নরসুন্দার বুকের উত্তাল ঢেউ আজ অনেকের কাছে শুধুই অতীত। এমনকি এর অনেক স্মৃতিচিহ্নও আজ অবৈধ দখলদার আর ভূমিদস্যুদের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। কিশোরগঞ্জের পরিবেশপ্রেমী মানুষের নরসুন্দা নদী উদ্ধারের আন্দোলন আর দাবির প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের হস্তক্ষেপে কিশোরগঞ্জ শহরকে লেকসিটি হিসেবে গড়ে তোলা এবং পুরো নরসুন্দা নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে খনন করার জন্য ‘নরসুন্দা নদী খনন ও শোভাবর্ধন (লেকসিটি) নির্মাণ’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সূত্র অনুযায়ী, ৩২ কি. মি. দীর্ঘ ও ৯০ ফুট প্রশস্ত নদী খনন কাজ শুরু হওয়ায় নতুন প্রজন্ম ফিরে পেতে যাচ্ছিল রূপকথার নদী নরসুন্দা। আর যখন নরসুন্দা পুনরুদ্ধার করে বিনোদনপিপাসু মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে এবং কিশোরগঞ্জ শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মরা নরসুন্দা নদীটি অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করে নদীর পানি প্রবাহ সৃষ্টির লক্ষ্যে নদী খনন ও শোভাবর্ধনের কাজ চলছিল। এটিও আজ প্রভাবশালীদের প্রভাব ও দখলের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ৬৩ কোটি টাকার মধ্যে ৩৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার নদী খননে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭ কোটি টাকা। বাকি ৪৬ কোটি টাকা অর্থ শহর অংশে চারটি সেতু নির্মাণ, চারটি ঘাট স্থাপন ও নদীর দুই পারে সড়ক নির্মাণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল।
নদী খননের প্রায় ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি আছে নদীর পাড় নির্মাণকাজ। কিন্তু শহর অংশে নদীর পাড়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্থাপনা থাকায় তাদের চাপে শহর অংশের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। শহরের বত্রিশ এলাকায় সাড়ে তিন কোটি টাকার শোভাবর্ধন সেতুর অ্যাপার্টমেন্ট ও দুটি পায়ার বোয়িং কাজ করা হয়েছে মাত্র। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পাওয়ার পর কাজও শুরু হয়েছিল। বর্তমানে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। এলাকার অবৈধ দখলদার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষের দাবি, যে কোনো মূল্যে প্রশাসনকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শহর অংশে প্রভাবশালী ও ভূমিদস্যুরা নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করায় নদীর দুই পাড়ে সড়ক নির্মাণের কাজও বন্ধ হয়ে আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, একরামপুর সেতুর ডান পাশের বিশাল ভবন, বড়বাজার এলাকায় কয়েকটি ইমারত, গৌরাঙ্গবাজার থেকে আখড়া বাজার পর্যন্ত ২০টি ভবন না ভাঙা গেলে মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
এদিকে শহর অংশে দুই পাড়েও সড়ক নির্মাণ করতে হলে একরামপুর সেতু সংলগ্ন মা ও শিশু ক্লিনিকের ভবন, পুরনো থানা, বড়বাজার, গৌরাঙ্গবাজার ও স্টেশন সড়কে মালিক সমিতির ভবনসহ কিছু স্থাপনা ভাঙতে হবে। পৌর কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। আমাদের প্রশ্ন হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে যদি স্থাপনাগুলো ভাঙতেই হয়, তাহলে এ বিলম্ব কার স্বার্থে? প্রভাবশালী আর দখলদারদের দৌরাত্দ্য কি প্রশাসনের চেয়েও বেশি? কিন্তু বর্তমানে প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষ কার্যকর ভূমিকা না নেওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কাজটি বন্ধ করতে ইতোমধ্যে অর্থ বাণিজ্য শুরু করেছে। অবশেষে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন, আমরা এ প্রকল্পের সফলতা দেখতে চাই, আমরা আমাদের নরসুন্দার অতীত স্মৃতি ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বিনোদনের স্থানটিকে ফিরে পেতে চাই। আমাদের আশংকা, দ্রুত প্রশাসনের ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা না নিলে, সামান্য অবহেলায়ই প্রকল্পটি শীঘ্রই অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।