পানি, প্রাণ, পাখি, গান বা ধান ও মাছের দ্যাশ হিসাবে খ্যাত সাড়ে আট হাজার বর্গ কিলোমিটরের দুই কোটি লোকের বসবাস হাওর ভাটি বাংলায় বছরে ছ’ মাস- বর্ষায় থাকে পানির নীচে, আর বাকী ছ’ মাস শুকনা, শুষ্ক মেীসুম। বর্ষায় যেখানে চারিদিকে শুধু পানি আর অথৈ থৈ-থৈ পানি, শুকনায় সেখানে সবুজের সমারোহ, বিল, ঝিল, নদীর তলানীতে জমে থাকা ক্ষীণ জল ধারা। বিরাট, বিশাল বৈপরিত্য। দেখে বুঝার কোন উপায় নাই যে, একদা এখানে সমুদ্র সম পানি ছিল। যেখানে অকাল বন্যার আগ্রাসন, সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সেখানেই আবার পানির আকাল। ফাল্গুণ চৈত মাসের অবস্থা, পানির আভাব, খরা, পানির জন্য হাহাকার, বাস্তবে চর্ম চক্ষুতে না দেখলে অবিশ্বাস্য। জলের দেশে জলের জন্য হাহাকার, কারবালা। আল্লাহর এ লীলা বুঝা বড় ভার। পানির এক নাম জীবন, আবার এ পানির অপর নাম মরণ। হাওরের মত এটির বাস্তব উদাহরণ হয়ত আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না ।
বর্ষার সময় ভারত থেকে ২৪টি নদী-নালা দিয়ে হাওর এলাকায় প্রচুর বৃষ্টির পানি প্রবেশ করে। ঐ সময় এক সাথে সব পানি একটি মাত্র নির্গমন পথ-ভৈরব সেতুর নীচ দিয়ে প্রবাহ হতে না পেরে হাওরের নীচু ভূমিতে জমা হয়ে সাগর বা হাওরের রুপ থারণ করে। বর্ষা শেষে হাওরের নদী নালায়, বিল ঝিল আর খাল ডোবার তলানীতে জমে থাকা কিছু পানিই হচ্ছে শুকনো সময়ের জলের উৎস। উজান থেকে নেমে আসা নদীর ক্ষীণ ধারা আর সমুদ্রের জোয়ার ভাটার টান হাওরে পানি প্রাপ্তির উপর প্রভাব ফেলে। এসব পানিই হচ্ছে হাওরবাসির জীবন জীবিকা, কৃষি, যোগাযোগ ও গৃহস্থালি কার্যক্রমের একমাত্র উৎস। পানির এসব উৎসকে কেন্দ্র করেই হাওরের বিভিন্ন স্থানে জনবসতি গড়ে উঠেছে। আবার পানির অভাবে বিবর্তন ঘটছে, বাড়ছে অভিবাসন। বিয়ে শাদী, বিনোদন, বা আত্বীয়তা নির্ভর করে পানির প্রাপ্যতার উপর।
প্রকৃতি, জলবায়ু ও জৈবিক বিবর্তনে হাওর ভাটি বাংলায় পানির এ সব উৎস আজ মৃত প্রায়। বর্ষায় এ পানি যেমন হাওরবাসির জন্য আপদ, শুকনায় পানির অভাবে তাঁদের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত, সব কিছু থেমে যাওয়া অবস্থা। এ পানিকে আমরা এখনও সম্পদে পরিণত করতে পাার নাই । চারিদিক হতে খননকৃত এ সব ডোবার মাটি দিয়ে সাধারণ ভূমি হতে ১০-১৫ ফিট উচুঁ করে হাওরে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ভিটা-গ্রাম তৈরী করা হয়েছে। হাওরের প্রত্যেকটা জনবসতির সাথে নিজস্ব পানির উৎস ছিল। বিশাল এ হাওর এলাকায় গ্রামগুলোর প্রায় কয়েক লক্ষ বিল, ঝিল, প্রকুর, ডোবা, খাল, গর্ত আছে। এ গর্তগুলোর পানি হাওরবাসি শুষ্ক সময়ে তাঁদের নিত্য ব্যবহার্য গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করে। কিন্তু এ সব গর্ত/জলাশয়/ উৎসে ভরাট, মুজে, চাষে বা নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। এ পানি আবার ব্যবহার হচ্ছে কৃষি কাজে। হাওরের গো-পাট/গো-চারণ ভূমিগুলো উফশী ধানের সবুজ নয়নাভিরাম দৃশ্যে ভরে উঠেছে। ফলে পানির ব্যবহার বেড়েছে অনেক গুণ। বিপরিতে পানি প্রাপ্তির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমেছে। নদীতে আর আগের মত পানি আসে না, ভরাট হয়ে পানি ধারণ ক্ষমতাও অনেক কমে গিয়েছে। অপর পক্ষে কৃষি বিশেষত উফশী ধান চাষে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। শুনে আর্শ্চর্য হবেন যে, এক কেজি চাল উৎপাদন করতে প্রায় তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে হাওরের রক্ত নালীসম অসংখ্য খাল/শাখা নদীতে বাধঁ দেয়ায় পলি পরে ভরাট করে ”বাচাঁর জন্য মরণ ফাঁদ” তৈরী করা হয়েছে।
ফলে হাওরের নদীর শাখা, প্রশাখা বা জলাশয়ের পাড়ে গড়ে উঠা জীবন যাত্রা পানির অভাবে সবচেয়ে ব্যহত হচ্ছে। হাওরে দীর্ঘ খরা তা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বাড়ির পাশের ডোবা, পুকুর শুকিয়ে গেছে, নদীতেও পানি শূণ্য। সারা রাত ঝির ঝির করে নদীর তলায় জমে থাকা পানি সকালে পাম্পের সাহায্যে টেনে তুলে জমিতে দেয়ার চেষ্টা চলে। ডবল সেচও কখনো কখনো দিতে হয় । এতে খরচ বেড়ে যায় কয়েক গুণ । সেচ নালার বাঁকে বা গর্তে কিছু পানি জমে থাকে। এ পানিই হচ্ছে ফাল্গুণ চৈত্র মাসে অধিকাংশ হাওরবাসির গৃহস্থালি, নিত্য ব্যবহার্য, রান্না , গোছলের পানির উৎস। মগ দিয়ে পানি নিয়ে তাঁরা ’ কাক গোছল’ কোন রকমে সারেন। কোন কোন মহিলা সপ্তাহেও পানির অভাবে গোছল হয় না। পানের জন্য টিউবওয়েল পানি ব্যবহার করলেও রান্নায় সেচ নালার পানিই ভরসা। টিউবওয়েল পানি নাকি রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায় না। কোন গ্রামে অপর্যাপ্ত/ অল্প সংখ্যক পুকুর থাকলেও ভরাট হওয়ায় বা অতি ব্যবহারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পরে। মানুষ পশু এক ঘাটে ব্যবহার করে । এ অবস্থায় চারিদিকে রোগ বালাই, চর্ম রোগের বিস্থার ঘটে। ঘাসের অভাব; গো মড়কও দেখা দেয়। সবচেয়ে বেশী ভোগান্তিতে পরে মহিলা ও শিশুরা। জলবায়ূর পরিবর্তন ঘটছে। আগের দিনে জনদরদী জমিদার বা একান্নবর্তি পরিবারগুলো নিজস্ব উদ্যোগে পুকুর বা দীঘি খনন ও মেরামত করতো। এখন একক পরিবারগুলোর সে আর্থিক অবস্থা না থাকায় নতুন পুকুর খনন তো দূরের কথা, পুরোনোগুরোই সংস্কার করতে পারছে না। পানির দেশে পানির এ হাহাকার লজ্জাজনক।
হাওর ভাটি এলাকার অভার, নিদাণ বা ক্রান্তিকাল হচ্ছে ফাল্গুণ-চৈত মাস। বর্তমান সরকারের এ সময়ে কর্মসংস্থান সৃজন কর্মসূচীর অধীনে জরুরীভাবে পুকুর ডোবাগুলো খনন করা যেতে পারে। সরকার, এনজিও, আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে আমার আবেদন, দয়া করে হাওরে, গ্রামের পাশে অবস্থিত হাওরের আধার.বা পানির উৎস্য কয়েক লক্ষ বিল, ঝিল, পুকুর, ডোবা, নালাগুলো খনন করুন । সেই সাথে নদীগুলো খননই হাওরে জীবন ধারণ উপযোগী পরিবেশ বজায় রাখতে পারে। ফলে নিত্য ব্যবহার্য পানির অভাব পূরণ হবে, কৃষি, মৎস্য, প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষা পাবে এবং বন্যা বিলম্বিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পানির ছোবল মারাত্বক ও ভয়াবহ, পানি নিয়ে অবহেলা নয়। কত জনপথ, সভ্যতা ও ঐতিহ্যেও বিলুপ্ত হয়েছে পানির কারণে। হাওর “পানি উদ্যান” সম এ জলাশয়ে পানি থাকতে না দিলে সেও তার পাড়ে কাউকে থাকতে দিবে না, এটাই বাস্তব ও সত্যি।