অসাম্প্রদায়িক সাধক ফকির লালন সাঁই-এর জীবনদর্শন মানব সমাজকে সত্য ও ন্যায়ের শিক্ষা দেয়। অথচ তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। তার জন্মস্থান বা ধর্ম পরিচয় নিয়েও রয়েছে নানা মত। গবেষকদের মতে, বাংলা ১১৭৯ সালের ১ কার্তিক ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে তার জন্ম। কথিত আছে, লালন শাহ যৌবনকালে একবার তীর্থ ভ্রমণে বের হন। পথিমধ্যে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। এ সময় সিরাজ সাঁই নামে একজন মুসলমান ফকির তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে সুস্থ করে তোলেন। পরে সিরাজ সাঁইয়ের কাছে বাউলধর্মে দীক্ষা নিয়ে ছেঁউড়িয়ায় একটি আখড়া তৈরি করেন।
বাউল সাধক ফকির লালন শাহের জীবন-কর্ম, জাতহীন মানবদর্শন, মরমিসংগীত ও চিন্তা-চেতনা এখন আর এই ছেঁউড়িয়ার পলি্লতেই সীমাবদ্ধ নেই, দেশের সীমানা পেরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। তার সংগীত ও ধর্ম-দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গবেষণা হচ্ছে। সাঁইজি জীবিত থাকাকালে ফাল্গুন মাসের শেষে দোল পূর্ণিমার তিথিতে কালি নদীর তীরে শিষ্যদের নিয়ে রাতভর গান বাজনা ও তত্ত্ব আলোচনা করতেন, যা কালক্রমে পরিণত হয়েছে লালন স্মরণ উৎসবে। লালন শাহ দেহত্যাগ করেন ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক। তার বয়স তখন ১১৬ বছর। তার মৃত্যু দিবসে ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় স্মরণ উৎসব হয়। গত বছর থেকে এখানে পাঁচ দিনব্যাপী উৎসব হচ্ছে। এটা মূলত লালনপন্থী সাধুদের সম্মিলনী উৎসব। এ উৎসবে মেলার এক প্রান্তজুড়ে থাকে বাউলদের বাদ্যযন্ত্র বিক্রির দোকান। এসব দোকানে একতারা, দোতারা, ডুগি, প্রেমজুড়ি বা কাঠজুড়ি, মন্দিরার মতো বাদ্যযন্ত্র। লালন স্মরণোৎসবে লালনপন্থী সাধুদের তৈরি গামছা-লুঙ্গি বিক্রি হয়। বিক্রি হয় সাঁইজির গানের ক্যাসেট ও গানের বই। অন্যদিকে প্লাস্টিকের সামগ্রী, কারুপণ্য বেচাকেনা হয়।
ছেঁউড়িয়ার লালন স্মরণোৎসব ও দোল পূর্ণিমায় লালন সাধুসঙ্গের অনুষ্ঠান বর্তমানে যে চেহারা পেয়েছে তা খুব বেশি দিন আগের নয়। গত শতকের পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত লালন উৎসব ছিল অনেকটা অনানুষ্ঠানিক। ওই উৎসব ছিল সাধু-ভক্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ১৯৬২ সালে ছেঁউড়িয়ায় আখড়া বাড়ি ঘিরে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে লালনচর্চার এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এরপর লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লালন একাডেমী। এরপর থেকে আখড়ার অনুষ্ঠান দুটি প্রশাসনিক সহায়তায় আস্তে আস্তে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আটকে পড়ে। এ মেলার মধ্যেই চলে সাধুদের ‘দীক্ষা’ বা ‘ভেক খিলাফতের’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে লালন সাঁইয়ের মাজারকে সামনে রেখে খেলাফতের সাদা কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয় লালন অনুসারীকে। এরপর সমাধিকে ৭ বার প্রদক্ষিণের ভেতর দিয়ে দীক্ষা বা খেলাফতের অনুষ্ঠান শেষ হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই লালন দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি বাউল আঙ্গিকের বহু গানও রচনা করেছিলেন। আজ বাউল দর্শন বিশ্বব্যাপী প্রচারিত।