এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং। বানিয়াচং উপজেলার দৌলতপুরে আমার মামার বাড়ি। বানিয়াচুং আয়তনে এতই বড় যে, এ গ্রামে চার এর অধিক ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক এবং প্রাচীন গ্রাম। ইতিহাসের অনেক নিদর্শণ এ গ্রামের ঐতিহ্যের নিরব স্বাক্ষী। অতীতে এর বিশালত্ব বর্ণনা করতে বলা হতো, ‘ছ’কুড়ি ঘর চৌকিদার; ‘ন’কুড়ি ঘর ফকির’ আছে এ গ্রামে। হাওরের অন্য এলাকার মত এখানেও অভাব অনটন ছিল। চারিদিকে বিশাল, বিস্তৃর্ণ মাঠ কিন্ত সেচাভাবে তা পতিত থাকে, বর্ষাকালে ‘জলিধান’ চাষই একমাত্র ভরষা ছিল। বর্ষার ছ’মাস, বেকার, কোন কাজ ও আয়-রুজির ব্যবস্থা নাই। ফলে, অন্য কোন উপায় না পেয়ে ঐ এলাকার অনেকে সপরিবারে হাড়ি পাতিল নিয়ে ‘ছৈ’ দেয়া নৌকায় সংসার পেতে পুরো বর্ষার সময় গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভিক্ষা করত।
সেই বানিয়াচুং এর দৌলতপুরে, দুবাই ফেরত আমার এক খালাত ভাই তাঁর ‘মানত’ বা ছদকার বড় একটা ‘রাতা’ (বড় মোরগ) দান করার জন্য তিন দিন পলোয় আটকিয়ে রাখতে বাধ্য হন, ভিক্ষুকের অভাবে। এ ক’দিন একজন ভিক্ষুকও আসে নাই, যাকে এটা দান করা যায় ! শুধু হাওরাঞ্চলে নয়, সারা দেশেই এমন অবস্থা অর্থাত ভিক্ষুকের আকাল দেখা দিয়েছে। আগে যেখানে গ্রামে দল বেঁধে নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধা ভিক্ষা করতে দেখা যেত । এখন আর সেই চিত্র খুঁজে পাবেন না। ফকির মিসকিন আর আগের মত পাওয়া যায় না। দাওয়াত দিয়েও আনা যায় না। আগের মত রবাহুত হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক ছুটে আসার ত প্রশ্নই আসে নাই। গ্রামে কাজের লোকের বড় অভাব। রাজনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ ‘কাঙ্গালী ভোজ’ এখন কাঙ্গালের অভাবে ‘গণ ভোজ’ এ রুপান্তরিত হয়েছে । এ অবস্থা সৃষ্টির পিছনে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মূখী উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের ফলে।
হাওরাঞ্চলে সুদিনে (শুস্ক মৌসুমে) দিগন্তজোড়া সবুজ পতিত গো-চারণ ভূমি ‘গো পাট’, বর্ষায় সমুদ্রসম স্বচ্চ কালো জলরাশি, ছ’মাস কাজ, ছ’মাস বেকার-এ হচ্ছে হাওরাঞ্চলের চিত্র। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার জার্মানী হতে বিশেষ বিমানে করে হাজার হাজার সেচের পাম্প এনেছিল। এর সিংহভাগ হাওরাঞ্চলের জন্য বরাদ্দ দিয়ে বিএডিসির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ইরি ধানের বীজ, কলের লাঙ্গল, সার, ফ্রি কীটনাশক বিতরণ, আর বিমান থেকে কীটনাশক ছিটানোর ফলে হাওরাঞ্চলের পতিত ‘গো-পাট’ হয়ে উঠে সবুজ শ্যামল ‘শস্য ভান্ডার’। হাওর এলাকা পরিণত হয় ‘খাদ্য উদ্ধৃত অঞ্চল হিসাবে। হাওরবাসির ‘ছনের ঘর’র জায়গায় তৈরী হয়েছে চকচকে রঙিণ ঝিলিক দেয়া রুপালি টিনের দ্বোচালা-ঘর। অনেকেই তখন ‘লাখপতি’ বনে গিয়েছিল। হাওরবাসির এই যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, তার পিছনে ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের দুরদৃষ্টি সম্পন্ন মনোভাব। কৃষকের গোলা যখন সোনালী ধানে ভরে উঠে, অভাব তখন জানালা দিয়ে পালায়।
তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার কৃষির প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ায় প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়েছে। সেচ, সার, চাষ, উন্নত বীজ, কীটনাশক, কৃষি ঋন, উন্নত প্রযুক্তি, ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্য কেন্দ্রে সঠিক পরামর্শ, ভূর্তকি মূল্যে যন্ত্রপাতি এবং পরামর্শ প্রদাণের ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতার পথে । আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন ‘সেরেস পুরশকার’ পায় এবং চাহিদা মিটিয়ে কিছু চাল রপ্তানীও করা হয়েছে। কচু, গেচু, আটা, কাউন, ঝাউ ভাত্ চাল+আলুর ভাত খাওয়ার দিন শেষ। প্রতিদিন মানুষ দু মুঠো ভাত খেতে পায়। দেশে শিল্প কারখানা বৃদ্ধি, গার্মেন্টস শিল্প স্থাপনে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মানুষের আয় বেড়েছে। পোষাক আসাক, এবং আহারে ব্যাপক পজিটিভ পরিবর্তন ঘটেছে। শায়েস্তা খাঁ’র আমলে টাকায় ৮ মন চাল পাওয়া যেত, কিন্ত সব মানুষ খেতে পেত কিনা জানিনা ? তবে এখন আর মানুষ না খেয়ে মারা যায় না। একদিনের ‘কামাই’ দিয়ে ৮-১০ কেজি চাল কেনা সম্ভব। ভিক্ষা বৃদ্ধি নিবারণেও সরকার বিভিন্ন কর্মসূচী পরিচালনা করছে। তৃণমূল মানুষের অভাব দূরীকরণে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি অন্যতম নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে চলেছে। একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প এ ক্ষেত্রে সয়াহয়ক হয়েছে।
সমাজে সাধারণত দুঃস্থ মহিলা, বৃদ্ধা, বিধবা, পঙ্গু লোকজন ভিক্ষা বৃত্তিতে নিয়োজিত হয় । সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাতা চালু/সহায়তা উপকরণ বিতরণের ফলে অসহায় এ সব মানুষ ভিক্ষা বৃত্তি হতে নিবৃত হয়েছেন। কাজের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি মানুষ কে স্বাবলম্বি করেছে । বাড়িতে আত্নীয় স্বজনদের আত্নার দোয়ার জন্য ফকির মিসকিন খাওয়াবেন, খুঁজে পাওয়া মুশকিল । এবার আবার গর্ভবতি মহিলা, দুগ্ধদানকারি মা’দের জন্য বিশেষ ভাতা চালু হতে যাচ্ছে । স্কুল ফিডিং একটি ভাল উদ্যোগ। ছাত্রীদের উপবৃত্তি চালু, শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ, বিনামূল্যে বই বিতরণ মানুষের জীবনকে সহজ করেছে। সরকারের এ সব কর্মসূচী দারিদ্র কে জিইয়ে রেখে কিছু সংগঠনের ‘দারিদ্র দূরিকরণ’ ‘খেল’ সাঙ্গ করে দিচ্ছে। ভিক্ষার অভাবকে দূর্ভিক্ষ বলা হয়। ভিক্ষুকের অভাবকে কি বলবো? ক্যাসেঞ্জেরি উক্তি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ কে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ‘ঝুড়ি ভরে উপছিয়ে পরা’ খাদ্যে স্বাবলম্বি দেশে পরিণত হয়েছে ।
বিশ্বের বিস্ময় ক্ষুধা, দারিদ্র মুক্ত আমার সোনার বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালবাসি !