লিখেছেন : কুঙ্গ থাঙ

রামায়ন মহাভারতের মতো প্রাচীন মহাকাব্য এবং ভারতীয় পুরাণগুলোতে যাদেরকে ‘কিরাত’ আখ্যা দেয়া হয়েছে, মান্দি বা গারোরা হলো সেই সমাজের মানুষ। আর্যরা যখন শ্রেণীসমাজে উত্তরিত হয়েছে, বর্ণাশ্রম সৃষ্টি করে সুযোগ ও অধিকারের বৈষম্য প্রতিষ্ঠা করেছে, অনার্য কিরাতরা তখন আদিম সাম্য সমাজকে ধরে রেখেছে, গোষ্ঠীজীবনের উপর ভিত্তি করে সাম্যমুলক যৌথ চেতনার উত্তরন ঘটিয়েছে। পৌরানিক যুগের পরও কিরাতদের সাম্যসমাজ পুরোপুরি ভেঙে যায়নি, তাদের সামাজিক কাঠামো বা উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন ঘটেনি।

কিরাত জনগোষ্ঠির অন্তর্গত মান্দিরা এই সেদিন পর্যন্ত জুম চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। জুম চাষের যৌথ কৃষিপদ্ধতি আদিম সাম্যবাদী সমাজের অংশ। জমিতে তাদের কোন ব্যক্তিমালিকানা ছিলনা, একটি এলাকার সব জমিতেই ছিল সমগ্র গোত্রের যৌথ অধিকার। এই ধারনায় যে বনভূমি প্রকৃতির অংশ, তার কোন মালিকানা হয় না। প্রাকৃতিক বনভূমিকে যৌথ প্রয়াসে বাসভূমি ও চাষভূমিতে পরিণত করে গারোরা তার উপর সকলে সমান অধিকার বিস্তার করতো। জুম চাষের সরল উৎপাদন প্রথায় ভোগ ও বন্টনও সাম্যভিত্তিক। এখানে ব্যক্তিকে ছাপিয়ে যৌথ চেতনাই প্রবল হয়ে উঠে; পরস্পরের প্রতি সাহায্য সহযোগিতা ছিল একেবারেই ব্যক্তিস্বার্থ বিবর্জিত। গারোদের সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজব্যবস্থা আজ আর নেই, কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ ভিত্তিক সমৃদ্ধ শ্রেণীসমাজেও তারা উত্তরিত হয়নি। সেই যৌথ চেতনা আজো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, এখনো খেতখামার বা গেরস্তালি কাজে কিংবা ঘরদোর তৈরীতে তারা বিনা পারিশ্রমিকে পরস্পরকে সাহায্য করে থাকে, নির্বান্ধব বা নিঃসহায় মানুষকে সকলে মিলে তারা বাঁচতে ও বাড়তে দেয়। এ সমাজে ব্যক্তিচেতনা যৌথচেতনাকে গ্রাস করেনি। একজন গারো ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার অধিকারী দাবী করতে পারেনা। পিতা, পুত্র, মাতা, কন্যা, স্বামী, স্ত্রী বা আত্মীয় হিসাবে সে সবসময় সমাজের নিকট দায়বদ্ধ। গারোদের আদিধর্ম ‘সাংসারেক’ বা ‘দাকবেওয়াল’ কঠোরভাবে এই যৌথচেতনার অনুষঙ্গী।

গারোদের সহজ জীবনব্যবস্থায় বাইরের কারো সাথে দ্বন্দের কোন সুযোগ নেই, কিন্তু আমরা যাদের সভ্যসমাজের মানুষ বলি তারা এদের নিরুপদ্রবে থাকতে দেয়নি। তাদের লোলুপ দৃষ্টি গারোদের বাসভূমি ও চাষভূমির উপর পড়েছে, হামলা চালিয়ে তারা নানান সময়ে তাদের বাস্তুচ্যুত করেছে, জীবিকা বিপর্যস্ত করেছে, জীবনের ছন্দ ব্যহত করেছে। গারোরা এই হামলাকারীদের রুখে দাঁড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু আদিম সাম্যসমাজসুলভ সারল্য দিয়ে শ্রেণীসমাজের কুটকৌশলতে তারা পরাস্ত করতে পারেনি। সেই ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দিতেই গারো পাহাড়ের পাদদেশে বিরাট ভুভাগ দখল করে নেয় উত্তর ভারত থেকে আসা শ্রেণীসমাজের প্রতিভুরা। এরপর ইংরেজ শাসনামলে যখন শোষনসহযোগী জমিদার গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে, তখন গারোরা খুব সহজেই তাদের শিকারে পরিণত হয়। সুসং ও শেরপুরর জমিদাররদের সাথে শোষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় মহাজন শ্রেণী। সরলতার সুযোগে জুমের ধান ও তুলা তারা স্বল্প তেল ও লবনের বিনিময়ে হাতিয়ে নিত। আর জমিদাররা ভুমি ও পণ্যের উপর উচ্চহারে কর চাপিয়ে গারোদের মালামাল ছিনিয়ে নিত আর তাদের নিগৃহীত করতো । সভ্যদের ধূর্ততা ও বিদেশী উপনিবেশবাদীদের সম্মিলিত উৎপীড়ন চরমে উঠলে গারোরা সংঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ ঘোষনা করতে বাধ্য হয়। উৎপীড়ন ও নিগ্রহের প্রতিশোধ নিতে গারোরা দলবদ্ধ হয়ে সমতলভুমিতে পাল্টা হামলা চালাতে থাকে। এর ফলে অনিবার্যভাবেই সভ্যসমাজের পন্ডিতদের কাছে গারোরা নৃশংস এবং ‘নৃমুন্ড-শিকারী’ হিসাবে পরিগনিত হয়।

আমরা জানি আদিম সাম্যসমাজের ধারনায় ভূমি প্রকৃতির অংশ হিসেবে বিবেচিত এবং ভূমির উপর ব্যক্তির মালিকানা থাকেনা। কাজেই এদের মধ্যে জমিদার ও প্রজার ভেদ ছিলনা, খাজনা বা করের কথা এই ধারনার সাথে মেলেনা। যখন যৌথ ভূমিমালিকানার উপর আঘাত আসলো,স্বাভাবিকভাবেই গারোদের কাছ থেকে তার প্রত্যাঘাত এলো। যৌথচেতনার আদিধর্ম ‘দাকবেওয়াল’ সেই প্রত্যাঘাতের শক্তি যোগালো। এরমধ্যে করমশাহ নামে এক ফকিরের পাগলপন্থা মতবাদের প্রতি গারোরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। করমশাহ সুসং পরগনায় এসেছিলেন ১৭৭৫ সালে।পাগলপন্থা মতবাদের মুলকথা ছিলো – সকল মানুষ আল্লাহর বান্দা, আল্লার জমিনের মালিক কোন জমিদার বা রাজা হতে পারেন না, কেউ কারো অধীন নয় ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই গারোরা এর প্রতি আকৃস্ট এবং হলো শত্রুর মোকাবেলা করতে পাগলপন্থা সংগঠনে সমবেত হতে লাগলো। ১৮১৫ সালে করমশাহর মৃত্যু হলে তার পুত্র টিপু পাগলপন্থীদের নেতৃত্ব দেন এবং গারোদের মধ্যে ধর্মীয় আলোড়ন তুলেন।

১৮২৫ সালে করভারে জর্জরিত গারোরা জমিদারের খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়। এর ফলে জমিদারগোষ্ঠীর সাথে গারোদের সশস্ত্র যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে জমিদারগোস্ঠী পরাজিত হয়ে পালিয়ে কোনরকমে আত্মরক্ষা করে। সাতশত গারো বিদ্রোহী শেরপুর শহর অধিকার করে এবং সেখানে একটি স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এরপর পরবর্তী দুই বছর গারোরা ইংরেজ বাহিনীকে লড়াই করে দমিয়ে রাখে। ১৮২৭ সালে টিপু ইংরেজদের হাতে বন্দী হন এবং মারা যান। টিপুর মৃত্যুর পর ১৮৩৩ সালে দ্বিতীয় পাগলপন্থী বিদ্রোহ হয়। সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ১৮৩৭ থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো বিদ্রোহ পরিচালিত হয়। চরম ধূর্ততা ও নৃশংশতায় এসব বিদ্রোহ দমিত হয়। এরপরথেকেই গারোদের যৌথসমাজ ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। বিপ্লবী আদিধর্মের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়, আর এ সুযোগে খৃস্টান মিশনগুলোর তৎপরতায় গারোরা বিপুলভাবে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। কিন্তু তাতে শ্রেণীসমাজের মনোভাবের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ইংরেজরা নানান পন্থায় শোষন করে তাদেরকে সর্বহারা শ্রেণীতে পরিনত করে। ইংরেজরা চলে গেলে শোষন শেষ হয়না, কেবল শাসকশ্রেনীর পরিবর্তন ঘটে। রাস্ট্র আর রাস্ট্রের অধিপতি সভ্যলোকেরা পরবর্তী সময়ে সাফল্যের সাথে ভূমিদখল, উচ্ছেদ, নিপীড়ন ও অত্যাচার চালিয়ে তাদের জীবনিশক্তি শোষন করে নিজেদের চিকনাই বাড়িয়ে চলে। আজো সে প্রক্রিয়ার অবসান হয়নি। এখন বরং প্রতিকুলতা এতোখানি বেড়েছে যে, গারোসহ এদেশের সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠির সামনে কোন স্বপ্ন নেই।

১৮২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গারোদের যে স্বাধীন রাজ্যটি, সেটি যদি টিকে থাকতে পারতো, যদি শেরপুরের সীমা ছাড়িয়ে সেই স্বাধীন রাজ্যের সম্প্রসারন ঘটতো গারোজন অধ্যুষিত জনপদে, যদি স্বাধীন গারোরা উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েও বহাল রাখতে পারতো আদিম সাম্যসমাজটি, তাহলে কি রাস্ট্রের ভুগোল একইরকম থাকতো? তাহলে কি তাদেরকে শাসক ও অধিপতি জনদের পদদলিত হয়ে, করুনার পাত্র হয়ে কাটাতে হতো এই দুর্বিসহ নিজভূমে পরবাস জীবন?