আশ্বিনে দুর্গাপুজো, কার্তিকে লক্ষ্মী পুজো, শ্রীকৃষ্ণ পুজো, কালী পুজো, জগদ্বাত্রী পুজো আর কার্তিক পুজো। তাই আশ্বিন-কার্তিকে মন্দিরে মন্দিরে ও হিন্দু বাড়িতে ঢোল-বাদ্য বাজে। পুজোতে সারা বাংলাদেশ ফিরে পায় এক উৎসবমুখর পরিবেশ।
আশ্বিনের শেষদিকেই দুর্গা পুজো। সপ্তমীর দিন জাঁকজমকের সঙ্গে পুজো শুরম্ন হয়। তবে অষ্টমীর দিন পুজোর ধুম হয় সবচেয়ে বেশি। অষ্টমী-নবমীর মিলনৰণে যে পুজো হয় তাকে বলে সন্ধি পুজো। তাই সন্ধি পুজোই সবচেয়ে বড় পুজো। দশমীর দিন সাঁঝের বেলা বাদ্য-বাজনার সঙ্গে শোভাযাত্রা সহকারে নিকটবর্তী নদীতে অথবা বড় পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়।
মহিষাসুর নামে এক মানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনিই ‘দুর্গা’। তিনিই কিন্তু জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রৰা করেন। এ জন্য তাকে বলা হয়- ‘মা দুর্গা’। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দুর্গা দেবী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন। তাই দুর্গা দেবীর আরেক নাম ‘মহিষ মর্দিনী’।
শরৎ ঋতুর শেষদিকেই অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপুজো। কেউবা বলেন, শরৎ হলো ঋতুর রাণী। তখনই কেবল চারিদিকে থাকে রূপের সমারোহ। কখনওবা আকাশের নীলিমায় দেখা মেলে থর থরে সাজানো সাদা মেঘ। নদীর এপার-ওপারে কিংবা মাঠের প্রানত্দরে কাশফুল দোল খায় বাতাসে। প্রকৃতি তখন কী অপরূপ হয়ে ওঠে, তাইতো কবি লিখেছেন- “কী অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।” শরৎকালেই মনে হয় যেন আকাশ নেমে এসে ছুঁয়েছে পৃথিবীর মাটি। কাশফুল হেসে হেসে কথা বলে সাদা মেঘের সঙ্গে। শাপলা, পদ্ম, শেফালী, কামিনী আর জুঁই ফুল ফোটে গ্রাম বাংলার সর্বত্র। শরতেই তো তাল গাছে তাল থাকে। শরতের জোছনা পস্নাবিত রাতও অন্যরকম সুন্দরের ছোঁয়া ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। সেইৰণেই কিন্তু দুর্গা পুজো উৎসবে মুখরিত হয় গোটা বাংলাদেশে।
শরতের পরে আসে হেমন্তকাল। হিম থেকে এসেছে হেমন্ত। তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তের শিশির ঝরা নিশিতে ফোটে গন্ধরাজ, মলিস্নকা, শিউলি আর কামিনী। হেমন্তেই দীঘির জলে, বিলে, ঝিলে ফোটে কত না রঙের পদ্ম। এ দিকে খেত-খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান উঠতে থাকে। ঘরে চলে নবান্ন উৎসব। এই হেমন্তেই অনুষ্ঠিত হয়- সত্য নারায়ণ ব্রত, শ্রী শ্রী লক্ষ্মী পুজো, শ্রী কৃষ্ণের শারদ রাসযাত্রা, শ্যামা পুজো, শ্রী শ্রী বলি দৈত্যরাজ পুজো, দেওয়ালী উৎসব, শ্রী শ্রী গোবর্ধন পুজো, যমরাজ পুজো, সূর্য পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, ত্রিপুরা সুন্দরী পুজো, কার্তিক পুজো ধরও কত কি!
পুজো-পার্বণে একদা বিত্তবান হিন্দুদের বাড়ি যেন উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠতো। রয়ানি-কীর্তন গানের বিশাল আয়োজন চলতো কয়েকদিন ধরে। যারাই আসতেন তাদের বসিয়ে নানা রকমের মিষ্টি দেওয়া হতো। কেউবা দু’হাত ভরে রসগোলস্না, কালোজাম, কাঁচাগোলস্না, সন্দেশ, নিমকি, লুচি, লাড্ডু, আমিরতি নিয়ে যেতো। যেনো মিষ্টি খাওয়ার ধুম পড়ে যেতো। অর্থাভাব সহ বিভিন্ন কারণে পুজো হয়ে গেছে সার্বজনীন। অর্থাৎ দশে মিলে করার মতো। অনেকের সামর্থ্য নেই বলেই কিন্তু এক এক মহলস্নার কয়েকজনে মিলে পুজোর উৎসব আয়োজন করছেন। কেউবা নিকটস্থ মন্দিরে চাঁদা দিয়ে সেখানেই পুজোতে অংশ নিচ্ছেন। তবে লক্ষ্মী পুজোর নারকেল ও গুড়ের তৈরি লাড়ু সেই ঐতিহ্য এখনও আছে প্রায় প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে। যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তিনি লক্ষ্মী পুজোয় লাড়ু বানিয়ে অতিথিদেরকে আতিথেয়তা দেখাতে চেষ্টা করছেন।
লিখেছেনঃ লিয়াকত হোসেন খোকন