১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টি প্রতিষ্টার পর ঐ বছরই বোম্বেতে অনুষ্টিত প্রথম সম্মেলনে কংগ্রেস পার্টির প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন বাঙ্গালী বাবু উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি। তার ১২৭ বছর পর প্রণব মূখার্জি সেই কংগ্রেসের হাত ধরে প্রথম বাঙ্গালী হিসেবে নির্বাচিত হলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ! বাঙ্গালীরা তাতে বেশ উৎফুলস্ন্য, উচ্ছসিত, রোমাঞ্চিত এমনকি বাঙ্গালী হিসেবে গর্বিতও বটে ! একজন বাঙ্গালী হিসেবে গর্ব করার মতোই ব্যাপার। সৌরভ গাঙ্গুলী একজন বাঙ্গালী হয়ে একশ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব যখন করতো তখনই গর্বে আমাদের বুকটা ভরে যেত আর এবার তো রাষ্ট্রপতি! মানুষ ধর্মীয়ভাবে কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ আবার বোদ্ধ-খৃষ্টান কিংবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী। কিন্তু জাতিগত ভাবে বাঙ্গালী একটি ইউনিক, একটি আলাদা পরিচয়, একটি স্বত্তা, একটি গৌরবময় অধ্যায়। এই বাঙ্গালী পরিচয়টি বঞ্চনা, বৈষম্যের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে কখনো ভারতীয় মূলধারার নেতৃত্বের দ্বারা আবার কখনো আমাদের ধর্ম ভাই পরিচয়দারী পাকিস্থানীদের দ্বারা। তা নাহলে বাঙ্গালী পৃথিবীতে আরো আগেই ঠাই করে নিত একটি স্বতন্ত্র জাতি-গোষ্ঠী তথা একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম দেশের অধিবাসী হিসেবে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও বাঙ্গালী পিছিয়ে নেই, পৃথিবীতে বাঙ্গালী মাথা উচু করে দাড়িয়েছে। কেউ তাদের/আমাদের ধাবিয়ে রাখতে পারেনি। কারো করুনা কিংবা দয়ায় নয়, সকল প্রতিকুলতা জয় করে নিজেদের যোগ্যতা বলেই বাঙ্গালীরা তাদের জানান দিচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
প্রণব মূখার্জি প্রথম কোন বাঙ্গালী হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। অভিনন্দন.. শুভেচ্ছা.. সাধুবাদ জনাব মুখার্জি। সৌরভ গাঙ্গুলীর নাম যেমন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে একজন সফল অধিনায়ক হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে ঠিক তেমনি প্রণব মূখার্জির নামও স্বর্ণাৰরে লিখা থাকবে একজন সফলতম ভারতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে, এমন প্রত্যাশাই রইলো। একই সাথে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। আমরা বাংলাদেশীরা দাদার কাছ থেকে নিশ্চয়ই মমতা দিদির মতো বিমাতা সুলভ আচরণ আশাকরি পাবোনা। দিদি যেমন তিসত্দার পানি দিবেনা বলে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে, দাদাও কি টিপাইমুখে বাধ দিয়ে পানি বাংলাদেশে আসতে দিবেনা ? দাদা কি সীমান্তের কাটা তারের উপর আরো ফেলানীর লাশ দেখতে চাইবেন ? দাদা, প্রতিদিনই কি কোন না কোন অজুহাতে সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে বাংলাদেশের নীরিহ কৃষকের প্রাণহানীর খবর শুনে দিনের কার্যাবলী শুরম্ন করবেন ? দাদা, আপনি কি বিশ্বাস করবেন যে আপনার রাষ্ট্রপতি হবার খবরে যতটা খুশি হয়েছে আপনার ভারতীয়রা তার চেয়ে বেশী খুশি হয়েছে বাংলাদেশীরা ? দাদা, আপনি কি জানেন, বাংলাদেশের খবরের কাগজ গুলোতে কতটা হাইলাইট করে প্রতিদিন আপনার রাষ্ট্রপতি হবার বন্দনা করা হচ্ছে ?
দাদা, যেখানে আপনার শহর কলকাতার নগর মাতা মমতা দিদি আপনার রাষ্ট্রপতি হবার খবরে গাল ভারি করেছিলেন, সেখানে আমাদের দুই মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আপনাকে সাদরে অভিনন্দন জানিয়েছেন, এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ফোন করে আপনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। আমরা জানি, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সান্নিধ্যের কথা। আমরা চাই প্রতিবেশী হিসেবে সুসম্পর্ক বজায় থাকুক বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। আমরা সীমানত্দে উত্তেজনা দেখতে চাইনা, আর কোন বাঙ্গালীর লাশ কাটা তারে ঝুলবে এমনটা নিশ্চয়ই একজন বাঙ্গালী হিসেবে আপনিও চান না। আপনি আর কিছু করুন আর না-ই করুন সীমান্ত সমস্যা সমাধানে, টিপাইমুখ বাধ বন্ধে এবং তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ নিবেন এমনটাই আশা করে বাংলা ভাষা-ভাষী তথা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালীরা।
দাদা, আপনার রাষ্ট্রপতি হবার খবরটা শুনে একদিকে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়েছি ঠিক তেমনি অন্যদিকে মনের ভিতর জমে থাকা একটা কষ্টও জিইয়ে উঠেছে। আপনি নিশ্চয়ই আনন্দমোহন বসুকে ভাল করেই চিনেন। আপনার রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে অনুষ্টিত ১৪তম সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ভারত উপমহাদেশের প্রথম Wrangler আনন্দমোহন বসু। আজকের যুগে এসে অনেককেই বলতে শুনেছি.. Wrangler ? এটা আবার কি ? ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদত্ত গনিত শাস্ত্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রি হচ্ছে Wrangler। এবং এই আনন্দমোহন বসুই ভারত উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র র্যাঙ্গলার। সর্ব ভারতের স্বাধিকার আন্দোলন তথা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের যে কয়জন পুরোধা রয়েছেন বসু তাদের অন্যতম। অথচ কালের করাল গ্রাসে আনন্দমোহন বসুর জন্মস্থান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের তার সেই পৈতৃক বাড়িটি এখন একজন স্থানীয় প্রভাবশালীর দখলে। দখলকারী বলে থাকেন তিনি বাড়িটি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছেন কিন্তু এ নিয়ে স্থানীয় সচেতন মহলে বিভিন্ন প্রশ্নবোধক কথা শুনা যায়। বসুর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি সংরৰণ করতে স্থানীয় কিছু যুবক উদ্যোগ নিলে তাদের পৰ থেকে স্থানীয় কাচারিতে এই লিজের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে অফিসের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই লিজের ব্যাপারে তাদের অফিসে তেমন কোন কাগজপত্র নেই।
অবহেলা আর অযত্নে বাড়িটি ইতিমধ্যেই হারিয়েছে তার পুরনো শ্রী। অথচ বসুর এই ঐতিহাসিক বাড়িটিকে একটি প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন কিংবা একটি যাদুঘর হিসেবে সরকারী জিম্মায় নিয়ে রৰণাবেৰন করার দাবী স্থানীয় সচেতন মহল সেই শুরম্ন থেকেই করে আসছে। আনন্দমোহন বসু সম্পর্কে লিখলে হয়তো কয়েক দিস্তা কাগজ লিখা যাবে কিন্তু আমি সেদিকে যেতে চাইনা। প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে আনন্দমোহন বসুকে টেনে আনলাম এই জন্যে যে, বসুই ছিলেন প্রথম বাংলাদেশী বাঙ্গালী, কংগ্রেস পার্টির সভাপতি যার জন্মস্থান আজকের এই বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায়। ভারতের ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটির সভাপতি হওয়া যে কতটা সম্মানের তা বলার অপেৰা রাখেনা। প্রণব মুখার্জি কংগ্রেস পার্টির একজন সিনিয়র নেতা, প্রতিরৰা মন্ত্রির দায়িত্ব পালন করেছেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু কংগ্রেস পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হবেন, সেই স্বপ্ন কি কখনো পুরণ হবে ? আনন্দমোহন বসু তা-ই হয়েছিলেন আজ থেকে ১১৪ বছর পুর্বে।
প্রণব মুখার্জি ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার মধ্যি দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, সকল অমীসাংসিত সমস্যার একটি সুষ্ট সমাধান হবে, আর কোন ফেলানী ঝুলবেনা সীমা্ন্তের কাটা তারে এমনটাই প্রত্যাশা করি নড়াইল তথা বাংলাদেশের জামাই বাবু জনাব মুখার্জির কাছে। আর ইতিহাস সচেতন বর্তমান সরকার, ভারত উপমহাদেশের প্রথম Wrangler, কংগ্রেসের প্রথম বাংলাদেশী বাঙ্গালী সভাপতি আনন্দমোহন বসুর আগামী ২০ শে আগষ্ট ১০৬তম মৃ্ত্যু বার্ষিকীকে সামনে রেখে তার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির প্রতি বিশেষ করে তার পৈতৃক ভিটা টুকুর ব্যাপারে একটু খোজখবর নিবেন এমনটাই প্রত্যাশা রইলো।
লেখকঃ গাজী মহিবুর রহমান, সাংবাদিক , ম্যানচেষ্টার, যুক্তরাজ্য
[email protected]