অনেক বছর পর, গ্রামে সবার মুখে মুখে শুনি কীর্তনের কথা। বড় ঈদের চাঁদটা যখন ভর পুর্নিমায় ভাসিয়ে দেয় হাওর জনারন্য, হালকা কুয়াশার চাদরে ধনূ নদের বাঁকে নাথপাড়াতে তখন চলে কীর্তন। ননস্টপ ।কেউ বলে ৬৫ প্রহরের কেউবা বলে ৭২ প্রহরের,প্রহর গুনা গুনিপদ্ধতি নিয়ে এত ভাবিনা। তবে এটা জানি বিরতী হীন কীর্তন চলে টানা চার পাচ দিন। কি যে দারুন বাঁধ ভাঙ্গা অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলা স্বচক্ষে না দেখলে বোধগম্যতা কঠিন। একধারে কীর্তন আরেক ধারে বসে গ্রাম্য মেলা। সারারাত অবধি চলে কাঠের আসবাব পত্র থেকে শুরু করে –মোয়া, মুরকী, বাদশাহী খিলি পান, গুরের চা, ভাপা উঠানো পিঠা, ধর্মীয় পুথি পুস্তক, আলতা স্নো পাউডার এর বিকি কিনি।. চারদিক ওপেন সুন্দর স্টেজের চারপাশ ঘিরে বসে থাকে ভক্তকুল, অনতি দূরেরই কীর্তন কমিটির বসার ছাউনি। পাশেই স্থায়ী মন্দিরর সিঁড়িতে মহিলাদের বসার নিরাপদ স্থান। স্টেজের দুই পাশের খুটি তে লাগানো “চলিতেছে” আরেক খুটিতে “আসিতেছে” ঐ দুটো সাইন বোর্ডের কারনে অতি সহজেই বোঝা যায় কোন দল গাইছে আবার দু’ঘন্টা পর কোন দল গাইতে উঠবে। প্রত্যেকটি কীর্তন দলের নামেই অসম্ভব সুন্দর। নানা কারনে ভক্ত বৃন্দের কাছে মহিলা কীর্তনীয়া দল পুরুষ দলের চাইতে অনেকাংশেই জনপ্রিয়। প্রত্যেক দলেই দু একজন “স্টার” কোয়ালিটির থাকে, যেমন কোন দলে কর্তাল বা মন্দিরা বাদকের অংগ ভঙ্গীই “সেই রকম” , আবার কনো দলের বাঁশরীয়ার কাজ কারবার সাক্ষাত কৃষ্ণ কে হার মানিয়ে এলাকার অবিবাহিত কিশোরী রাধাদের মন চুরি করে পালানোর রেকর্ড ও আছে, বেশ কয়েকটি।

যাক, কীর্তন কমিটিতে যারা আছেন ওরা আমাকে রাতের প্রথম দিকেই কমিটির ছাউনি তলাতে নিয়ে যায়। আমার কিছু বাল্য বন্ধু কমিটির হর্তা কর্তা। ওদের কে অনুনয় বিনয় করে আমি চলে যাই ষ্টেজের একদম সামনের চাটাই সারিতে অতি সাধারন ভক্ত বৃন্দের মাঝখানে। মাঝে মাঝে কিশোরী কির্তনীয়া যখন স্টেজ ছেড়ে আমার পা’ এ গর প্রনামে নত হয়, আমি দারুন ভাবে লজ্জিত হই। কেউবা আবার তীর্যক চোখে মুচকি হাসে। আমি হেরম্যান হ্যাসার সিদ্ধার্থের কথা ভাবতে শুরু করি। রাত দ্বিপ্রহরে যখন মেলার কোলাহল মিলিয়ে যায়, বাদশাহী খিলি পানের লাইনটা যখন একদমই নেই হয়ে যায়, ঐ কাঠ ব্যাবসায়ী যখন সারাদিনের ক্লান্ত দেহটা অবিক্রিত ইজি চেয়ারে হেলিয়ে দেয়, আমি প্যান্ডেলের বাইরে

বেরিয়ে আসি। নদীর পার থেকে প্রতিধ্বনিত হওয়া কীর্তনিয়াদের সূরের মূর্ছনায় পাগল করা জোছনার বানে আমি ভেসে যাই নিরবধি।
রাত বাড়লে আমি আবার প্যান্ডেলের ভেতরে ঢুকি। পালার নির্ধারিত দুঘন্টার মধ্যে এক ঘন্টা পনেরো মিনিটের মাথায় শুরু হয় ক্লাইম্যক্স এর প্রথম ধাপ। রাত বাড়ার সাথে সাথে মূল (ভোকাল) কীর্তনিয়ার গলায় রাগের যাদু এসে ভর করতে থাকে। “হরে রাম, হরে কৃষ্ণের “ সুরে অক্টেভের কারিশ্মা ছুয়ে যেতে থাকে ভক্তকূলের হৃদয়তন্ত্রী। চোখ বেয়ে ঝড়তে থাকে নূহের দড়িয়ার বাধ ভাঙ্গা প্লাবন। বুকের ভেতর জমানো অনুশোচনা আর নৈঃস্বর্গিক পৃথিবীর মাকরশা মায়াজাল জড়ানো অমিমাংসিত ভাবনা গুলো উথলে উঠে বুকের পাঁজরে । সকল সম্প্রদায়ের ব্যবধানের গন্ডি পেড়ীয়ে মানব মানবীর আহাজারি ধনূ গাংগের দইর (পাড়) ভাঙ্গার শব্দের সাথে হাপরের মতো দুলতে থাকে ভক্ত নর নারী বৃন্দের হৃদয়ে। কোলাকুলি, গলায় গলায় জড়াজরিতে একে একে অপরের চরন ছুয়ে ধূলি মাথায় নেয়ার কি দারুন এক আন্তরিক বাসনার প্রতিযোগীতা! কীর্তনিয়াদের ধরে আসা গলায় অব্যক্ত কান্নার বেহাগ সুর, হাওরপারে মানব সম্প্রদায়ের চোখের নোনা অশ্রু তে একাকার হতে থাকে ধনূ গাঙ্গের জল। কির্তনের সাথে সঙ্গত করে চাপা কান্নার গোঙ্গানী।

আমিও তখন চোখের জলে অস্ফুস্ট গলায় বলতে থাকি- নিতাই! নিতাই!!

অনুমানেই আমি ধরে নিয়েছি “নিতাই” শব্দটার আভিধানিক অর্থ হবে প্রানের সখা, বন্ধু এমন জাতিয় একটা কিছু। অর্থটা প্রানের সখা, তেমন না ভাবলেও বন্ধু ভাবার কারন অবশ্য একটা আছে- বর্ষার আগটাতে বিদেশী (অন্য এলাকার)কাঠাল বিক্রেতারা আমাদের ঘাটে আসতো। আমি তখন আমার সদ্য কেনা ফুটবল টা বুকে ভর করে বর্ষার পানিতে ডুবন্ত প্রায় মাঠটাতে সাঁতরে উঠতাম আর যে ছেলেটি ঘুমন্ত কাঠাল ব্যাপারীর নৌকা থেকে অতি সন্তঃর্পনে মস্ত একটা কাঠাল চুরি করে, ডুব সাঁতারে ঝড় বৃষ্টির দিনে আমার খেলার সাথী হতো- ওর নাম ছিলো-নিতাই।

নিতাই আমার বছর তিন চারেক এর বড়। গড়ন গারনে বেশ তাজা। ও বল নিয়ে দৌড় দিলে ওর মুখাপেক্ষি হওয়া ছিলো দুস্কর। নিতাই বন্ধু মহলে “গাবর নিতাই” নামে পরিচিত ছিলো বেশী। কেনো জানি শেষের দিকে আমি নিতাই এর চেয়ে ওর দাদা’র প্রতি বেশী উৎসুক হয়ে পরি। নিতাই এর দাদার নাম ছিলো ভজ সাহা, গ্রামের লোকে বলে ‘ভজা’, বেশ ফর্শা লোকটা দাড়ি গোঁফে একাকার; অযত্নেই হউক, আর খাবার তরকারীর গুনেই হউক দাড়ি , গোঁফ হলুদ বর্ন ধারন করেছে। মাথার পেছনে ঝুলে থাকা শণ পাটের মতো লম্বা চুল দেখে বেশ বোঝা যায় যৌবনে ছিলো মাথা ভর্তী ঝাকড়া চুল। বয়স ভাজের মুখটাতে চোখদুটো ছিলো বেশ গভীরতায় ভরা ,উদার। লোকজন বলতো ভজা শতবর্ষী, আমার ছেলেবেলার গানিতিক ধারনাতে আশি’র কোঠায়। জেনেছিলাম ভজা নাকি সেই বৃটিশ আমলে হাফ প্যান্ট পরা, লাঠী হ্যারিকেন হাতের জাঁদরেল চৌকিদার ছিলেন।

একটা ছোট কল্কীর গোরার দিকে এক টুকরা ন্যাকরা পেচিয়ে অতি সযত্নে গাঁজা টানতেন আর খুক খুক করে কাশতেন ভজা। নিম্নাংগে পরিধেয় যে এক টুকরা কাপড় থাকতো আঞ্চলিক ভাষায় তা ছিলো “ন্যাংটী”নামে খ্যাত। নিজের সাথেই কথা বলতেন সবসময়ই । শুকনো মৌসুমে ভজা ছিলো আমাদের টীমের খেলার একজন নিয়মিত দর্শক, যদিও আমি বুঝতাম না, খেলা দেখা, না নিতাই দেখা ছিলো ভজার মূল উদ্দ্যেশ্য।

মাঝে মধ্যে ভজার কাছাকাছি গিয়ে বসলে দেখতাম পায়ের (উপরি) উপরে বসে ন্যাকরা পেচানো কল্কি টানছেন, খুক খুক কাশতেন। কখনো সখনো, করজোড়ে হস্তবন্দী কল্কীটা প্রনাম ভংগীতে কপালে ঠেকিয়ে গোড়াটা গালের দাঁড়িতে মুছে চোখ বন্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলতেন – “দে একটা দম”।

আমার সাথে ভজার সখ্যতায়, নিতাই তেমন ভাবে না। বরং যেচেই বলে “ আরে দাদা তো পাগল, এক সময়ে নাকি ভালো সাধু ছিলো; লোকজনদের নাকি যা বলে দিতো তাই হতো”, নিতাই এর বাবা আসন সাহা, ভজা কে বেশি পছন্দ করতো না। কারনটা আমি অনেক পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম।

হাওরের উত্তরে “ হাত্তির শূর” (টর্নেডো) নেমেছে। নিকষ কালো হয়ে আসছে চার দিক। জানতে পারলাম, গেলো রাতে হটাত করে প্রলাপ বকে বকে দেহান্তরিত হয়েছেন ভজা। দৌড়ে যাই বাড়ির কাছের নৌকা ঘাটে শেষ বারের মতো ভজার মুখটা যদি দেখতে পাই। ধীরে ধীরে শববাহী দলটা নৌকাতে উঠে। কি আশ্চর্য!! রিতীনুযায়ী চাঁটাই দিয়ে মোড়ানো ভজার মৃতদেহ কই! দেখলাম একটা পুরনো মুখ বাঁধা ছালা’র বস্তা। বস্তার সাথে বাধা ভারি কিছু পাথর, আর একটা অনেক পুরানো নোঙ্গর। সবার মাঝে কি যেনো অসম্ভব তরি ঘরি- বুক ফাটা চিতকারে জিজ্ঞাস করতে চাই –আমি ভজাকে একটু দেখবো, একটু দেখবো। ততক্ষনে “হরি বল হরি বল” আর খোল কর্তালের আওয়াজে শববাহী নৌকা ভেসে চলে ঘূর্নায়মান স্রোতের অনুকূলে। হু হু করা বুকটা নিয়ে আমি তীরে দাঁড়িয়ে থাকি।

অনেক গুলু বছর জানতে পারি, একমাত্র সন্তান আসন সাহা্’র সাথে ভজার আজীবন বৈরীতা এবং সমাজে ভজা অপরাধ বৃত্তান্ত। যদিও ভজা জন্মসূত্রে সনাতনী ছিলেন, কিন্তু নিয়মিত পূজা পার্বন হিন্দু ধর্মীয় আচার আচরনে তাঁর উপস্থিতি ছিলো খুবি নগন্য। নামে মাত্র। দৈবাত ভজাকে দেখা যেতো, বন্ধু বান্ধবের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে বা নাতিবয়সীদের বিয়ে ,বৌভাতে। সূফী সাধকদের সাথে ভজার নাকি ছিলো দারুন সখ্যতা। উঠাবসা, অহর্নিশী সুফীদের সাথে, দরাজ গলাতে গেয়ে বেড়াতেন, দেহত্বত্ত, মারফতি, মুর্শিদী্‌ -গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। ভজা জীবদ্দশাতেই আঁচ করতে পেরেছিলেন রক্ষনশীল হিন্দু সমাজে তার শেষ কৃত্য হতে পারে প্রশ্নের সম্মুখীন। তাই নাকি সেই ঝড়ের রাতে মৃত্যুর আগে পাগল প্রলাপের মাঝেও বলেছিলেন “ আমার কাষ্ঠ নিয়া তোমরা চিন্তা কইরো না ,ঝড় বাদলের রাইতে শ্মসানে আগুন জ্বলানোও কঠিন, আর মানব দেহ পোড়া, পুতাতে কি বা পার্থক্য? বাসী মরারে (মৃতদেহ) একটা বস্তাতে ভইরা, অনেক দিন আগে যৌবন বয়সে গাঙ্গের পারে পাওয়া গেরাফীটা (নোংগর) আমার পা’য়ে বাইন্ধা -আমারে নিমজ্জন দিও ধনূ গাঙ্গের জলে … কই গেলিরে…নিতাই, ও নিতাই…।