বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুদীর্ঘকালের। ‘বঙ্গ’ যখন বঙ্গভাষী জনঅধ্যুষিত একটি ক্ষুদ্র অংশ, তখনই বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে। এ কথা বলার তাত্পর্য এই যে, বাংলাদেশ বলতে ইংরেজ শাসন আমলে যে বিশাল ভূখণ্ডকে বোঝানো হতো, হাজার বছর পূর্বে তা ছিল না। তখন বাংলাদেশ নানা জনপদে বিভক্ত নানা নামে অভিহিত হত এবং প্রতিটি জনপদ স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে শাসিত হতো। ঐতিহাসিকদের ধারণা, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত বাংলদেশ বঙ্গ, পুণ্ড্র, গৌড়, রাঢ়, সুহ্ম, তাম্রলিপ্তি, সমতট, হরিকেল প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত ছিল।
সপ্তম শতাব্দীর প্রথম পাদে শশাঙ্ক গৌড়ের রাজপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জনপদগুলো এক রাষ্ট্রীয় ঐক্য লাভ করে। এরপর থেকে পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন, গৌড়, বঙ্গ—এই তিনটি জনপদই যেন বাংলাদেশের সমার্থক হয়ে ওঠে। তবে এও সত্য, শশাঙ্ক বঙ্গভাষাভাষী সমগ্র জনপদকে তাঁর শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হননি। প্রকৃতপক্ষে এই কাজটি সম্পন্ন হয় চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সুলতান শামস্উদ্দীন ইলিয়াস শাহের রাজত্বকালে (১৩৪২-৫৭)। ইলিয়াস শাহ কর্তৃক সমগ্র বাংলাদেশ বিজিত হওয়ার পর বাংলা শব্দ সারা বাংলাদেশ নির্দেশ করার কাজে ব্যবহূত হয়। উল্লেখ্য, ‘বঙ্গ’ থেকে ‘বাঙলা’ নামের ব্যুত্পত্তি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতান্তর রয়েছে। কারো কারো ধারণা ‘বঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে ‘আল’ প্রত্যয় যোগে বঙ্গাল বা বাঙলা নামের উত্পত্তি। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলাদেশ ‘সুবে-বাঙলা’ নামে পরিচিত হয়। অতঃপর ইউরোপীয় পর্যটকেরা এই দেশকে বাঙ্গালাহ, বেঙ্গালা, বেঙ্গল ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেন। ইতিহাসের আরো একটি ধারার প্রতি এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। তাহলো বঙ্গের ন্যায় হয়তো ‘বঙ্গাল’ নামক একট প্রাচীন জনপদ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এদেশে বর্তমান ছিল। আর সেই জনপদের মানুষকেই বাঙালি নামে অভিহিত করা হতো। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’- এর একটি গীতে এর নিদর্শন অতি স্পষ্ট। চর্যাপদের অন্যতম পদকার ভুসুকুপাদের একটি পদে তিনি কীভাবে জাত্যান্তরিত হলেন তার পরিচয় দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলি’ অর্থাত্ আজ ভুসুকু বাঙালি হলো। ভুসুকু এই সংগীতের আরো একটি চরণে বঙ্গাল নামক দেশটিরও উল্লেখ করেছেন। যেমন ‘অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ’ অর্থাত্ অদ্বয়রূপ বঙ্গালদেশ লুট করলাম।
ভুসুকুপাদের উপরিউক্ত চরণ দুটি থেকে বঙ্গাল নামক দেশ এবং বাঙালি নামক জাতির পরিচয় লাভ করা যায়। উল্লেখ্য, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে চর্যার কাল বলে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, হাজার বছরের অতীত ইতিহাসে বাঙালি জাতি কর্তৃক বাঙলা শাসিত হয় মূলত সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সুদীর্ঘ কয়েকশ বছর পাল সম্রাটদের দ্বারা। পালেরা ছিলেন এ দেশের ভূমিজ সন্তান। গৌড় ছিল তাদের রাজধানী। পালেরা ধর্মে বৌদ্ধ, জাতিতে বাঙালি ছিলেন বলেই তাদের সময় প্রাকৃত ভাষায় তথা প্রকৃতজনের অর্থাত্ সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার সর্বপ্রথম বৌদ্ধতান্ত্রিক সিদ্ধাচার্যরা ধর্মকথা সংগীতাকারে লিপিবদ্ধ করেন। এর ফলে একদিকে যেমন বাংলা ভাষা হাঁটি হাঁটি পা পা করে পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তেমনি সেই ভাষাকে কেন্দ্র করে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের পথটিও উন্মোচিত হয়।
এমনিভাবে সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক উত্থান-পতন, বিভিন্ন রাজশক্তির আগমন-নির্গমনের মধ্য দিয়ে বাঙলার বিভিন্ন জনপদের একত্রীকরণ ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার ঐক্য সাধনের মধ্য দিয়ে এক সুবিশাল ও সুমহান জাতি গড়ে ওঠে। ইতিহাসে এই দেশই বাংলাদেশ এবং এই জাতিই বাঙালি নামে পরিচিত। বাংলাদেশ যেমন বিভিন্ন অঞ্চল বা জনপদের সমন্বয়ে গঠিত, বাঙালি জাতিও তেমনি বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর মিশ্রণে পরিপুষ্ট। নৃতত্ত্বের বিচারে বাঙালি রক্তে নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়, আলপানীয়, নর্ডিক, সেমেটিক, ইউরোপীয় প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর প্রভাব স্পষ্ট। প্রাগৈতিহাসিক কালে বঙ্গের সমগ্র জনগোষ্ঠী যে বাঙালি নামে অভিহিত হত না, পূর্বে তা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আর্যাভিযানের পর থেকে ঐতিহাসিকরা এ দেশের প্রকৃত জনগোষ্ঠীকে সামগ্রিক পরিচয়ে ‘অনাযর্’ নামে অভিহিত করতে থাকে। আর্যেরা উত্তরাপথ হয়ে যত সহজে মগধ পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়, অনার্য অধ্যুষিত বঙ্গভূমি তত সহজে তারা পদানত করতে পারেনি। না পারার কারণ, অনার্যরা ক্ষাত্রশক্তির দিক থেকে আর্যদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।
এতদসত্ত্বেও শুধু সঙ্ঘশক্তির অভাবে তাদের আর্যদের কাছে পরাভব স্বীকার করতে হয়। এর ফলে ধীরে ধীরে অনার্যেরা আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির নানা দিক দিয়ে প্রভাবিত হতে থাকে। কিন্তু বহিরাগত বিভাষী ও বিধর্মী বিজয়ী জাতি বিদ্যা-বুদ্ধি, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে যত উন্নতই হোক না কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসিতদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে একেবারে উপেক্ষা করতে পারে না। আর্যেরাও পারেনি অনার্য ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করতে, ধ্বংস করা তো দূরের কথা। তার ফলে সংখ্যালঘু আর্যরা ধর্মীয় আচার-আচরণ ও বিশ্বাস-সংস্কারে অনার্য সমাজকে যতটা না প্রভাবিত করতে পেরেছে, তার চেয়ে বরং তারাই অধিকতরভাবে অনার্য সংস্কৃতির নানা বিষয়কে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। যে কারণে একেশ্বরবাদী আর্যরা গ্রহণ করেছে অনার্যদের প্রকৃতি-পূজার রীতি-পদ্ধতি। বৈদিক বিশ্বাস-সংস্কারের সঙ্গে অবৈদিক লৌকিক দেব-দেবীকে আর্যীকরণে বাধ্য হয়েছে একইভাবে।
সৃষ্ট হয়েছে পুরাণ; বেদের অদ্বৈতবাদী সাধনা অচিরেই পুরাণের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে বহুদেবত্ববাদী সাধনায়। অনার্যরা আর্যদের কাছ থেকে সেইটুকুই মাত্র গ্রহণ করেছে, যেটুকু তাদের চিরাচরিত বিশ্বাস-সংস্কারের সঙ্গে সাদৃশ্য ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। অনার্য সমাজ-মানসের এই দৃঢ়তার পরিচয় পরবর্তীকালে সেমেটিক তথা মুসলিম শাসকদের এবং তারও পরবর্তীকালে এ দেশের ইউরোপীয় শাসকদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে একইভাবে হার মানাতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন রাজশক্তির উত্থান-পতনের ফলে রাজ-ধর্মকে এ দেশের অনেকেই গ্রহণ করেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের চিরাচরিত বিশ্বাস-সংস্কারকে কোনো না কোনোভাবে সর্বদাই লালন করে এসেছে। বঙ্গের আদিম জনগোষ্ঠীর ওপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী শাসকদের আগমন-নির্গমন, বঙ্গে তাদের অনেকেরই বসতি স্থাপনের ফলে এদেশের আদিম জনগোষ্ঠী তাদের রক্তের অবিমিশ্রতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে বাঙালি জাতি পরিণত হয়েছে এক রক্তসঙ্কর জনগোষ্ঠীতে। বাংলার মুসলিম সংস্কৃতির স্বরূপ dynamic অর্থাত্ গতিশীল। পরিবর্তন ও পরিমার্জনায় তার প্রাণ।
বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের ঐতিহ্য এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাংলার মুসলিম সমাজে যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে একেকটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব যার বিশেষ দৃষ্টান্ত। বঙ্গ বিভক্ত হয়ে পড়ায় এবং জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটায় পূর্ববঙ্গের উচ্চবিত্তের অধিকাংশ হিন্দু দেশ ত্যাগ করে। ফলে বাঙালি মুসলিম সমাজের ওপর হিন্দুদের ধর্মীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তা ধীরে ধীরে অপসৃত হতে শুরু করে। তাছাড়া পাকিস্তানে মুসলিম রেনেসাঁ ক্রমান্বয়ে শক্ত ভীত প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। দেশের পশ্চাত্পদ বাঙালি মুসলিম সমাজেও শিক্ষার আলোকরশ্মির প্রভাব পড়ে। এর ফলে সমাজ পরিবর্তনের একটা শুভ সূচনার উদ্ভব ঘটে। ইতিপূর্বে মুসলিম সমাজে যেসব ধর্মীয় অপসংস্কৃতির প্রভাব পাথরের ন্যায় বুকে চেপে বসেছিল, যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সে বোঝা নেমে যেতে শুরু করে। ধর্মের সঙ্গে যে সংস্কৃতির কোনো সংঘাত নেই এ সত্য শুধু আমাদের দেশের মুসলিম সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, সারা বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রের স্ব স্ব সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক বির্বতন যে থেমে নেই কতিপয় দৃষ্টান্ত থেকে তা প্রতীয়মান হবে।
মুসলিম সমাজের ধর্মীয় উত্সব মূলত দুটি; ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। এ দুটি উত্সবে সর্বস্তরের মুসলিম পরিবারে নববস্ত্র পরিধান, নামাযান্তে পুরুষে পুরুষে আলিঙ্গন এবং নানা প্রকারের মিষ্টান্ন ও কোরমা-পোলাও খাবারের ধুম পড়ে যায়। তবে নিরন্ন ও ছিন্নবস্ত্র পরিধেয়দের সংখ্যাও দুর্লক্ষ্য নয়। অতিসমপ্রতি ঈদের নামাযে নারীদের অংশগ্রহণও ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে শহর অঞ্চলে। ঈদুল আযহা অনুষ্ঠানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক পশু কোরবানি করা। আগের দিনে গ্রামাঞ্চলে কিছু কুসংস্কারের প্রচলন ছিল। যেমন- যে মোল্লা পশু কোরবানি করতেন সেই পশুর মাথা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তার অধিকার বর্তাতো। গ্রামের মানুষ এটাকে ধর্মীয় আচরণ হিসেবেই বিবেচনা করত। সমপ্রতি এই চিন্তার অবসান ঘটেছে। আজ আর মোল্লাকে মাথা দেয়া আবশ্যিক মনে করা হয় না। তবে এ রীতির যে একেবারে অবসান ঘটেছে তাও কিন্তু বলা যাবে না। বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনো গ্রামে এখনও এ প্রথার বিদ্যমানতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে কোরবানির মাংস বিতরণের পদ্ধতির ক্ষেত্রে। আগের দিনে গ্রামাঞ্চলে কোরবানির মাংস তিন ভাগ করে একাংশ কোরবানিদাতা নিজে রাখতেন অপর দু’ অংশ সমাজকে দান করতেন। সমপ্রতি এ নিয়মেরও পরিবর্তন এসেছে। এখন আর দু’ অংশ সমাজকে দেয়া হয় না। দেয়া হয় একাংশ। শহরাঞ্চলে মাংস বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুনের অনুসৃতি দেখা যায় না। অধিকাংশ পরিবার মাংসের সামান্য অংশই দরিদ্রদের মধ্যে দান করে থাকেন। সেখানেও থাকে অবজ্ঞা। সাধারণত ভালো মাংস না দিয়ে হাড্ডি, চর্বি যেগুলো শহরের লোকের ভক্ষণের উপযোগী নয় সেগুলোই দান করা হয়। অবশিষ্ট মাংস বড় বড় ফ্রিজে জমা করা হয় এবং সারা বছর অতিথি আপ্যায়নে সেগুলো ব্যবহার করে আভিজাত্য প্রকাশের চেষ্টা চালানো হয়। মুসলিম সমাজের আরেকটি ধর্মীয় সাংস্কৃতিক উত্সবের নাম শবেবরাত। একে ভাগ্য রজনী হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। শহরাঞ্চলে সারা রাত মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের নামায আদায় করতে দেখা যায়। কেউ কেউ যায় মাজারে অথবা গোরস্তানে দোয়া করার জন্য। এর সঙ্গে চলে বাজি ও পটকা পোড়ানোর ধুম, যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।
আগের দিনে এই উত্সবকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলে পিঠা ও হালুয়া বিতরণের ব্যাপক সাড়া পড়ে যেত। এছাড়া প্রতি পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু এক গণ্ডা (এক গণ্ডা সমান চারটি) করে রুটি ও হালুয়া মসজিদে জমা দিতে হত। মনে করা হত এই রুটি দান করার ফলে পরিবারের প্রয়াত আত্মাগুলো পুণ্যতা পেয়ে যাচ্ছে। এই অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুসলিম সমাজ মুক্তির আস্বাদন লাভ করেছে। যেটি নিঃসন্দেহে পরিবর্তনের গৌরবোজ্জ্বল দিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা যায় মুসলিম সমাজ অনুসৃত মুহররম পরবের কথা। কিছুদিন পূর্বেও গ্রামাঞ্চলে বালক এবং কিশোরেরা দলবেঁধে মুহররমের জারি গেয়ে গ্রাম-গ্রামান্তর বিচরণ করত এবং বিভিন্ন পরিবার থেকে চাল সংগ্রহ করত। অতঃপর আশুরার দিন গ্রামের অভিভাবকেরা সঙ্গে চালের সঙ্গে আরো কিছু চাল মিশ্রণ করে বড় ধরনের ভোজের আয়োজন করত। তাতে ধনী-দরিদ্র সকলকেই অংশগ্রহণ করতে দেখা যেত। বর্তমানে গ্রামাঞ্চল থেকে এ রীতির তিরোধান ঘটেছে। এখন শুধু শহরাঞ্চলের শিয়াপ্রধান জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এ অনুষ্ঠান সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে পুরান ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহের শিয়াপ্রধান অঞ্চলের কথা।
এই উত্সব উপলক্ষে মুহররম মাসের প্রথম দিন থেকে আশুরার দিন পর্যন্ত চলে জারি গান, শিরনি বিতরণ, বাদ্য-বাজনাসহ মাতম। কৃত্রিম দরগায় মানত উপলক্ষে আশুরার দিন প্রদান করা হয় মাটির তৈরি বোরাক, দুলদুল। তাজিয়ার মিছিলে থাকে বাদ্য-বাজনা; তার সঙ্গে থাকে বিরাট আকৃতির দা, নেজা, বল্লম, লাঠি, অস্ত্রধারী জঙ্গিদল, জারিয়ালদের জারি পরিবেশনা। আয়োজিত হয় মেলা। সে মেলায় জমে ওঠে বিচিত্র প্রকারের মিষ্টান্ন এবং ব্যবহারিক জীবনের দ্রব্যসম্ভার। তবে এক্ষেত্রেও যথেষ্ট পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে কোনো কোনো অঞ্চলের মেলার ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে রাজশাহী শহরের মখদুম শাহের মাজার সংলগ্ন মেলার কথা। আগের দিনে এ মেলা উপলক্ষে পনের-বিশ কেজি ওজনের একেকটি পাউরুটি তৈরি হত। এগুলো ক্রয় করা ছিল রাজশাহী শহরের মানুষের বাত্সরিক উত্সবেরই একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কিন্তু আজ আর এ ধরনের পাউরুটি তৈরি হচ্ছে না। এ পরিবর্তন আর্থিক কারণে নাকি ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে তা বলা সত্যিই কঠিন। ‘বেড়া ভাসান’ উত্সব বাংলার কতিপয় গ্রামের মুসলিম সমাজের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক দিক। জলপীর খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশ্যে আলোকসজ্জিত কলার ভেলা নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার উত্সবই বেড়া ভাসান উত্সব নামে পরিচিত। এটি শুরু হয় ঢাকার মুঘল সুবেদার-নবাব-নাজিমদের দ্বারা। অতঃপর মুসলিম শাসনের অবসানের পর এ অনুষ্ঠান নেমে আসে নিম্নবঙ্গের মাটি ও মানুষের দোরগোড়ায়। বর্তমানে বাংলাদেশের যে কটি স্থানে মহাসমারোহে এ উত্সব পালন করা হয়ে থাকে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান থানার ‘শিকারপুর’, ঢাকা জেলার দোহার থানাধীন ‘মৈনাট’, মানিকগঞ্জের ‘পশ্চিম হাঁসলী’, সাটুরিয়ার ‘কাউন্নারা’, কিশোরগঞ্জ জেলার ‘অষ্টগ্রাম’, ‘পূর্বপাড়া’, ‘মারিয়া’ এবং কিশোরগঞ্জ শহরের কয়েকটি এলাকা।
এসব স্থানে রয়েছে প্রতীকী খোয়াজ খিজিরের দরগা, দরগায় রয়েছে বংশপরম্পরায় খাদেম। উত্সব উপলক্ষে বিভিন্ন মানতের প্রাপ্ত দ্রব্যাদি খাদেমের আয়ের উত্স। বেড়া ভাসানের দিন অনুষ্ঠিত হয় বিরাট মেলা, তাতে চলে ঢাক-ঢোল, সানাই, বাঁশি নানা প্রকারের বাদ্য-বাজনা। পরিবেশিত হয় নারী ও পুরুষ দলের জারি ও ধুয়া গান। বাঙালি মুসলিম সমাজের এ দিকটি ইসলামের দৃষ্টিতে যা-ই হোক না কেন সাংস্কৃতিক দিক থেকে এর গুরুত্ব যে অপরিসীম তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাঙালি মুসলিম সমাজে দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু বিশ্বাস-সংস্কার রয়েছে যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে বাংলার লোকজীবনে স্থায়ীভাবে স্থানপ্রাপ্ত লক্ষ্মীদেবীর কথা। এ দেবীর কোনো ঘট নেই। কিন্তু মুসলিম নারীজীবনে রয়েছে কল্যাণময়ী এক নারীমূর্তি। যে কারণে কথায় কথায় সুলক্ষণা মেয়েদের তুলনা করা হয়ে থাকে লক্ষ্মীর সঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্মী নামটি ব্যবহূত হয়ে থাকে প্রতীকী অর্থে। এছাড়া বাংলার মুসলিম সমাজের কৃষক পরিবারে আগের দিনে এমন কিছু বিশ্বাস-সংস্কার অনুসৃত হতে দেখা যেত যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন সোম-মঙ্গলবার, অমাবস্যা-পূর্ণিমাতে জমিতে হালচাষ দেয়া হত না। কোনো কোনো অঞ্চলে ক্ষেতে ধানের বীজ বপনের পর কিছু বীজ হালের ডান দিকের গরুটিকে খাওয়ানো হত। মনে করা হত এতে গো-দেবতা খুশি হলো, ফসল বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি হল। কোনো কোনো অঞ্চলে জমি থেকে ক’মুঠো ধান কেটে এনে ঘরের মধ্যখানে ঝুলিয়ে রাখা হত। মনে করা হত এতে গৃহলক্ষ্মী খুশি হল। কোনো কোনো পরিবারের গৃহিণীরা নতুন ধানের চালে পায়েস রান্না করে দরগা ও পীরের উদ্দেশ্যে শিরনি দিত। বিশ্বাস করা হত এতে স্রষ্টা খুশি হবে। কিন্তু সমপ্রতি এই বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে।
এখন আর গৃহিণীরা এ ধরনের বিশ্বাসকে মোটেই গুরুত্ব দেন না। ইসলামী তত্ত্ববিদরা এগুলোকে পাপকর্ম হিসেবে বিবেচনা করতে নারীসমাজকে সচেতন করেছে। এর পেছনে পাপ-পুণ্য যা-ই থাক না কেন হাজার বছরের একটি ঐতিহ্যের যে বিলয় ঘটেছে তা স্বীকার করতেই হবে। কিছুদিন পূর্বেও বাংলার কৃষকসমাজে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বন্যা, জ্বলোচ্ছাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য ‘ব্যাঙ বিয়া’, ‘পুতুল বিয়া’, ‘বদনা বিয়া’, ‘মেঘরাণী’, ‘হুদমা দেওয়ার গান’, ‘মানিক পীরের জারি’ প্রভৃতি যেসব অনুষ্ঠান পালন করা হত আজ আর তা দেখা যাচ্ছে না। কারণ ইতিমধ্যেই দেশে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে, ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে যন্ত্রের মাধ্যমে জল সরবরাহ। ফলে প্রকৃতি এখন আর ভয়াবহ নয়-কৃষকের করায়ত্তে পৌঁছে গেছে। মানুষ ভাগ্যবাদী না হয়ে কর্মবাদী হয়ে উঠছে। আগের দিনে মুসলিম সমাজের পারিবারিক উত্সব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এমন কিছু বিশ্বাস-সংস্কারের অনুসৃতি পরিলক্ষিত হত ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে গর্ভবতী রমণী, নবজাতক এবং বিবাহাচার নির্ভর নানাবিধ বিশ্বাস-সংস্কারের কথা। একসময় মুসলিম সমাজের বিয়েতে ‘পানচিনি’, ‘গায়ে হলুদ’, ‘মেহেদী তোলা’, ‘থুবড়া কোটা’, ‘ফোরল ডোবা’, ‘খাত্তা ভাঙ্গানো’, ‘দুধেরে ধার শোধা’, ‘সরিষা উদরানো’, ‘চোরা ক্ষীর খাওয়ানো’, ‘মাছ পান’, ‘বাসর জাগা’, ‘মাড়োয়া’, ‘ফাগুয়া’, ‘কনে সমপ্রদান’, ‘শাহ্নজর’, ‘হাঙ্গর ধরা’, ‘বাসী গোসল’, ‘নাইয়র’ ইত্যাদি ধরনের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হত, যা এখন আর আগের মত হচ্ছে না। একদা এইসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল কল্যাণবোধ। কিন্তু আজ আর সেই কল্যাণবোধের কোনো সম্পর্ক নেই। আনন্দ-উত্সবের ঘেরাটোপেই তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাঙালি মুসলিম সমাজ দৈনন্দিন, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে আরও যেসব অনুষ্ঠান পালন করে থাকে তার সঙ্গেও ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক শুধু হূদয়ের অবিচ্ছেদ্যতায়। বর্ষবরণ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে সমগ্র জাতি যেমন নৃত্য-গীত-বাদ্য-বাজনা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক উত্সবের মধ্য দিয়ে বরণ করে থাকে মুসলিম সমাজও তার সঙ্গে সমতালে অংশগ্রহণ করে। মুহূর্তে এসব উত্সবকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলিম, বাঙালি হিন্দু, বাঙালি বৌদ্ধ, বাঙালি খ্রিষ্টান, বাংলাভাষী আদিবাসী অভেদাত্মায় একীভূত হয়ে পড়ে। ফলে সমস্ত জাতি রূপান্তরিত হয় একটি জাতিতে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো গৌরব পায় বাঙালির জাতীয় উত্সবে।
-মুহম্মদ আবদুল জলিল