তিনি বিদ্রোহী,তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী।তিনি আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সারা জীবনই তিনি কলম ধরে গেছেন ব্রিটিশের শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে,অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতার জন্য। সেই বিদ্রোহী কবি আজ আর আমাদের মাঝে নেই।কিন্তু বেঁচে আছে তাঁর ঐতিহাসিক লেখনী।

 “মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,  আমি সেই দিন হব শান্ত,  যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—”

সেই বিদ্রোহী কবি নজরুল ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লিখে একবার ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন। এক বছর তাঁর কারাদণ্ড হয়। সেই সময় তাঁকে আনা হয় পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার হুগলি কারাগারে। এখানেই তিনি কাটান তাঁর বন্দিদশার ৬৫টি দিন। এখানেই তিনি একনাগাড়ে টানা ৩৪ দিন অনশনও করেছিলেন। তারপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ভারতের বিশিষ্টজনদের অনুরোধে প্রত্যাহার করেছিলেন অনশন।

আজও আছে হুগলির সেই প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক কারাগার। এখনো এটি রয়েছে সেই হুগলি নদীর একেবারে পাড় ঘেঁষে হুগলির জেলা সদর চুচুঁরায়। এখন অবশ্য ভারতের কোনো কারাগারকে আর কারাগার বলা হয় না, বলা হয় সংশোধনাগার।পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলার মসনদে বসে ব্রিটিশরা। এরপর ১৭৯৬ সালে হুগলির বড়বাজারের মাঝে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে প্রথম তৈরি করা হয় একটি বন্দিশালা। হুগলি কারাগারের ৫ নম্বর কক্ষে বন্দিজীবন কাটিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি।

হুগলির এই কারাগারের প্রবেশদ্বারের দুদিকে দুটি ফলক লাগানো রয়েছে। বাঁ দিকের ফলকটিতে নজরুলের বন্দিজীবনের কথা শ্বেতপাথরে উৎকীর্ণ রয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘বিদ্রোহী কবি নজরুলের স্মরণে’। এখানেই লেখা রয়েছে কত দিন এবং কবে নজরুল বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। এই ফলক লাগিয়েছে হুগলি-চুচুঁরা নজরুল স্মৃতি সংরক্ষণ সমিতি। আর ডান দিকের ফলকে রয়েছে হুগলি কারাগারের ইতিহাস। এই কারাগারের সামনের সড়কের অন্যদিকে রয়েছে নজরুলের একটি আবক্ষ মূর্তি। আর মূর্তির পেছনে হুগলি নদী।

তখন ১৯২২ সাল। ২৬ সেপ্টেম্বর নজরুল তাঁরই সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামের একটি কবিতা প্রকাশ করেন। কবিতাটি ভালো লাগেনি তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের। এর পরই ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হন কবি। তাঁকে কোমরে দড়ি বেঁধে কলকাতার তৎকালীন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইন হোর আদালতে তোলা হলে কবিকে সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। কবি তাঁর এই সশ্রম কারাজীবন কাটান আলীপুর, বহরমপুর ও হুগলি কারাগারে।

এই কারাগারে থাকাকালে কবি জেলে বন্দীদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও অব্যবস্থার প্রতিবাদে টানা ৩৯ দিন অনশনও করেন। এই অনশনকালীন সময়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কারাগারে দেখা করতে আসেন নজরুলের সঙ্গে। শুধু তা-ই নয়, সেদিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে একটি টেলিগ্রাম করে কবি নজরুলকে অনশন প্রত্যাহার করার অনুরোধও জানান। এমনই একটি অনুরোধবার্তা নজরুলকে পাঠান দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও।

 সেই টেলিগ্রাম দুটি এখনো সংরক্ষিত রয়েছে হুগলির এই কারাগারে। বলা বাহুল্য, এই হুগলির কারাগারে ব্রিটিশবিরোধী, স্বাধীনতাসংগ্রামী গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, শশধর আচার্য, সুহাসিনী গাঙ্গুলির মতো বিপ্লবীরাও বন্দিজীবন কাটিয়েছিলেন।হুগলি কারাগারের যে কক্ষে নজরুলের বন্দিজীবন কেটেছে, আজ সেটি সংরক্ষণ করে সাধারণের দর্শনের জন্য খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কারা কর্তৃপক্ষ। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (কারা) বংশীধর শর্মা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমরা চাইছি কবি নজরুল যে কারাকক্ষে ছিলেন, সেটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক সাধারণ মানুষের দর্শনের জন্য। চাইছি সেদিন যেভাবে ছিল নজরুলের সেই ৫ নম্বর সেল, সেভাবেই রাখা হোক সেটি।

এ লক্ষ্যে আমরা এরই মধ্যে বিষয়টি তুলে ধরেছি রাজ্য সরকারের কাছে। আমাদের কারামন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরীও এই উদ্যোগের সবুজ সংকেত দিয়েছেন।’ শর্মা আরও বলেছেন, ‘হুগলি জেলে রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা। আমরা এই কারাগারকে সাজিয়ে তুলতে পারলে এটি হবে পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণের কেন্দ্র। আমরা নজরুলের কক্ষে একটি আবক্ষ মূর্তিও স্থাপন করব। সেই মূর্তিটি আমরা চাইছি আমাদের বন্দীরাই তৈরি করুক। এরই মধ্যে বন্দীরা নজরুলের মূর্তি তৈরি করার কাজে নেমেও পড়েছে।

 আমাদের ইচ্ছা নজরুলের সেই ঐতিহাসিক কারাকক্ষটিকে সাজিয়ে তুলে সেটি শিগগির জনসাধারণের জন্য উৎসর্গ করার।’ এর ফলে দূরদূরান্ত এবং দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকেরা হুগলির এই কারাগারের নজরুলের স্মৃতিবাহী সেই ঐতিহাসিক বন্দিশালা দেখতে পারবেন। আর সেই লক্ষ্যেই এই কারাগারের এই কক্ষটিকে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন বিভাগ ওই কক্ষটিকে সার্কিট ট্যুরিজমের একটি অঙ্গ হিসেবে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

 এখন নজরুলের সেই ঐতিহাসিক বন্দিশালাকে সাজানো হবে। রাখা হবে এই কারাগারের কবি নজরুলের বন্দিজীবনের নানা তথ্য ও স্মৃতিকথার প্রামাণ্য দলিল। শুধু তা-ই নয়, এই কক্ষে বসানো হবে নজরুলের একটি আবক্ষ মূর্তিও। যদিও এখন নজরুলের ওই কক্ষে তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে রাখা হয়েছে।

প্রথম  আলো