বছর যখন আট কিংবা নয়, তখন মাবাবা ভারতের কোচবিহারে মামা বাড়িতে আমাদের নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন।আমরা যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম! ছেলেবেলায় নিজের বাড়ির বাইরে পা রাখার মানে ছিলো, অবাধ স্বাধীনতা! মায়ের শাসন থেকে ক্ষনিকের মুক্তি! কিন্তু খুশির বাঁধ ভাঙ্গলো একসময়, যখন দেখলাম মা আমাকে কোচবিহারে পড়াশোনার জন্য পাকাপোক্তভাবে রেখে আসছেন!কেনো জানি, বিচ্ছেদের শোক তখনো খুব বেশি আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি!কারন মামাতো বোনটা আমার ছিলো অন্ধভক্ত!আর আমি তার! সময় গড়াতে লাগলো, ছোট্ট আমি মায়ের শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম!সেই সাথে নতুন স্কুল,নতুন সংস্কৃতি, নতুন বন্ধুত্ব…….
সব মিলিয়ে স্বাধীন আমি, নিজেকে কোথাও যেনো খুঁজে পাচ্ছিলাম না!মা,আর ছোট্ট ভাইয়ের কাছ থেকে স্বল্প পরিসরের বিচ্ছেদেও আমি নিজেকে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর আপ্রান চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলাম!কঠিন সময়টায় মামার আদর করে মা ডেকে বুকে নেয়া খানিকটা শান্তির পরশ বুলাতো। জীবনানন্দ দাশের কবিতা “বনলতা সেন “এর লাইনটুকু যেন আমারই জন্য লেখা –“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।”
জীবন কতোকিছু শেখায়! কিছু পরাধীনতায় থাকে ভালোবাসার অমৃত স্বাদ!পরাধীনতার শেকল পড়ে কোচবিহারে আমাকে বেশিদিন থাকতে হয়নি, নয়মাসেক পর বাংলাদেশ ফিরেছিলাম।আহা মায়ের শরীরের গন্ধ,অনুজের স্পর্শ, আর শেকড়ের টান আমাকে আর কোচবিহারমুখী করেনি!কিন্তু আজও স্মৃতি অতল গর্ভের কোঠরে সামিয়ানা টানিয়ে বায়োস্কোপ দেখায়!দীপাবলিতে সারাবাড়ি জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো,আতশবাজি ফুটানো, আবির দিয়ে মহোৎসব, শাড়ী পড়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া,যেনো সেদিনকার কথা!তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে মায়ের জন্য গভীর শূন্যতা অনুভব আমাকে আজও কুঁকড়ে রেখে দেয়!জীবন আমাদের প্রতিনিয়ত শিক্ষা দেয়। এক একটা জীবন এক একটা বই।
কোনো কোনো কারনে মানুষ অতি তুচ্ছ বিষয়ে আবেগী!ছেলেবেলার মায়ের কাছ থেকে সাময়িকের জন্য বিচ্ছেদ মনে বড় দাগ কেটে গিয়েছিলো!এইযে বললাম,মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী!কখনো কোনো প্রবন্চ্ঞক বুকের এক দলা মাংস খুলে নিলেও ভাবে, যাক একবারই তো!অথচ সেই মানুষটাই কোন প্রিয় মানুষের দেয়া সামান্য কষ্টকে গভীর গোপন ক্ষতের মতো টেনে বেড়ায় আমৃত্যুকাল!
লেখকঃ বৈশাখী সাহা