hit-xxxপ্রথম বিশ্বযুদ্ধ। পরাজিত-বেদনাহত-ক্লান্ত জার্মানি মুখথুবড়ে পড়ে আছে। সম্মুখযুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হয়নি। জার্মানির পরাজয়ের কারণ ঘরের শত্রু বিভীষণ। আর সেই বিভীষণের দল হলো ইহুদি সম্প্রদায়। তার সঙ্গে আছে বুলিসর্বস্ব কিছু মার্কসবাদী। তারা পেছন থেকে দেশকে ছুরি মেরেছে। সুতরাং দেশকে দাঁড় করাতে হলে সবার আগে তাদের সমূলে উৎপাটন করা দরকার  এমন ধারণা নিয়েই ১৯২০ সালে জার্মান ইতিহাসে আবির্ভূত হয় একটি দল, যার নাম ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’। বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় ‘নাৎসি পার্টি’। এডলফ হিটলার ছিলেন দলটির প্রধান। নাৎসি পার্টির উত্থানে যেমন ছিল চমক এর পতনেও বিস্ময়ের কমতি ছিল না।

হিটলার

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের চরম লাঞ্ছনা মিলল ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে। রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা, অর্থনৈতিক দুর্যোগ, সব মিলিয়ে জার্মানিতে তখন বিরাজ করছিল চরম অরাজক অবস্থা। ১৯১৯ সালে ন্যাশনাল জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি নামে একটি দলের উত্থান ঘটল গুপ্তভাবে। হিটলার তখন যুদ্ধফেরত সামান্য এক জার্মান সৈনিক। সদ্যগঠিত ওয়ার্কার্স পার্টির একটি টিমটিমে মোমবাতির মতো তার ক্ষীণ আলো বিকিরণ করছে। মাত্র সাড়ে সাত মার্ক দলের মূলধন। এই দলে ভিড়ে গেলেন হিটলার। দলীয় সম্পৃক্ততা তাকে এনে দিল কার্যকরী সভার সাত নম্বর সদস্যপদ। আস্তে আস্তে দলের সব কর্তাব্যক্তির ওপর হিটলারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করল। হিটলারের নিত্যনতুন উদ্ভাবনী শক্তিতে মরচে ধরা মানুষগুলো যেন গতিশক্তি ফিরে পান। ১৯২০ সালে হিটলারের উদ্যোগে দলের নাম সামান্য পরিবর্তন করে রাখা হলো, ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা ‘নাৎসি পার্টি’। ১৯২১ সালে দলের চেয়ারম্যান হলেন হিটলার। অগি্নময় ভাষায় বক্তৃতা আর মৌলিক পরিকল্পনার সাহায্যে জনসাধারণের এক বিরাট অংশের কাছে পৌঁছে গেলেন হিটলার। এদিকে জেলখাটা খুনি, মদ্যপ, জুয়াড়ি আর লম্পটদের নিয়ে গঠিত হলো নাৎসি দলের ঝটিকা বাহিনী। অন্য রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ পণ্ড করা আর রাজনৈতিক গুপ্তহত্যাই ছিল এ বাহিনীর প্রধান কাজ। ১৯২৩ সালে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি বাহিনী ‘বিয়ার হল ক্যু’ পরিচালনা করে। কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হলে হিটলারের ঠাঁই হলো জেলে। ৯ মাস জেল খেটে প্যারোলে ছাড়া পেলেন। জেলে বসে হিটলার লিখেন তার বিখ্যাত বই ‘মাই ক্যাম্প’। এ সময় নাৎসি বাহিনীতে বিরাজ করছিল চূড়ান্ত সাংগঠনিক দুর্বলতা।

১৯২৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে নাৎসি দল ৪৯১টি আসনের মধ্যে মাত্র ১২টি আসন লাভ করে। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হলেও পার্লামেন্টে নাৎসি দলের আধিপত্য ছিল না। ১১টির মধ্যে মাত্র ৩টি মন্ত্রণালয় পেল নাৎসিরা, তাও আবার একটি দফতরবিহীন মন্ত্রী। একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে নাৎসিরা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকে। রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী গঠনের নামে প্রায় ২০ হাজার নাৎসি সদস্য ঢুকে পড়ে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীতে। পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের জন্য আরেকটি চূড়ান্ত নির্বাচন দরকার। সব শক্তি নিয়ে নাৎসিরা নেমে পড়ল ভোটযুদ্ধে। তৃতীয় রাইখ সরকার গঠনের প্রাক্কালে ‘ল অব ইনাবলিং’ পাস করিয়ে হিটলার অর্জন করেন চরম ক্ষমতা। নাৎসি ব্যতীত জার্মানির অন্যসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হলো। ‘হেইল হিটলার! হেইল হিটলার!’ রবে অভিনন্দিত করা হলো বর্বর রক্তপিপাসু হিটলারকে।

প্রেসিডেন্ট হিন্দেনবার্গের মৃত্যুর এক ঘণ্টার মধ্যে হিটলার প্রেসিডেন্টের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিলেন। হেইল হিটলার হলেন জার্মানির সর্বেসর্বা। ‘এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা!’ নাৎসিদের এ স্লোগানকে ধারণ করে হিটলার হয়ে উঠলেন ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন স্বৈরশাসক। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরাজয়ের পর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বৈরশাসকও চিরবিদায় নিল। হিটলারকে ছাড়া অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলল নাৎসি পার্টি। পরবর্তীতে সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা হলেও ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯২০ সালে যে ধূমকেতুটি জার্মান আকাশে আবির্ভূত হয়েছিল, ১৯৪৫ সালে সেটি ঝরে পড়ল ধূমকেতুর গতিতেই। শুধু এই দুরন্ত কাহিনী বুকে ধরে রয়ে গেল মহাকাল, ইতিহাস।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ইউটিউব