অমর বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলী এর জন্ম-১৫ ফেব্রুয়ারি ১৫৬৪ খ্রি.। আর মৃত্যু-৮ জানুয়ারি ১৬৪২ খ্রি। এই তারিখের উল্লেখ রয়েছে ‘দি নিউ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’ থেকে। তবে এই তারিখ নিয়ে বিভেদ রয়েছে। জন্ম তারিখ বিভিন্ন বইয়ে বিভিন্ন রকম থাকলেও মৃত্যু তারিখ নিয়ে তেমন মতভেদ নেই। আর তার বাসস্থান ছিল- ইতালির তুসকানের গ্র্যান্ডডাচিতে।

আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের জন্য যে কোনো একক ব্যক্তির চেয়ে গ্যালিলিওর অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি চিরায়ত পদার্থবিদ্যার প্রধান প্রতিষ্ঠাতা। গ্যালিলিও প্রথম বিপ্লব আনেন বল বিদ্যায়। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের (খ্রি.পূ.৩৮৪-খ্রি.পূ.৩২২০ শিক্ষা ছিল, হালকা বস্তুর চেয়ে ভারী বস্তু দ্রুতগতিতে নিপতিত হয়। পরবর্তী প্রজন্মসমূহের পণ্ডিতরা এই মতবাদকে মেনে নিয়েছিলেন। গ্যালিলিও এ মতবাদকে যাচাই করতে মনস্থ করেন। তিনি পর পর অনেকগুলো পরীক্ষণকাজ পরিচালনা করেন। তিনি দেখতে পান, অ্যারিস্টটলের মতবাদ সঠিক নয়। আসল ঘটনা হল, ভারী ও হালকা বস্তু একই বেগে পতিত হয়। বেগ মাত্রার তারতম্য সৃষ্টি হয় বায়ুর সঙ্গে সংঘর্ষণের কারণে। টোলেমি (খ্রিস্টিয় ২য় শতাব্দী) বলেছিলেন, পৃথিবী স্থির রয়েছে। সূর্যসহ সব গ্রহসমূহ তাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। অ্যারিস্টটলও তা-ই বলে গেছেন। এই মতবাদ চলে আসছে দুই হাজার বছর ধরে।

কিন্তু গ্যালিলিও এই মতবাদে বিশ্বাসী নন। তিনি নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) এর মতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ পৃথিবীসহ সব সূর্যকেই প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু এ চিন্তাধারার সমর্থনে প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার পরই তিনি জনসাধারণের সম্মুখে এ চিন্তাধারা সমর্থন করা শুরু করেন। এর ফলে অ্যারিস্টটলবাদী পণ্ডিতরা বিরক্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হন এবং কোপারনিকাসবাদ নিষিদ্ধ করার জন্য ক্যাথলিক চার্চকে প্ররোচিত করতে থাকেন। গ্যালিলিও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে রোমের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। তার যুক্তি ছিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে কিছু বলার উদ্দেশ্য বাইবেলের ছিল না। যেখানে বাইবেলের সঙ্গে সাধারণ বুদ্ধির দ্বন্দ্ব বাইবেল সেখানে রূপক। কিন্তু চার্চের ভয় ছিল এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে প্রোটেস্টেন্টদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ক্ষতি হবে। সুতরাং তারা দমননীতি গ্রহণ করেন। তারা আদেশ জারি করেন যে, গ্যালিলিও কখনো এ মতবাদ মেনে চলতে কিম্বা এর স্বপক্ষে প্রচার করতে পারবে না। বৃদ্ধ বয়সেও গ্যালিলিওকে দিয়ে ঘোষণা করতে বাধ্য করান যে,

 ‘আমি ফ্লোরেন্সের পরলোকগত ভিনসেনজিও গ্যালিলির পুত্র ৭০ বছর বয়স্ক গ্যালিলিও গ্যালিলাই আদালতের কাঠগড়ায় হাজির… সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র স্থল এবং গতিহীন স্থির এই ভ্রান্ত ধারণা আমি ত্যাগ করছি, আমি কোনো প্রকারেই আর উক্ত ভ্রান্ত তথ্য সমর্থন, প্রচার বা ঘোষণা করব না।’

১৬৩২ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ ‘জগতের দুটি প্রধান পদ্ধতি সম্বন্ধে মতবিনিময় টোলেমিয় ও কোপারনিকাসিয়’ থেকে নমুনা স্বরূপ কয়েকটি লাইন উল্লেখ করছি। উল্লেখ্য, এ গ্রন্থটিই চার্চের সঙ্গে তার সংঘাতের কারণ ছিল। এরপর সালভিয়াতি বলেন ‘এখন এটা যদি সত্যি হয় যে, সেই বিন্দুটাই বিশ্বের কেন্দ্র যার চতুর্দিকে সমুদয় বর্তুল এবং বিশ্ব বস্তুরা অর্থাৎ গ্রহরা ঘোরে তাহলে এটা সুনিশ্চিত যে, পৃথিবী নয় সূর্যকেই বিশ্বের কেন্দ্রে দেখা যাবে। অতএব, এই প্রথম সাধারণ ধারণা অনুসারে প্রধান আসন সূর্যেরই এবং পৃথিবী কেন্দ্র থেকে ঠিক তত দূরে যতখানি সে সূর্য থেকে দূরে।’

যাহোক, ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ শিক্ষকতা এবং গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে ও গ্যালিলিওর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু তার চিন্তা করার ক্ষমতা এবং গ্রন্থ রচনা করার কাজ বন্ধ করতে পারেননি। অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বন্দীদশাকালে তিনি গতির নিয়ামক সম্পর্কিত সূত্রাবলী শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন। নানা দুঃখ কষ্ট আর অভাব অনটনে এই মহান বিজ্ঞানী ও মহামানব জ্বরে ধুকে ধুকে গৃহবন্দীর নয় বছরের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর ৩২৬ বছর পর ১৯৬৮ সালে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ গ্যালিলিও গ্যালিলিকে বিনাশর্তে ক্ষমা প্রদর্শন এবং তার দণ্ডের আদেশ নাকচ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।