জানা গেছে, মেনলে ম্রোর জন্ম বান্দরবান জেলা সদরের চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে পোড়া পাড়ায়। তাঁর পিতার নাম মেনসি ম্রো ও মাতার নাম তুমতো ম্রো। শিশুকাল থেকে মেনলে ছিলেন অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা। সদা চিন্তাশীল ও ধ্যানমগ্ন থাকতেন তিনি। লেখাপড়া ও জ্ঞানার্জনের প্রতি ছিল তাঁর অত্যাধিক আগ্রহ।বান্দরবান থেকেপাড়ায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় অনেকদিন শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকতে হয়েছে মেনলে ম্রোকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে ১৯৮০ সালে বান্দরবান সদরের সুয়ালকে চালু হয় ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়।
খবর পেয়ে ছুটে এলেন মেনলে। কিন্তু বেশি বয়সের কারণে ভর্তি করতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। স্বাভাবিক নিয়মে ভর্তি হতে না পেরে মেনলে স্কুল ক্যাম্পাসেই শুরু করলেন লাগাতার অনশন। স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক টি এন মং তাঁকে ভর্তি করে নিতে বাধ্য হলেন। এ ঘটনার চার বছরের মাথায় ম্রো জনগোষ্ঠীর সেই ছেলেটিই সবাইকে চমকে দিয়ে উদ্ভাবন করেন নিজ ভাষার বর্ণমালা।
১৯৮৫ সালে মেনলে ম্রো নামের ২২ বছরের এক যুবক বান্দরবানের পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন- ‘আমি ক্রামাদি’ (প্রেরিত পুরুষ), থুরাই (সৃষ্টিকর্তা) থেকে আমি মুরুংদের ধর্ম ও বর্ণমালা নিয়ে এসেছি।’মেনলের কথা প্রচারিত হলে চমকে উঠে বান্দরবানের মুরুং সমাজ।
১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল নিজ গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তিনি তাঁর নতুন উদ্ভাবিত ‘ক্রামা বর্ণমালা’ প্রকাশ করেন। একই সময় প্রবর্তন করলেন ক্রামা ধর্ম। একই সঙ্গে ধর্ম ও বর্ণমালা আবিষ্কারের ঘটনা সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে সেই প্রথম। সে বছরই বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী ম্রো সম্প্রদায়ের সদস্যরা চাঁদা তুলে পোড়াপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন ভাষা ও বর্ণমালা শিক্ষাকেন্দ্র। বর্তমানে ম্রো বর্ণমালায় সাক্ষরতার হার ৬০ শতাংশ। ম্রো গবেষক সিং ইয়ং ম্রো আশা করছেন, অল্প সময়েই এটি শতভাগে উন্নীত হবে।
জানা গেছে, স্কুলে পড়ালেখার সময় মেনলে ম্রো প্রায়শই নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। পরে যানা যায়, মেনলে গভীর অরণ্যে গিয়ে আত্মসাধনায় গভীর মনোযোগী হয়ে যেতেন। ১৯৮৫ সালে মেনলে পঁঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ওইসময় মেনলে পুনরায় নিঁখোজ হন। এর কিছুদিন পর হঠাৎ আবার মেনলের সন্ধান মেলে।
মুরুংদের কেউ কেউ দাবী করেন, আরকান ও ভারত হয়ে হিমালয়ে গেছেন মেনলে ধ্যান করতে। মেনলে যাবার সময় বলে গেছেন, ‘আমি জ্ঞান সাধনায় গেলাম। আবার ফিরে আসবো।’ ক্রামা ধর্মমত অনুসারীরা মনে করেন, একদিন তাদের ত্রাতা ও নেতা ফিরে আসবেন।
১৯৮৬ সালের ১১ ডিসেম্বর এই ধর্মপুরুষের দেখা পান লামার সাংবাদিক রুহুল আমিন। তিনি জানান, মেনলে তাকে বলেছেন, আমি স্বজাতি মুরুংদের জন্য ‘বর্ণমালা’ ও থুরাই থেকে ‘ক্রামাদি’ পেয়েছি। মুরুংরা খুবই দরিদ্র ও নিরক্ষর জাতি। ধর্মও বুঝে না, লেখাপড়াও জানে না। এখনো তারা আদিম স্তরে। মুরুংরা শান্তি চায়, শিক্ষা চায়, সরকারের ভালবাসা-আদর-সোহাগ চায়।
ইতোমধ্যে পাহাড়ের মুরুংদের মাঝে বয়ে গেছে এক ধর্মবিপ্লব। এখন মুরুং সমাজের শত সহস্র লোক মেনলে প্রবর্তিত ধর্মমতে বিশ্বাসী। মেনলে প্রবর্তিত মুরুং বর্ণমালা দিয়ে তৈরী হয়েছে বই-পুস্তুক। স্বার্থক মেনলে ম্রো! জয় হোক এই মহান পুরুষের!