
গত বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত ‘বিহেভিয়ারাল ইকোলজি’ জার্নালে কোকিলের স্বভাব সম্পর্কে নতুন একটি তথ্য উঠে এসেছে। কোকিলের আচরণবিষয়ক ওই গবেষণার নেতৃত্ব দেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের ড. জাস্টিন ওয়েলবারজেন। ওই গবেষণায় জানানো হয়, অন্য পাখিদের ভয় দেখিয়ে তাদের বাসা থেকে তাড়ানোর জন্য কোকিল চালাকির আশ্রয় নেয়। তারা বাজ পাখিকে নকল করে অন্য পাখিদের ভয় দেখায়। এরপর পাখি বাসা ছেড়ে গেলে সুযোগ বুঝে ডিম পাড়ে কোকিল। এ ডিমে তা দেয় পোষক পাখি। পরে ডিম ফুটে ছানা বের হয়।
স্বত্বঃ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, শ্রীমঙ্গল/ দৈনিক কালেরকণ্ঠে প্রকাশিত
You must log in to post a comment.