স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠ শিল্পী বিপুল ভট্রাচার্যের মৃত্যুতে শোকাহত তাঁর জন্ম ভূমি কিশোরগঞ্জ। তথা জেলা সদরেরর মহিনন্দবাসী। যার কন্ঠে ১৯৭১ সালে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গানে গানে ছড়িয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মাইলের পর মাইল হেঁটে যিনি গেয়ে ছিলেন দেশ ও প্রিয় মাতৃ ভূমি রক্ষার জয় গান। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে যার কন্ঠে প্রচারিত গাওয়া গানগুলো মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। যেই মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার মানুষের মনে সাহস সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর মৃৃত্যু খবর ছড়িয়ে পড়লে কিশোরগঞ্জের সর্বত্রই নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। আমাদের মহিনন্দের ইতিহাস বইটির জন্য শিল্পী বিপুল ভট্্রাচার্যের জীবনী লিখতে গিয়ে তাঁর সাথে বেশ কয়েকবার ফোনালাপ হয়েছিল। তাঁর তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল গ্রন্থের জন্য। সে সময়ে তিনি বলতেন, ঢাকায় আস। আমি আসব বলে আর আসা হল না। তবে আমি যখন (শনিবার) এলাম আর তাঁকে জীবীত দেখতে পেলাম না। শহীদ মিনারের পাদদেশে তাঁর মরদেহের প্রতি ফ্যাল ফ্যালিয়ে আকিয়ে চোখের পানির জলই শুধু ঝড়ল। কথা হতো মোবাইলে , কিন্তু দেখা হল না । আজ দেখা হলো কথা হল না । কারণ এসময়ে এই জগত পারি দিয়ে পরপারে চলে গেছেন। আর কখনও দেখা হবে না।

তাঁর জন্ম স্থান মহিনন্দ ইউনিয়নবাসীর পক্ষে এবং জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা কিশোরগঞ্জ জেলা ইউনিটের পক্ষ থেকে সংস্থার কিশোরগঞ্জ সদর ইউনিটের সভাপতি ও মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি হিসেবে শনিবার সকাল ১১ ঘটিকায় ঢাকার কেন্দ্রেীয় শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ভারাকান্ত হূদয়ে শোক বহিতে স্বাক্ষর করলাম।

বিপুল ভট্টাচার্য ১৯৫২ সালের ২৫ জুলাই কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের ভাটোয়াপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। গত শুক্রবার সকাল নয়টা ২৫ মিনিটে ধানমন্ডির আহমদ মেডিকেল সেন্টারে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শিল্পীর বয়স হযছিল ৬১ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়েসহ অনেক ভক্ত ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী বিপুল ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেন। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান রাষ্ট্রপতি।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোকবাণীতে বলেছেন, যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন, বিপুল ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।

বিপুল ভট্টাচার্যের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পডলে রাজধানীরসহ কিশোরগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছাযা নেমে আসে। তাঁকে দেখার জন্য তাঁর সহকর্মী, বন্ধুসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষ হাসপাতালে ও তাঁর বাসভবনে ছুটে আসেন। বিপুল ভট্রাচার্যের মৃত্যুতে শোক বাণী দিয়েছে কিশোরগঞ্জ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ, করিমগঞ্জ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ, তাড়াইল প্রেস ক্লাব, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা তাড়াইল উপজেলা ইউনিট, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা করিমগঞ্জ উপজেলা ইউনিটসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।

শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শিল্পীর মরদেহ রাখা হলে হাজারো মানুষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এরপর সেখান থেকে নেওয়া হয় পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে। সেখানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

২০১০ সাল থেকে বিপুল ভট্টাচার্য ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিলেন। সম্প্রতি শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁকে আহমদ মেডিকেল সেন্টারে স্থানান্তর করা হলে সেখানেই তার মুত্যু হয়।

শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার মানুষের মনে সাহস সঞ্চার করেছিলেন তিনি। মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্য ছিলেন বিপুল। তিনি বাংলা গণসংগীত ও লোকগানেও রেখেছেন বিশেষ অবদান। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ পরিচালিত মুক্তির গান চলচ্চিত্রের ১১টি গানের মধ্যে ১০টিই তাঁর গাওয়া। বিপুল ভট্টাচার্য গান গেয়ে ও শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

তিনি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ের দিনে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক রথখলা ময়দানে“পাকিস্তানিদের শাসন মানি না মানব না, মিলিটারিদের মানি না মানব না” গানটি গেয়ে জেলার বিজয় নিশান উড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিশোরগঞ্জে সফরে গেলে এই গুণী শিল্পীকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং স্বাধীনতার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

লিখেছেনঃ আমিনুল হক সাদী, লেখক ও গবেষক, কিশোরগঞ্জ।
ফোনঃ ০১৭২৪৯৯৪৫৮৫