কিশোরগঞ্জের সাংবাদিক মারুফ আহমেদ সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেসবুকে একটি স্টেটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি ‘মফস্বল’ সাংবাদিকদের চরম শ্রমশোষণ ও বঞ্চনার কথা বলেছেন। লেখাটা পড়ে গ্রাম-জনপদের ‘অপাংক্তেয়’ সংবাদকর্মীদের নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু ভাবনা জাগল।
সাংবাদিকদের মধ্যে অনৈক্য আছে, এটা ঠিক। আছে দল-উপদলে বিভক্তি। এছাড়া আঞ্চলিক নানা সমস্যা তো আছেই। আমরা জানি যে, বেশিরভাগ প্রেসক্লাবই অসাংবাদিকদের দখলে। কথিত ওইসব সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ আবার বেশ প্রভাবশালী। জেলা-উপজেলার বড় কর্তাদের প্রিয়ভাজন হয়ে থাকেন এঁরা। আলাদিনের দৈত্য এঁদের হাতের মুঠোয়। চাহিবামাত্র হাতের নাগালে সবই। ‘সাংবাদিক’ হিসাবে নাম-যশ-খ্যাতিই এঁদের আরাধ্য। তবে এঁদের একটি অংশ বড়জোড় আলু-পটল ব্যবসায়ী হতে পারতেন।
অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো সাংবাদিক সংগঠন আছে। তবে সভ্যদের মূল কাজের ক্ষেত্র নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকে আখের গোছাতে ব্যতিব্যস্ত। আরেক দল পদলেহনকারী, চাটুকার, চরম সুবিধাবাদী ও স্বার্থভোগী। এতে নগদ প্রাপ্তিলাভ আছে। গুরুত্বপূর্ণ নানা পদে তাঁরা আসীন হন। ওইসব সাংবাদিক গাছেরটা খান, গোড়ারটাও কুড়ান। অন্যদের রুটিরুজি নিয়ে চিন্তা করার সময়-সুযোগ কোথায়! (কেউ কেউ অবশ্য সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষায় অল্পবিস্তর কাজ করেন। নিষ্ফল সে কাজকে তো আর ‘কাজ’ বলা যায় না!) আমি মনে করি, সাংবাদিকদের ন্যায্য অধিকার না পাওয়ার জন্য অনেকটাই দায়ী অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গড়া কিছু সংগঠন।
আরেকদল আছেন, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষায় তাঁরা নিয়োজিত। মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিক ছাঁটাই, বেতন-ভাতার ‘অপচয়’ রোধ, একই সঙ্গে বেশি কাজ আদায়ের পলিসি মেকার তাঁরা। ‘কম তেলে মচমচে ভাজা’ আদর্শের ওই সাংবাদিকদের আবার বিস্তর সুবিধা। আজ্ঞাবহ-তোষামোদকারী সেই সাংবাদিকরা মালিকপক্ষের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। এঁদের বেতন-গ্রেড ঠিকই বাড়ে। অল্প বেতনে ঘাম ঝরানো, শরীর খোয়ানো অভাজন সাংবাদিকের দায় এঁরা নিতে যাবেন কেন!
ভুলে গেলে চলবে না যে, গণমাধ্যমে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে আনেন সেইসব ‘মফস্বল’ সাংবাদিকরাই। তার ভিত্তিতেই নির্দিষ্ট কাগজ বা চ্যানেল দেশ-বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়। কিন্তু তাঁদের ঘরের খবর কেউ রাখে না। ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন দূরের কথা, বাস্তবতার নিরিখে বেতন-ভাতাও দেওয়া হয় না। যে কারণে বাধ্য হয়েই অনেকে ভুল পথে পা বাড়ান।
কিছু সৌভাগ্যবান সাংবাদিককে ওয়েজবোর্ড দেওয়া হয়। বেশিরভাগ সাংবাদিককেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। সাইনবোর্ড হিসাবে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি পরিচয়পত্রমাত্র। মারুফ আহমেদ এটা যথার্থই বলেছেন। আমার প্রশ্ন, ওয়েজবোর্ডধারীরাও কি ওয়েজবোর্ডের যথাযথ মর্যাদা পান? না, অনেকক্ষেত্রেই তা পান না। এখানেও ফাঁকি।‘বড়’ প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা মেনে চলে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবাদিকদের সপ্তম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করে। পঞ্চম ওয়েজবোর্ডধারীরা এতে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। বর্তমান সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় এসে সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট হয়। অষ্টম ওয়েজবোর্ড দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বছর পার করলেও শেষে ঘোষণা করে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো অষ্টম ওয়েজবোর্ড পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করলেও এদিকটায় সরকারের নজরদারি আছে বলে মনে হয় না। আশার কথা, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অনেকেই সমাজচেতনার আদর্শ লালন করেন। এখনো খোঁজ নিলে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কাঁধে ঝোলা নিয়ে জীবনপাত করা সেইসব সাংবাদিকদের চোখে পড়বে। মানবাধিকার রক্ষায় এঁরা নিজ যৌবন বিনিয়োগ করেছেন। অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার, এসব সাংবাদিকের মানবাধিকার নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না, কথা বলছে না।
সমাজের সবচে অগ্রসর অংশের পেশা সাংবাদিকতা। আত্মমর্যাদা নিয়েই তাঁরা কাজ করতে চান। অথচ তাঁদের করুণার চোখে দেখা হয়। কেউ কেউ তাঁদের ‘দুঃস্থ’ বলবার দুঃসাহস দেখায়। ঘটা করে ‘অনুদান’ দিয়ে প্রশংসা কুড়াবার সুযোগ খোঁজে। কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এমনটি সম্ভব হচ্ছে বলে আমি মনে করি। তবে এটাও সত্য যে, ‘ঢাকার বাইরের’ গিনিপিগ সাংবাদিকদের সর্বদা চাকরি হারানোর ভয় তাড়া করে ফিরে। যে কারণে প্রতিবাদ হয় না।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক কিছুই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শোষণ করা হয়েছে জীবন-যৌবন। আদর্শের ধ্বজা আর তকমায় উদর পূরছে না। এদিকটায় একটু তাকান। দেখুন, ধেয়ে আসছে লালচে আভা। ঘটে যেতে পারে অঘটন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সামনেই যেতে হয়…।
বসন্তপুর
২ মে, ২০১৫।