আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা। বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার নীলগঞ্জের পাতুয়াইর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাসাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। বাবা কবিয়াল দ্বীজ বংশী দাসও ছিলেন বিখ্যাত কবি। তিনি মনসা মঙ্গল কাব্যের স্রষ্টা। চৈতন্যোত্তর রামায়ণের কবি হিসেবে চন্দ্রাবতী বিখ্যাত হলেও নিজের জীবন কাহিনীর জন্যও লোকসমাজে তিনি যথেষ্ট সমাদৃত। কালের সাক্ষী হয়ে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নীলগঞ্জের কাচারিপাড়ায় তার স্মৃতিবিজড়িত শিব মন্দিরটি আজও লোকমুখে চন্দ্রাবতী মন্দির নাম ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার উৎসাহে চন্দ্রাবতী বাল্যকালেই কাব্যরচনা শুরু করেন। বাবা-মেয়ে যৌথভাবে রচনা করেছিলেন মনসার ভাসান। জনশ্রুতি আছে, ছোটবেলায় চন্দ্রাবতীর খেলার সাথী ছিল জয়নান্দ নামে এক ব্রাহ্মণ শিশু। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের এ সম্পর্ক ভালোবাসায় রূপ নেয়। চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ যৌবনে যখন একাত্ম হয়ে প্রেম যমুনায় ভাসছিলেন, তখনই বিচ্ছেদের অনল গ্রাস করে চন্দ্রাবতীর সরল হৃদয়।
পারিবারিক সম্মতিতে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিকও হয়। কিন্তু জয়ানন্দ হঠাৎ ধর্মান্তরিত হয়ে শাহানা নামে এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে পাণি গ্রহণ করেন। এ কথা শুনে বিরহদগ্ধ চন্দ্রাবতীর হৃদয় শোকে পাথর হয়ে যায়। তখন তিনি বাবা দ্বীজ বংশীর কাছে দুটি বাসনা ব্যক্ত করেন। এর একটি হলো ফুলেশ্বরী নদীতীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং আরেকটি হলো চির কুমারীর ব্রত নিয়ে রুদ্র মন্দিরে উপাসিকা হয়ে কাব্য সাধনার।
মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলে চন্দ্রাবতী যৌবনেই যোগিনী হয়ে মন্দিরে বসে শিবের আরাধনা ও কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। একসময় জয়ানন্দের কাছে স্ত্রী শাহানার রূপ, মোহ দিনে দিনে স্তিমিত হয়ে আসে। চন্দ্রাবতীর অতীত প্রেমস্মৃতি জয়ানন্দের মনের গহিনে নতুন করে যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। অপরাধী মন নিয়ে জয়ানন্দ ছুটে আসেন চন্দ্রাবতীর কাছে। কিন্তু মন্দির দ্বার বন্ধ করে চন্দ্রাবতী বাবার আদেশে তখন রামায়ণ রচনা করছিলেন। তিনি এতই ধ্যানমগ্ন ছিলেন যে, জয়ানন্দের দরজায় আঘাত ও অনুরোধ তার কানে পেঁৗছেনি। বহু ডাকাডাকির পর সাড়া না পেয়ে জয়ানন্দ তার অনুতাপের শেষ কথা মন্দির প্রাঙ্গণে লিখে ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দেন।
এরপর চন্দ্রাবতীর ধ্যান ভাঙলে মন্দিরের দরজা খুলে বাইরে এসেই জয়ানন্দের লেখা কবিতাটি দেখতে পান। কবিতাটি পড়ে জয়ানন্দের জন্য তার প্রেমাতুর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। পরে জয়ানন্দের বিশ্বাসঘাতকতার কথা স্মৃতিতে এলে তিনি জয়ানন্দের স্পর্শে মন্দির অপবিত্র হয়ে গেছে মনে করে ফুলেশ্বরী নদীতে এসে দেখেন, জলে জয়ানন্দের মৃত দেহ ভাসছে। এ দৃশ্য দেখার পর চন্দ্রাবতীও নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। বর্তমানে ফুলেশ্বরী নদীর অস্তিত্ব নেই। তবে মন্দির এখনও বিরহী প্রেমের স্মৃতি বুকে ধারণ করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পথিক ক্ষণিকের জন্য হলেও চন্দ্রাবতী মন্দিরের সামনে এসে এখনও থমকে দাঁড়ায়। স্মরণ করে অমর প্রেমের ট্র্যাজেডি।