ছবিটি রুপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে

রশিদ উদ্দিন একজন সিদ্ধ বা খাঁটি বাউল কবি। তবে তিনি মূলত সঙ্গীত আশ্রয়ী বাউল কবি। সেইসাথে তিনি লোকজ দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, সাম্যবাদী মরমি সাধক।  কারও কারও চিন্তায় তিনি আরও ভিন্নভাবে মূল্যায়িত হতে পারেন। তবে নেত্রকোণা অঞ্চলে বাউলগানের প্রসারকালে রাষ্ট্র ও সমাজের শাসক শ্রেণির নিকট বাউল সমাজ যখন খুব একটা সমাদৃত ছিলেন না, উপর শ্রেণি তাঁদের বাতুল বা ব্যাকুল বা অর্ধ উন্মাদ রূপে অবজ্ঞা করত; অথচ সেই সমাজ পরিবেশে সম্ভবত রশিদ উদ্দিন তাঁর নিজ নামের পূর্বে ‘বাউল’ বিশেষণটি ব্যবহার করেন।  যেখানে বাউল সমাজের পূর্বসূরী লালন নিজেকে শাহ-সাঁইজি-ফকির, হাছন নিজেকে রাজা ইত্যাদি বলে নিজের গানে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন এবং পরে তাঁর প্রধান শিষ্য ও সহচর জালাল খাঁ, উকিল মুন্সী সহ সকলেই নিজেদের ‘বাউল’ বলে পরিচয় দিয়েছেন।  অর্থাৎ এটা ছিল বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের ঘুণেধরা সমাজের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রোহ।  আর সেই বিদ্রোহের পথ ধরে রশিদ উদ্দিন সৃষ্টি করেন নতুন ধারার তর্কধর্মী ও তথ্যমূলক ‘মালজোড়া বাউল গান।’ নেত্রকোণার বাউল জগতের মধ্যমণি ছিলেন বাউল কবি রশিদ উদ্দিন আর তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিলেন বাউল জালালউদ্দিন খাঁ, বাউল মিরাজ আলী, বাউল কমল মিয়া,বাউল উকিল মুন্সী, ইদ্রিস মিয়া, বাউল আব্দুল মজিদ তালুকদার, বাউল আলী হোসেন সরকার, বাউল আবেদ আলী, বাউল চান মিয়া, বাউল ইস্রাফিল, বাউল খোর্শেদ মিয়া, বাউল প্রভাত, বাউল আলী হোসেন, বাউল পীতাম্বর নাথ, বাউল তৈয়ব আলী, বাউল মিয়াহুব, বাউল উমেদ আলী প্রমুখ এবং নেত্রকোণার বাইরের বাউলগণের মধ্যে বাউল আব্দুল বারেক, বাউল শাহ আব্দুল করিম, বাউল আবু তাহের, বাউল আব্বাছ উদ্দিন ও বাউল উপেন্দ্র সরকার প্রমুখ।   এ বাউল গোষ্ঠী মূলত নেত্রকোণার বাউল জগতের ‘মালজোড়া’ বাউলগানের নির্মাতা। আর বাউল রশিদ উদ্দিন ছিলেন তাঁদের ঘরানার ওস্তাদ।

বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন ১৮৮৯ সালের ২১ শে জানুয়ারি নেত্রকোণা পৌরসভাধীন বাহিরচাপড়া গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  তার দাদা কুস্তিগীর হিসেবে গৌরীপুরের জমিদারের নিকট থেকে বাড়িসহ একখন্ড লাখেরাজ কৃষিজমি প্রাপ্ত হন। এ জমির উপর তৈরি বাড়িতে রশিদ উদ্দিনের পিতা মরহুম মশ্রব উদ্দিন তার তিন ছেলে মল্লিক উদ্দিন, রশিদ উদ্দিন এবং নিজাম উদ্দিনকে নিয়ে গড়ে তুলেন এক ছোট্ট সংসার। বড় ছেলে মল্লিক উদ্দিন এন্ট্রাস পাস করে নেত্রকোণার সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কেরাণির চাকুরি গ্রহণ করেন।

বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন আত্নভোলা। তাই বড় ভাইয়ের নিকট বাল্য শিক্ষা পাঠ ছাড়া কোন বিদ্যালয়ে তার লেখাপড়া হয়নি।  রশিদ উদ্দিন ১৫/১৬ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী পুখুরিয়া গ্রামের টাকনা মিস্ত্রীর সান্নিধ্যে এসে একটু একটু করে একতারা বাজিয়ে বাউলগান শিখতে শুরু করেন। তখন বাহিরচাপড়া গ্রামে কৃষ্ণলীলা গান শুরু হয়। রশিদ উদ্দিন কৃষ্ণের অভিনয় করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। এ সময় পার্শ্ববর্তী বাংলা বেতাটিসহ সর্বত্র কবিগানের ব্যাপক প্রসার ছিল।  দুর্গাপূজা, কালীপূজা, দোলপূজাসহ হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে কবি গান ছিল অত্রাঞ্চলে এক বিশেষ আকর্ষণ। পাশাপাশি টিপু পাগলের নেতৃত্বাধীন পরিচালিত ১৮২৭ সনে ফকির বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর লেংটা ফকিরদের জলসা ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার। তখন বাহিরচাপড়া গ্রামে কিশোরগঞ্জের কঠিয়াদী থেকে এক লেংটা পীরের আগমন ঘটে। ১৯০৯ সনে রশিদ উদ্দিন এ লেংটা শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নিজ বাড়িতে হাল্কা জিকিরের জলসায় মেতে উঠেন। এ জলসায় বাংলার দীনা মাঝি ও পুখুরিয়ার টকনা মিস্ত্রী ছিল রশিদের নিত্য রাতের সাথী।  নেত্রকোণার প্রখ্যাত বাউল কবি জালাল খাঁ তখন রশিদ উদ্দিনের বাড়িতে লজিং থেকে নেত্রকোণা স্কুলে লেখাপড়া করতেন।  জালাল খাঁ তখন থেকেই রশিদ উদ্দিনের নিকট বাউল গানের তালিম নেয়া শুরু করেন। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন তার বড় ছেলে আরশাদ উদ্দিনের দুই বছর বয়সের সময় ছেলেকে মৃত্যু শয্যায় রেখে হঠাৎ রাতে গৃহত্যাগ করেন। তখন রশিদ উদ্দিনের গৃহত্যাগের সংবাদ পেয়ে জালাল খাঁ ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে এক পুত্র ও এক কন্যাকে সিংহের গ্রামস্থ শ্বশুরালয়ে রেখে বালুয়াখালীর সিদ্দিক জমাদারের বাড়িতে এসে রশিদ উদ্দিনের গৃহত্যাগের অথ্য সগ্রহপূর্বক সন্ধানে বের হন এবং দীর্ঘ নয় মাস পর রশিদ উদ্দিনকে শারফিনের মাজারে খুঁজে বের করেন। জালাল খাঁ শারফিন থেকে রশিদ উদ্দিঙ্কে সঙ্গে নিয়ে বালুয়াখালী ফিরে আসেন। রশিদ উদ্দিন তখন থেকে প্রায় দুই বছর ভাত খাওয়া ছেড়ে দেন। তখন তিনি শুধু দুধ ও রুটি খেতেন।  রশিদ উদ্দিনের এ উদাসী ভাব দেখে বাউল কবি জালাল খাঁ স্থায়ীভাবে রশিদের সঙ্গে থাকার জন্য সিদ্দিক জমাদারের মেয়ের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এবং জালাল খাঁ রশিদের শিষ্যরূপে বাউল সাধনায় মনোনিবেশ করেন।  তাই জালাল খাঁ  রশিদ উদ্দিনের অন্যতম সহকর্মী ও সাগরেদ।

রশিদ উদ্দিনের অবস্থা তখন পাগল প্রায়। মানুষ-মানবদেহ-প্রকৃতি সৃষ্টিরহস্য, গুরু সাধন, নিঘোর তত্ত্ব, আত্না-পরমাত্না বিষয়ক চিন্তা তাঁর হৃদয়কে ব্যাকুল করে তোলে। তখন রশিদ উদ্দিনের বাড়ি বৈঠকী বাউলগানের এক আখড়ায় পরিণত হয়। গান ছিল তখনকার সার্বজনীন বিষয়। কবি গানে সাধারণত হিন্দু শাস্ত্রের মহাভারত, রামায়ণ, গীতা কেন্দ্রিক দুই কবির মধ্যে কবিতার ছন্দে প্রশ্ন ও উত্তর চলত।  আর জারিগান ছিল জংগনামার পুঁথি ও শহীদি কারবালা ভিত্তিক দুই বয়াতির তর্কানুষ্ঠানের মাধ্যমে দলবদ্ধ গান।  কবিগান ছিল হিন্দু শাস্ত্র এবং জারি গান ছিল মুসলিম দর্শন ভিত্তিক।  এ কবি গান ও বয়াতিদের শাস্ত্রভিত্তিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা রশিদ উদ্দিনকে বাউল গানে বিভিন্ন তত্ত্ব ভিত্তিক সুর ছন্দে ও সুললিত ভাষায় তর্কানুষ্ঠানে উৎসাহিত করে। এ লক্ষ্যে রশিদ উদ্দিনের বাড়ি আস্তে আস্তে বাউল তত্ত্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ কেন্দ্রে সহযোগী হিসেবে খালিয়াজুরী থানার বাউল সাধক উকিল মুনশী, মোহনগঞ্জ থানার হাসলার চান খাঁ, মদন থানার হাজরাগাতির পিতাম্বর রবিদাস সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।  সংগীতের এ মহান সাধক ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

সংগ্রহিত তথ্য সুত্রঃ
নেত্রকোনা ডট অর্গ, উইকিপিডিয়া ও বাংলা নিউজ ২৪ ডট কম