সামন্ততান্ত্রিক মুল্যবোধগুলোকে পুঁজিবাদের মোড়কে নতুন ভাবে পরিবেশন করবার একটি ধারনা হল ফ্যাসিবাদ; যা পুঁজিবাদের বিকাশের ধারায় একটি অবশ্যম্ভাবি পরিণাম। খুব সংক্ষেপে বললে, ফ্যাসিবাদ হল সমাজের ক্ষমতাসীন ধনী এবং ক্ষমতালোভী সুবিধাভোগীদের তৈরি একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র ও মেহনতি মানুষগুলোর উপর রাজত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা যায়। যেখানে সংসদীয়, আইনি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন সুচারু রুপে অকার্যকর করে তোলা হয়, যাতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অর্থনৈতিক দাবী সহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারের দাবিগুলো ধীরে ধীরে হয়ে উঠে গৌণ; এবং অপ্রধান দাবী গুলো হয়ে উঠে প্রধান ও মুখ্য।
প্রাথমিক পর্যায়ে, ক্ষমতাসীন সুবিধাভোগীদের প্রতিনিধিত্বকারী দল বা সরকার প্রধান তাঁর আপাত জনপ্রিয়তার ছায়াতলে খুব সুচারু ভাবে এই নাগরিক অধিকারগুলোকে হরণ করেন। এ সময়ে একটি জনপ্রিয় মুখ্য দাবীকে কেন্দ্র করে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আর সকল দাবিগুলোকে গৌণ করে তোলে। জাতীয়তাবাদ, বা অমীমাংসিত কোন ঐতিহাসিক জাতীয় দাবী, বা বর্ণবাদ, বা লিঙ্গ বৈষম্য, বা ধর্মীয় প্রণোদনা সাধারণত এই অধিকার হরণের আড়াল হিসেবে কাজ করে। এই পর্যায়ে ফ্যাসিবাদীদের আচরণগুলো প্রবল মাত্রায় জনসমর্থন পায়, কারন তা বিশেষ কিছু লোকের কর্মসংস্থান করে।
যুগে যুগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গুলো নিজ স্বার্থে সবসময় ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করে এসেছে, কারন এই সময়টাতেই তাদের সর্বোচ্চ বিকাশ সম্ভব। তথাকথিত উন্নত বিশ্বে ফ্যাসিবাদ রূপ নিয়েছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে, আর উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে ফ্যাসিবাদ আবির্ভূত হয়েছে সামরিক উর্দিতে বা আরও ক্রূর ভাবে ছদ্ম-গণতন্ত্রের বেশে ।
ফ্যাসিবাদের আরেকটি চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হল মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর ক্রমাগত ও সক্রিয় বিরোধিতা এবং তাদের হাস্যকর করে তোলার প্রবল অপচেষ্টা। একই সাথে রাজনৈতিক ভাবে সাধারণত ফ্যাসিস্টদের প্রথম টার্গেট হল কমিউনিস্টরা (এবং কিছু নৈরাজ্যবাদী)। দুর্নীতি, দমন ও পীড়ন, স্বজন প্রীতি ও মুক্তচিন্তাকে আক্রমন এবং প্রহসনের নির্বাচনও ফ্যসিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
পুঁজিবাদ আর ফ্যাসিবাদ অবিচ্ছেদ্য; এ যেন বিজ্ঞাপনী ভাষায় – দু’জনে দু’জনার এক অনাবিল অনুষঙ্গ।
পুঁজিবাদি সরকারগুলোর জন্য ফ্যাসিবাদি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়না; কারন ফ্যাসিবাদি ধারনা এবং ফ্যাসিবাদি অস্ত্রগুলো (পুলিশ, সহযোগী অঙ্গ সংগঠন, কালো আইন, ইত্যাদি) পুঁজিবাদী একটি রাষ্ট্রে তৈরি অবস্থাতেই থাকে।
এমনকি ফ্যাসিবাদের সুপ্তাবস্থাতেও এর লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট ভাবে বিদ্যমান। চটুল জাতীয়তাবাদের মোড়কে ঢাকা জাতিগত বৈষম্য, জাতীয় নিরাপত্তার আড়ালে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রবণতা, লিঙ্গ বৈষম্য ইত্যাদি এর অন্যতম ।
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশের গতানুগতিক ধারাগুলো সীমিত হয়ে আসলে, বা অর্থনৈতিক মন্দাকালীন অবস্থায় যখন মুনাফার পথগুলো সঙ্কুচিত হয়ে আসে, ফ্যাসিবাদই হয়ে ওঠে পুঁজিপতিদের প্রধান অবলম্বন, যার পরবর্তী ধাপ হল যুদ্ধ বা যুদ্ধকালীন অবস্থা। সাম্প্রদায়িক সংহতির নামে ভীতি ও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দিয়েই বেড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ। কুসংস্কার, যুক্তিহীনতা, লিঙ্গ বৈষম্য, ধর্মান্ধত্ব, বিজ্ঞান বিরোধিতা, সামাজিক উৎপাদনে অনীহা, গনমানসে আশাহীনতা ইত্যাদি অনুষঙ্গগুলো ফ্যাসিবাদের বেড়ে ওঠার উপাদান এবং এই উপাদানগুলো একই সাথে তার মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনিও।
হিটলারের জার্মানি, মুসোলিনি’র ইতালি, ফ্রাঙ্কো’র স্পেন, সুহার্তো’র ইন্দোনেশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশের ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদের চৌদ্দটি সার্বজনীন নির্নায়ক বৈশিষ্ট্য জনপ্রিয় ভাবে সংজ্ঞায়িত; ভাবগত অনুবাদে এই বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখের চেষ্টা করছি ।
- ক্রমাগত প্রচারণায় শক্তিশালী এক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ চেষ্টাঃ ফ্যাসিস্ট শাসনের একটা বিশেষ প্রবনতা হল দেশপ্রেমের চতুর আর কুশলী ব্যবহার। জনপ্রিয় উদ্ধৃতি, আপ্তবাক্য, স্লোগান, স্মারক, গান, আর আড়ম্বরে জনতাকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় মোহাবিস্ট করে তোলা; বিশেষত পতাকাকে আরও প্রিয় করে তোলার কৌশলে পতাকার চিহ্নকে সর্বত্র উপস্থাপন করার প্রবৃত্তি।
- মানবাধিকার ও মানবাধিকার সূচক গুলোর প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যঃ শত্রুভীতি আর নিরাপত্তার প্রয়োজনকে কারন হিসেবে উপস্থাপন করে ফ্যাসিস্ট শাসনকর্তারা ক্ষেত্রভেদে এমনকি মানবাধিকারকেও উপেক্ষা করতে পিছপা হননা। বিকল্প প্রাপ্তির আশায় জনতাও তাদের সকল নির্যাতন, অন্যায় মৃত্যুদণ্ড, নির্বাসন , হত্যা, গুমের নীরব অনুমোদন দিয়ে চলে।
- সকল সমস্যার মুল হিসেবে একটি বলীর পাঁঠাকে দাঁড় করানোঃ উগ্র দেশপ্রেমের মিছিলে ফ্যাসিবাদীরা জনতাকে শামিল করিয়ে যতদোষ নন্দ ঘোষ প্রবাদের অনুকরনে সকল হুমকি, সকল সমস্যার কারন হিসেবে কোন একটি শত্রুপক্ষকে দাঁড় করায়; সেটা হতে পারে জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বা উদারপন্থীরা, বা কমিউনিস্টরা, বা সমাজবাদীরা বা সন্ত্রাসী কোন গোষ্ঠী।
- সামরিক বাহিনীর আধিপত্যঃ অভ্যন্তরীণ হাজার সমস্যা সত্ত্বেও আর সকল কর্মসূচীকে উপেক্ষা করে হলেও সামরিক খাতের অর্থায়নের বিষয়টি ফ্যাসিস্ট শাসনে বিশেষ গুরুত্ব পায়। সেনাসদস্যদের এবং সামরিক সেবাকে মহিমান্বিত করে তোলার প্রবণতাও দেখা দেয়।
- লিঙ্গ প্রাধান্যঃ ফ্যাসিস্ট দেশগুলোতে প্রায়শঃই, একচেটিয়াভাবে পুরুষ আধিপত্য দেখা যায়; লিঙ্গের সনাতনি ভুমিকা আরও কঠোর ভাবে উপস্থাপিত হয়, এবং বিবাহবিচ্ছেদ, গর্ভপাত, সমকামীতার মত বিষয়গুলোর নিস্পত্তিতে রাস্ট্রকেই চূড়ান্ত অভিভাবক হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায়।
- গণ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণঃ ফ্যাসিস্ট সরকারগুলো কখনও কখনও, সরাসরি ভাবে গণ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রন নিলেও অনেক ক্ষেত্রেই গণ মাধ্যমকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রন করে; সরকারী নিয়মের জালে বা সহানুভূতিশীল মিডিয়া কর্মী/ মুখপাত্রের মাধ্যমে। নিষেধাজ্ঞা; বিশেষ করে যুদ্ধকালীন অবস্থায় খুবই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়।
- জাতীয় নিরাপত্তার জুজুঃ সরকার জনগণের নিরাপত্তার ভয়কে একটি জুজু হিসাবে ব্যবহার করে সেটাকে জনমত গঠনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
- ধর্ম ও সরকার হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্যঃ ফ্যাসিস্ট দেশগুলির সরকার, সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মমতকে নিপূণভাবে জনমত গঠনের একটি হাতিয়ারে পরিনত করে। ধর্মবানী আওরানো আর ধর্মিয় আচার ও অভিব্যক্তির প্রদর্শন হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নেতাদের প্রাত্যহিক কর্ম; এমনকি সেটা রাষ্ট্রীয় নীতি বিরোধী হলেও।
- কর্পোরেটের সুরক্ষাঃ ফ্যাসিস্ট দেশগুলোতে শিল্প আর ব্যবসা সাধারনত অভিজাততন্ত্রের হাতেই থাকে, আর তারাই নেতৃত্বের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে; পারস্পরিক লাভজনক এই ব্যবসায় একে অন্যের স্বার্থ রক্ষা করে চলে।
- শ্রমিকের সাংগঠনিক ক্ষমতা খর্বঃ শ্রমিক ইউনিয়ন ফ্যাসিস্ট সরকারের জন্য সবচাইতে বড় হুমকির কারণ বলে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে হয় বিলুপ্ত বা গুরুতরভাবে খর্ব শক্তির করে তোলা হয়।
- বুদ্ধিজীবী, শিল্পকলা, চারু শিল্প ও সুশীল সমাজের প্রতি অবজ্ঞাঃ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে উচ্চ শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি, এবং শিক্ষকদের প্রতি খোলাখুলিভাবে শত্রুতা প্রদর্শনে উৎসাহিত করা হয়। বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের উপর নিষেধাজ্ঞা বা তাঁদের গ্রেফতার মোটেই বিরল কিছু নয়; শিল্পকলা ও মুক্ত চিন্তা খোলাখুলিভাবেই আক্রান্ত হয়।
- অপরাধ এবং শাস্তির উন্মাদনাঃ ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীনে, পুলিশকে আইন বলবৎ করার প্রায় সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়; দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে জনতাও প্রায়ই পুলিশী নির্যাতনকে অগ্রাহ্য করে, কিছু ক্ষেত্রে এমনকি নাগরিক স্বাধীনতা বিসর্জনেও আপত্তি করেনা। ফ্যাসিস্ট দেশগুলোতে প্রায়ই সীমাহীন ক্ষমতা সম্পন্ন জাতীয় পুলিশ বাহিনী গঠন করতে দেখা যায়।
- প্রবল পৃষ্টপোষকতা ও সীমাহীন দুর্নীতিঃ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বমুলক পদায়ন গোষ্ঠী নিদৃষ্ট হয়; প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বন্ধু ও সহযোগীরা একে অপরকে অপরকে নিয়োগ দেয়, যেন জবাবদিহিতা থেকে বন্ধুরা একে অপরকে রক্ষা করতে পারে। সরকারের নেতাদের জাতীয় সম্পদ আত্মসাৎ, এমনকি সরাসরি চুরিও ফ্যাসিস্ট শাসনে বিরল নয়।
- প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনঃ ফ্যাসিস্ট দেশগুলোতে, কখনও কখনও নির্বাচনে হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ একটি ভান। অন্য ক্ষেত্রে নির্বাচনী মূলা ব্যবহৃত হয় প্রচারণায়, বিরোধী প্রার্থী নির্মুলে, নির্বাচনী আইন পরিবর্তন ও নির্বাচনী সীমারেখা নিয়ন্ত্রণে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলো সাধারণত নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে তাদের বিচার বিভাগকেও ব্যবহার করে থাকে
কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারি দাবী করা, ধর্মনিরপেক্ষতার ফাঁকা বুলি সর্বস্ব আওয়ামী লীগের অধীনে বাংলাদেশ কি হয়ে উঠেছে একটি ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্র?
সিদ্ধান্তের ভার পাঠকের ওপর।