ভাদ্র মাস। আমনের খেতে গলা ফাটাচ্ছে একটি পাখি। ট্রুব্ ট্রুব্ টুব্ টুব্। পুরো মাঠটাই যেন কাঁপছে। বহুদূরে ডাকছে আরও একটি পাখি। ওই পাখিটির ডাকের প্রত্যুত্তর দিচ্ছে চড়া-কড়া ভাষায়। এই যে ডাক চালাচালি—সেটা প্রতিপক্ষকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া—এই এলাকায় আমার রাজত্ব। সীমান্ত পার হলে খবর আছে! হ্যাঁ, এ সময় এরা জলের কোনো পাখিকেই খাতির করে না।
কোড়া শিকারি আফসার তাঁর পোষা পাখিটিকে নিয়ে চড়ে বসেছেন তালের ডোঙায়। লক্ষ তাঁর গলা ফাটানো পাখিটি। ডোঙা চালাচ্ছেন দ্রুত—আমনখেতগুলোর ভেতর দিয়ে। খাঁচাবন্দী পোষা পাখিটি ভীষণ উত্তেজিত। খাঁচা থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করছে। চওড়া একটা আলের পাশে গলা ফাটাচ্ছে বুনো পাখিটি। কাছাকাছি গিয়ে আফসার খুলে দিলেন খাঁচার দরজা। পোষা পাখিটি কিছুটা উড়ে কিছুটা দৌড়ে পৌঁছে গেল বুনোটার কাছে। বুনোটা তার রাজত্বে প্রতিদ্বন্দ্বী দেখেই এল তেড়ে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। একেবারে পোষা মোরগের মতো লড়াইয়ে লিপ্ত হলো পাখি দুটি। মোরগেরা বর্মে বর্মে ঠোকাঠুকি বা গরুর মতো গুঁতোগুঁতি করে না, এরা তা করে। আফসার যখন পৌঁছে গেলেন তার কাছে, ততক্ষণে পোষা কোরাটি বুনোটির পা আঁকড়ে পড়ে আছে। আফসার বুনোটিকে ধরলেন ও খাঁচায় পুরলেন। পোষাটিকে নিয়ে চললেন অন্য পাখির খোঁজে।
এভাবেই পোষা কোড়া দিয়ে বুনো কোড়া ধরা হয়। বর্ষা-শরত্ই কোড়াদের বাসা বাঁধার মৌসুম, ডিম-ছানা তোলার মৌসুম। এ সময় আনন্দে ডাকে পুরুষ কোড়া। নিজের রাজত্বের ঘোষণা দিতেও ডাকে। ডাহুক ও পোষা পাতি ঘুঘু দিয়ে যেমন বুনো ডাহুক-ঘুঘু শিকার করা হতো এককালে, পোষা কোড়া দিয়েও তা-ই করা হতো। প্রজনন মৌসুমে বাদামি রঙের পুরুষ পাখিটির রং হয়ে যায় চমত্কার কালো, কপালে মুকুটের মতো থাকে আলতা রঙের বর্ম, পা থাকে লালচে-ধূসর, ঠোঁট টকটকে হলুদ। এ সময় এরা দাপটের সঙ্গে হাঁটে—দাপটের সঙ্গে ডাকে। হয়ে পড়ে দারুণ লড়াকু। দেখতেও এ সময় মনে হয় কালো রঙের একটি পোষা মোরগ। ইংরেজি নাম তাই Water Cock। বৈজ্ঞানিক নাম Gallicrex cinerea। পুরুষটির মাপ ৪৩ সেন্টিমিটার। মেয়েটির ৩৬ সেন্টিমিটার। জলমোরগ নামেই বেশি মানায়।
ধানগাছ বা ঘাস দিয়ে ধানখেত বা বিল-হাওরের ঘাসবনে বেশ বড়সড় বাসা করে। ডিম ছয় থেকে আটটি। ফোটে ১৬ দিনে। আজ থেকে ৫০ বছর আগেও গ্রামবাংলার আমনের মাঠ ভাদ্র-আশ্বিনে মুখরিত থাকত জলমোরগের ডাকে। দিন বদলে গেল দ্রুত। সেই আমনের মাঠ নেই, নেই নিরাপদ-নিরুপদ্রব বিল-হাওর। আজ আর ডিম পেড়ে বা ছানা তুলে শান্তি নেই। এককালে বহু গ্রামেই পোষা কোড়া ছিল। এখন কিশোরগঞ্জসহ দেশের দু-একটা অঞ্চলে দু-চারটি পোষা কোড়া দেখা যায়।
কোড়াদের মূল খাদ্য বিভিন্ন বীজ, পোকা-পতঙ্গ, কচি ঘাসের ডগা, ছোট মাছ ইত্যাদি। পোষা কোড়ার সামনে আয়না ধরলে প্রতিপক্ষ ভেবে দারুণভাবে খেপে যায়—সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে! এদের ছোট বাচ্চাদের দেখতেও লাগে খুব সুন্দর। দুটো বুনো পুরুষ কোড়ার লড়াইও দারুণ উপভোগ্য দৃশ্য। লড়াইরত দুটি পাখিকেই ধরে ফেলা সম্ভব। সুন্দর ও সাহসী-লড়াকু এই পাখিটি টিকে থাকুক আমাদের প্রকৃতিতে—এ রকম কামনাই হওয়া উচিত সবার। শীতে ফকিরহাট ও বাগেরহাটে আজও বেশ কিছু কোড়া বিক্রি করে পেশাদার পাখি শিকারিরা। দেশের অন্য হাওরাঞ্চলেও ধরা-মারা পড়ে। এই প্রবণতা রুখে দেওয়া অতীব জরুরি।
-Prothom alo
You must log in to post a comment.