মনিরউদ্দীন ইউসুফকে (১৯১৯-১৯৮৭) কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, শিশু-সাহিত্যিক, নাট্যকার, অনুবাদক ও সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা আখ্যায়িত করলে যেন ঠিক পুরোটা বলা হয় না। তার চেয়ে বরং এভাবে বলা যায়_ এসব শাখায় তিনি দীপ্তিময় এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যার সুস্থ সাহিত্য সাধনায় ঋদ্ধ হয়েছে বাংলার ভান্ডার। ১৯১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার গ্রামে তিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পারিবারিক পরিবেশে ফারসি, আরবি ও উর্দুর ব্যাপক চর্চা হলেও তিনি বাংলায় তাঁর সাহিত্যকীর্তিতে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থেকে সরে যান নি। এমনকি বিদেশি ভাষার বৈচিত্রময়তা-বিশেষ গুণপনা সবকিছুই বাঙ্ময় হয়ে তাঁর রচনায়। তাঁর জীবদ্দশাতে ২২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
তবে জীবদ্দশায় কিছুটা প্রচারবিমুখ এ সাহিত্য-সাধকের অনেক কিছুই আড়ালমুক্ত হয়নি। কিন্তু তাঁর প্রয়াণ পরবর্তী সময় যতটা সামনে এগিয়েছে ততটাই প্রোজ্বল হচ্ছে তাঁর কীর্তি। আর তাই বোধকরি ১৯৮৯ সালে ‘মনিরউদ্দীন ইউসুফ সংকলন’ নামে যে স্মারকগ্রন্থের আত্মপ্রকাশ সেটিও ২০০৯-এ এসে বর্ধিত কলেবরে প্রায় আট শত পৃষ্ঠার অবয়ব ধারণ করেছে। ‘মনিরউদ্দীন ইউসুফ স্মারকগ্রন্থে’র লেখক-কবি-সাহিত্য-সমালোচকের তালিকা ও তাঁদের বিশিষ্টতা প্রমাণ করে সত্যিই সীমিত সাহিত্যচর্চার এই দেশে মনিরউদ্দীন ইউসুফ কতটা কীর্তিমান ছিলেন!
এই স্মারকগ্রন্থে বিষয়ভিত্তিক মোট চারটি অধ্যায় রয়েছে। অধ্যায়গুলোর ক্রমবিস্তৃতি এরকম : সাহিত্য মূল্যায়ন (প্রবন্ধ ও গ্রন্থ-আলোচনা)-প্রথম অধ্যায়, স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ-দ্বিতীয় অধ্যায়, নিবেদিত কবিতা-তৃতীয় অধ্যায়, মনিরউদ্দীন, ইউসুফের রচনা-নিদর্শন (উদ্ধৃতাংশ)-চতুর্থ অধ্যায়। এর বাইরে পরিশিষ্ট, মনিরউদ্দীন ইউসুফের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি ও এই স্মারকগ্রন্থে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
বিশাল কলেবরের এই গ্রন্থটি শুধু পৃষ্ঠাধিক্যেই ভারী নয়, লেখার সংখ্যা ও গুণগত মানেও অনন্য। গদ্য ও কবিতা মিলে একশত আটানব্বইটি লেখা এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। সুদীর্ঘ এ তালিকা থেকে অন্তত বিশেষ কয়েকজন গদ্য লেখকের নাম উল্লেখ জরুরি। এরা হলেন-আনিসুজ্জামান, আফজাল চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দনি, আল মাহমুদ, আশরাফ সিদ্দিকী, আসাদ চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, কাজী মোতাহের হোসেন, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ মোদব্বের, শওকত আলী, শামসুর রাহমান, শাহেদ আলী, সানাউল্লাহ নূরী, সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলী আহসান, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ। এসব লেখায় ব্যক্তি মনিরউদ্দীন ইউসুফ সম্পর্কে যেমন আলোকপাত রয়েছে তেমনি তাঁর রচনা্ভান্ডারের সাহিত্যমান সম্পর্কিত বিশদ আলোকপাত রয়েছে। মনিরউদ্দীন ইউসুফের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় আনিসুজ্জামান ‘মনিরউদ্দীন ইউসুফ’ শিরোনামের লেখায় : তাঁর সৌম্য কান্তি, অপার বিনয় ও অসাধারণ সৌজন্য প্রথম দর্শনেই আমার মনে গভীর দাগ কেটে যায়। … পুরুষানুক্রমিকভাবে অর্জিত শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারা তিনি যে সহজে বহন করেছিলেন, ত তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়া মাত্র উপলব্ধি করা যেত। (পৃ. ১৩৩)
সুফিয়া কামালের মূল্যায়নে ব্যক্তি মনিরউদ্দীন ইউসুফের অনন্যতা স্পষ্টত। তিনি লিখেছেন : সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে অন্যের সম্ভ্রম বোধ তার মধ্যে প্রচুরভাবে ছিল তাই তার ব্যবহারে ‘তমিজ’ বলে ভঙ্গিমাটি আমাকে আকৃষ্ট করত। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় কোনো অনুষ্ঠান সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে অনেকে স্থান ত্যাগ করেন বা আসনে বসেই কিছু কিছু সমালোচনা করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তীকেও দলে টানেন। কিন্তু মনিরউদ্দীন ইউসুফ সামনের সারিতে ত বসতেনই না শেষ সারি থেকেও শেষ সমাপ্তি পর্যন্ত নিবিড় মনোযোগ দিয়ে কথা, বক্তব্য যার যা তা শুনে যেতেন। এই সৌজন্যবোধ আজকাল দুর্লভ। (পৃ.৪০০-৪০১)
মনিরউদ্দীন ইউসুফের ব্যক্তি-মানস এমন ছিল যে, তাঁর সংস্পর্শে সাধারণ-অসাধারণ যাঁরাই এসেছেন সকলে মুগ্ধ হয়েছেন। এই মুগ্ধতায় তাঁর ধীশক্তি, কর্মনিষ্ঠা ও সততা সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর এই ব্যক্তিত্বও অনেকাংশে প্রভাবান্বিত হয়েছে সাহিত্যকর্মে। সেই আভাস দিয়েছেন আবদুল হাই শিকদার। তিনি ‘লেখকের দুই সত্তা মনিরউদ্দীন ইউসুফ’ নিবন্ধে লিখেছেন : মনিরউদ্দীন ইউসুফ জা পাল সার্ত্র, উইলিয়াম গোন্ডিং, সৈয়দ আলী আহসান নন। তিনি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদও নন! বিরাট কীর্তি নেই তাঁর কাহিনী নেই। আন্তর্জাতিক আকাশেও নন নিবিড় মানুষ। ….তাঁর শত রকম গুণটুন যাই থাক। তা এই একটি কারণে হতে পারে, লেখকের ব্যক্তিত্ব এবং তার লেখা এ দুটি জিনিসকে তিনি এক পাত্রে গুলে চমৎকার দেখিয়ে গেছেন। (পৃ ২৬৭)
সময়ের চিহ্ন ধারণ করে সাহিত্য। আর সাহিত্যে ব্যক্তি-মানস, পরিবার-সমাজ তথা রাষ্ট্রিক পরিম-ল বিবৃত হয়। মনিরউদ্দীন ইউসুফ এই পরিম-লে যে পরিভ্রমণ শুরু করেন তার সূক্ষ্ন বিশ্লেষণ সমগ্র সাহিত্যকর্মেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য : ‘মনে পড়ে তিনি একদিন ঈসা খাঁ নাটকের পা-ুলিপির একাংশ নিয়ে এসেছিলেন আমাকে শোনাতে। …ঐতিহাসিকভাবে বাঙ্গালির স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা প্রিয়তা, আত্মসম্মানবোধ এবং অনুপম বীর্য দেখতে পেয়েছিলেন ঈসা খাঁর মধ্যে। বাঙ্গালি জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত মনিরউদ্দীন ইউসুফকে দেখতে পাই বিশেষ করে এই নাটকে।’ (আবু সাঈদ চৌধুরী, মনিরউদ্দীন ইউসুফ স্মরণে, পৃ ৪২০-২১)
কবি আল মাহমুদ সরল স্বীকারোক্তি করেছেন মনিরউদ্দীন ইউসুফের মৌলিক কবিতা ও অনুবাদ-কর্ম সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন : তাঁর কবিতা ও গজলের মধ্যে আমার জন্য তৃপ্তিকর অনেক বিষয়ই আমাকে উজ্জীবিত করে। হঠাৎ পেয়ে যাই এমন শব্দ ও শিকড় যা আমার মধ্যে এক মহীরুহ হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে দিতে থাকে। যাকে আমরা বলি অনুপ্রেরণা। যে কবি অন্য কবিকে কবিতা রচনার উপাদান যোগাতে পারেন তিনি কখনো তার স্বজাতির কাছে বিস্মৃত হন না।’ (মনিরউদ্দীন ইউসুফ : আল মাহমুদ, পৃ ১২০)
মনিরউদ্দীন ইউসুফ বহুভাষাবিদ ছিলেন। তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু তো জানতেনই, কিছুটা জানতে সংস্কৃত ভাষাও। আর এজন্য মৌলিক সাহিত্যকর্ম-কবিতা, উপন্যাস, কিশোর রচনাসহ অন্যান্য সাহিত্যকীর্তির বাইরে অনুবাদও উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে-তিনিই একমাত্র পূর্ণাঙ্গরূপে মহাকবি ফেরদৌসীর শাহনামা অনুবাদ করেছেন। এর বাইরেও রুমি, জামি, হাফিজ, গালিবেরও অনেক ফারসি-উর্দু সাহিত্য অনুবাদ করেছেন। এ অনুবাদকর্মে তিনি প্রত্যেকটি শব্দের মর্মার্থ এমনকি পাদটিকাও লিখেছেন।
একজন সাহিত্যব্রতীর বড় পরিচয় যেকোনো বিষয়কে সহজ-বোধগম্য করে উপস্থাপনের অনন্য কৌশল। সেদিক থেকে কবিতা-উপন্যাস কিংবা কিশোর সাহিত্যে তিনি অত্যন্ত সফল। একইভাবে অনুবাদ কর্মেও তার সাবলীল-গতিশীল কথনরীতি, বর্ণনাভঙ্গি, শব্দ চয়ন কোনটাই অগ্রাহ্য করবার উপায় নেই। তাই তো রুমীর মসনবী অনুবাদে তিনি স্বাভাবিক অথচ দৃঢ় প্রত্যয়ে লেখেন : ধর্মীয় আচার-আচরণগুলির উৎপত্তি যে সমাজ সংস্থানের অনুকুলে ছিল, তাহা পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে। হয়ত সেই আচার এখন ব্যক্তি বা সমাজমানুষকে উন্নত জীবনে উদ্বুদ্ধ করিতে অপারগ; হয়ত তাহা বর্তমান জীবনের অগ্রগতির জন্য বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। (রুমীর মসনবী, পৃ ১৯৩-৯৪)
সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি অধায়ে মনিরউদ্দীন ইউসুফের জন্ম, বেড়ে ওঠা, সাহিত্যকীর্তির মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা (গ্রন্থের প্রকৃতি, প্রকাশক, প্রকাশের সাল, পৃষ্ঠাসংখ্যা ইত্যাদিসহ ৩৭টি গ্রন্থের নাম) তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরেও ১৯৯৩ সালে (মরণোত্তর) একুশে পদকসহ অন্যান্য পুরস্কার প্রাপ্তি ও প্রকাশিতব্য গ্রন্থসূহের নাম অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে।
মনিরউদ্দীন ইউসুফ স্মারকগ্রন্থে যেসব লেখক, কথাসাহিত্যিকের রচনা ছাপা হয়েছে তাদের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও গ্রন্থের শেষের দিকে সনি্নবেশিত হয়েছে। ছোট্ট কাজের এই ফলে পাঠকদের শুধু মনিরউদ্দীন ইউসুফ, তাঁর কীর্তির সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি শতাধিক লেখক-কবির জানা-অজানা তথ্য গোচরে এসেছে। এটি নি:সন্দেহে প্রশংসনীয়।
এই গ্রন্থের শেষে মনিরউদ্দীন ইউসুফের নিজের বিভিন্ন সময়ের ও নিকট আত্দীয়দের কয়েক জনের বেশকিছু ছবি ছাপা হয়েছে। এই ছবির মাধ্যমে তাঁর বংশ মর্যাদা, বংশ-পরম্পরা, পারিবারিক আভিজাত্য ও তৎকালীন প্রেক্ষাপটের চিত্র পাওয়া যায়।
মনিরউদ্দীন ইউসুফ স্মারকগ্রন্থ পাঠে একথা সর্বৈবভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ব্যক্তির চেয়ে তাঁর সাহিত্যকীর্তিই প্রাধান্য পেয়েছে অধিকাংশের লেখায়। আর এটাই হওয়া উচিত। বাংলা সাহিত্যে একজন ব্যক্তি মনিরউদ্দীন ইউসুফের চেয়ে শত গুণ জরুরি তাঁর অমূল্য রচনাসম্ভার।
এই লেখার শেষটা কবিতা দিয়ে হতে পারে। যে কবিতায় মতিউর রহমান মলি্লক প্রকৃত মনিরউদ্দীন ইউসুফকে কিছুটা হলেও অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন :
# কিছু কিছু মানুষের পদছাপ
# চিরদিন রয়
# জানি অক্ষয়
# সূর্যের মত পূত নিষ্পাপ।
# কিছু কিছু পুষ্পের গন্ধ
# মন করে সুঘ্রাণে অন্ধ
# ঝরেও ঝরে না তার পাপড়ি
# ধরে রাখে ফাগুনের উত্তাপ
মনিরউদ্দীন ইউসুফ স্মারক গ্রন্থ # সম্পাদনা : বেলাল চৌধুরী # প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯ # সংশোধিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ : ফেব্রুয়ারি ২০০৯ # প্রচ্ছদ : সমর মজুমদার # প্রকাশক : কালান্তর প্রকাশনী # মূল্য : আট শত টাকা।
লিখছেনঃ হো সে ন শ হী দ ম জ নু