মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী এদেশী কুলাঙ্গারদের বিচার অবশেষে শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পা-চাটা এসব ঘাতক ও দালালকে কাঠগড়ায় তুলতে প্রায় চার দশক অপেক্ষা করতে হলো বাঙালীকে। সহযোগী হিসেবে কেনো এদেরকে, কেনো আসল অপরাধীদেরও নয়! প্রশ্নটা এরাই তোলে, এরাই জবাব দেয়। পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদেরকে নাকি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫ জনের একটি চূড়ান্ত তালিকা ছিলো, ক্ষমা করে ছেড়ে দিয়েছিলেন এদের। ইতিহাস বলে এ এক জঘন্য মিথ্যাচার। সাধারণ ক্ষমা নিয়ে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের মতো এখানেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিথ্যার বেসাতি চলে। তাহলে সত্যিটা কি? কি পরিস্থিতিতে ওইসব ভিনদেশী খুনী-ধর্ষকদের হাতছাড়া করতে বাধ্য হয়েছিলো বাংলাদেশ? তথ্য-উপাত্তের টাইম মেশিনে চড়ে চলুন ঘুরে আসা যাক সেই সময়কাল। তারপর সিদ্ধান্ত নিই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বিতর্কিত করে তোলা এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে গিয়ে পোস্টের দৈর্ঘ্য যাচাই করার ফুরসত মেলেনি। তাই ১০ লাইনের পোস্টে অভ্যস্ত যেসব পাঠক, তাদের সবিনয়ে দূরে থাকতে অনুরোধ করছি। মানি প্রতিটি অনুচ্ছেদই আলাদা পোস্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

Bengali

সাত বিধবার আঁকুতি ও ডিপি ধরের কূটনীতি

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি নিরস্ত্র করা হয়নি। প্রতিশোধউন্মক্ত বাঙালী ও মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে আত্মরক্ষা করতে ঢাকা সেনানিবাসে অন্তরীণ অবস্থায় তাদের অস্ত্র রাখার অনুমতি দেয় মিত্রবাহিনী। ১৯ ডিসেম্বর তারা আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন করে ক্যান্টনমেন্টের গলফ কোর্সে। দু’দিন পর দেশে ফিরে আসে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার। এসেই প্রথম উদ্যোগটি নেওয়া হয় যুদ্ধাপরাধী ও তাদের এ দেশী সহযোগীদের বিচারের। ২৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ঘোষণা দেন পাকিস্তান সরকারের সহযোগী ৩০ জন উচ্চ পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে বিচার করা হবে। পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেফাজতে থাকা একই অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলন করেন স্বামী হারা সাত বাঙালী নারী। এদের কারো স্বামী রাজনীতিবিদ, কেউ পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। মার্চের সেই কালরাতে পাকিস্তানীরা তাদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের কোনো খোঁজ আর মেলেনি। সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আকুল আবেদন জানান এসব নারী যাতে তাদের স্বামীদের নৃশংস হত্যার তদন্ত করা হয় এবং অপরাধী পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের বিচার করা হয়।

প্রসঙ্গত, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্ণর ড. মালেকসহ ৫০ জন উর্ধতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, হাজার খানেক পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ী, ৩৫ হাজারের মতো সেনাসদস্য ও কর্মকর্তা ঢাকা সেনানিবাসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা হেফাজতে ছিলো তখন। সময়টায় ঢাকায় ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ প্রতিনিধি দূর্গা প্রসাদ ধর। আটক পাকিস্তানীদের তখন বিশেষ ট্রেনে ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। চোখের সামনে থেকে স্বজনহত্যাকারীদের এভাবে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়াটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো বাঙালীর। গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো এদের ছেড়ে দেওয়া হবে। একইদিন (২৬ ডিসেম্বর) বিষয়টি নিয়ে ডিপি ধরের মুখোমুখি হন দেশীবিদেশী সাংবাদিকরা। প্রশ্ন ছিলো একটাই। বাংলাদেশ সরকারের দাবী মেনে অভিযুক্ত পাকিস্তানী ও তাদের এদেশী সহযোগীদের হস্তান্তরে রাজী আছে কিনা ভারত।

 

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যেসব উত্তর ধর দিয়েছেন তার মানেটা নেতিবাচক। তিনি আন্তর্জাতিক আইন পরীক্ষা করে দেখার কথা বলেছেন, বাংলাদেশের সরকার যাতে কোনো চাপে না পরে সেটা দেখার কথা বলেছেন, আরও নানা কথাবার্তা। পাশাপাশি যুদ্ধবন্দী ও আটকে পড়া অবাঙালীদের জেনেভা কনভেনশন মেনে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে এটাও বলেছেন যে ‘বাঙালীদের কাছে জঘন্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কারো তরীপার করার অপবাদ নেয়ার মতো কোনো কাজ ভারত করবে না।’

এখানে না বললেই নয় যে যদিও পূর্ব রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো পাকিস্তান। তাই আটক পাকিস্তানী সেনাদের উপর বাংলাদেশের অধিকার ছিলো সমান। কিন্তু জেনেভা কনভেনশন মেনে যুদ্ধবন্দীদের লালন পালনের মতো অবস্থানে ছিলো না সদ্য স্বাধীন এই দেশ। তাছাড়া স্বজন হারানো বাঙালী এসব খুনেদের খাইয়ে পড়িয়ে আরো তাজা বানাবে- এমন মহত্ব দেখানোর মানসিকতায় থাকার কথাও নয়। সুবাদেই দায়িত্বটা কাধে নেয় ভারত।

মূলত দু ধরণের যুদ্ধাপরাধীর দায়িত্ব নিয়েছিলো তারা। পশ্চিম রণাঙ্গনে ৫৪৫জন আটক পাকিস্তানী সেনা ছিলো পুরোপুরি ভারতের অধিকারে। আর পূর্ব রণাঙ্গনে ১৫ মার্চ ১৯৭২ পর্যন্ত ৯২ হাজার ২০৮ জন যুদ্ধবন্দীর মধ্যে সেনা সদস্য ছাড়া ছিলো বেসামরিক লোকজনও। এর মধ্যে ৫৫ হাজার ৬৯২ জন ছিলো নিয়মিত সেনাবাহিনীর, ১ হাজার ৯২ জন নৌবাহিনীর, ৮৩৮ জন বিমান বাহিনীর, ১৬ হাজার ৩৫৪জন আধা-সামরিক বাহিনীর, ৫ হাজার ২৯৬ জন সিভিল পুলিশ, ৬ হাজার ৪০৩ জন নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা বেসামরিক ব্যক্তি, ১ হাজার ৯২২ জন যুদ্ধবন্দীদের স্ত্রী (সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে) ও ৪ হাজার ২০৭ জন ছিলো শিশু-কিশোর।

ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয় যার কাজ ছিলো কিভাবে জেনেভা কনভেনশন মেনে যুদ্ধবন্দীদের ব্যবস্থা করা হবে তার রূপরেখা দেয়া। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনী ও সহযোগী বাহিনীগুলোকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে সুপারিশ করা হয়। যদিও রাজাকার ও আল-বদররা যুদ্ধের কোনো নিয়ম কানুন মানেনি, তারা পাশবিকতার পাশাপাশি লুটতরাজেও লিপ্ত ছিলো। এবং জেনেভা কনভেনশনের ৪-এ (২) ও ৪-এ (৬)এর শর্তাবলীও তারা পূরণ করে না বলে যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা পাওয়ার অধিকার তাদের ছিলো না। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আরো রক্তপাত ঠেকাতে এদেরও যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা দেয়। তবে এটা স্পষ্ট করে বলে দেয় যে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গনহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য কারো বিচারে তারা বাধা দেবে না।

সব যুদ্ধাপরাধীকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তড়িত উদ্যোগ নেওয়া হয়। নিয়াজী ও রাও ফরমান আলীর মতো মাথাগুলোকে ২১ ডিসেম্বর উড়িয়ে নেওয়া হয় কলকাতা। তিন সপ্তাহের এক বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ৮০টি ট্রেন করে সমস্ত যুদ্ধবন্দীদের সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়। এদের জন্য ১৩টি স্থানে ৪৯টি বন্দিশিবির খোলা হয়। স্থানগুলো হচ্ছে- মিরাট, রুরকি, এলাহাবাদ, আগ্রা, ফৈজাবাদ, ফতেগড়, গায়া, রাচি, ধানা, রামগড়, বেরিলি, গোয়ালিয়র ও জবলপুর।

পেছনের কথা ও অসহায় দালালেরা

২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যা শুরুর পরপরই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও যুদ্ধাপরাধ প্রাধান্য পেতে শুরু করে। সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে তাজউদ্দীন সরকারের আবেদনেও সঙ্গত কারণেই এটি ছিলো প্রধান এজেন্ডা। মুক্তিবাহিনীরও। জুনের পর থেকে তাদের খতম তালিকায় যোগ হয় দালালরা- যারা স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। দালাল খতমের এই তালিকায় সেরা সাফল্য ছিলো সাবেক গভর্ণর মোনায়েম খান ও মওলানা সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানী। অচিরেই বাংলাদেশ সরকার এদের বিচারের ব্যাপারে পরিকল্পনা নিতে শুরু করে।

নভেম্বর থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলামের বিভিন্ন বক্তৃতা ও বিবৃতিতে এই বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই উচ্চারিত হতে থাকে। ২৩ নভেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এক বক্তৃতায় বলেন: প্রত্যেক সরকারী কর্মকর্তা, রাজাকার, পুলিশ সদস্য এবং অন্য যারা তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে হানাদারদের সহযোগিতায় বাধ্য হয়েছেন, তাদের উচিত সুযোগ মিললেই বিদ্রোহ করা। আমি সকল দালালকে শেষবারের মতো দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা থেকে নিবৃত্ত হতে অনুরোধ জানাচ্ছি। সেইসঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে অনুতপ্ত নয় এমন দালাল ও তাদের বিদেশী প্রভুদের জন্য অপেক্ষা করছে একই নিয়তি– অপমানজনক মৃত্যু।

৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার পর তাজউদ্দিন ৮ তারিখ আরেকটি ভাষণ দেন জাতির উদ্দেশ্যে। সকল সরকারী কর্মচারীকে মুক্তাঞ্চলগুলোতে কাজে যোগ দেয়ার আহবান জানানোর পাশাপাশি এতে বলা হয় : প্রচলিত আইনের বাইরে কাউকেই শাস্তি দেয়া হবে না। তবে সরকার বাংলাদেশের জনগণকে নিশ্চয়তা দিতে চায় যে কোনো দালাল বিচার এড়াতে পারবে না। দালাল আইনে শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলানো সব সক্রিয় দালালদের বিচার করা হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছে (তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার ও হেফাজতে নেবার জন্য)।

একই সময়ে মুক্ত যশোরে এক বিশাল জনসভায় রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম বলেন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চিরদিনের মতো শেষ হতে যাচ্ছে। দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারগুলোয় ধর্মের নামে অস্থিরতা সৃষ্টির পায়তারা বন্ধ করা হবে জানিয়ে তিনি পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), মুসলিম লিগ, জামাতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী নামের চারটি রাজনৈতিক দলকে ধর্মের নামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাঙালীদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে সহযোগিতার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

২৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান যে ঘোষণাটি দেন, তার রূপরেখা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো ৩ ডিসেম্বর। সেদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদের একটা বৈঠক হয়েছিল, যা ১৩ তারিখ দ্বিতীয় দফা বসে। ১৫ তারিখ সচিব পর্যায়ে এক গ্যাজেট প্রকাশিত হয় বৈঠকের সারমর্ম নিয়ে। তাতে দালালদের বিচারের ব্যাপারে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো বিভিন্ন প্রকারের দালালের জন্য একটি বিশেষ আদালত গঠন, প্রচার মাধ্যমে সকল অভিযুক্ত দালালকে গ্রেফতার ও নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে বিচার করার জন্য প্রশাসনকে বিশেষ নির্দেশ প্রদান এবং এজন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন।

 

১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পনের যে দলিলটিতে সাক্ষর করেন নিয়াজী, তাতে মিত্রবাহিনী প্রধান মানেকশর এই নিশ্চয়তা ছিলো যে আত্মসমর্পনকারী সকল পাকিস্তানী সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। এই ধারাটি দালালদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো না বলে ভারতীয় বাহিনী তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। এ বিষয়ে আমলে আনা যেতে পারে খুলনায় ৮ হাজার পাকিস্তানীর আত্মসমর্পনের দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেল দলবীর সিংয়ের ভাষ্যকে। ২২ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘যুদ্ধবন্দীদের জন্য প্রযোজ্য জেনেভা কনভেনশন দালালদের ক্ষেত্রে খাটে না বলেই তাদের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের।’

বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা ও তারপর…

 ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানী কারাগার থেকে দেশে ফেরার পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে উদ্যোগী হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার এজেন্ডায় মুখ্য ছিলো পাকিস্তানীরাই। ১৭ মার্চ তার ৫২তম জন্মদিনে যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপহার বঙ্গবন্ধু সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে আদায় করে নেন, তার একটি ছিলো ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও অন্যটি যেসব পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে (প্রাইমা ফেসি) তাদের বিচারের জন্য বাংলাদেশকে হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি (এটিকেই ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি বলে অভিহীত করে এসেছে স্বাধীনতা বিরোধীরা)। চুক্তি শেষে দেশে ফিরে গিয়ে ইন্দিরা বলেন, বাংলাদেশকে যুদ্ধাপরাধের বিচারে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে তার আসন্ন বৈঠকে কোনো প্রভাব ফেলবে না। (পরের পর্বে এই বৈঠকের নেপথ্য কাহিনী থাকবে)
 

এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ নিয়াজী ও রাও ফরমান আলী সহ ১ হাজার ১০০ জন পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সরকার। এই ঘোষণায় দুই ধাপের বিচারের কথা উল্লেখ করা হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিচারকদের সমন্বয়ে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাকিদের জন্য জাতীয় আদালত। বাংলাদেশ সরকার জানায় জুলাইয়ে এই বিচার শুরু করবে তারা।

Dacca

এদিকে ২৯ জুন সিমলায় ইন্দিরার সঙ্গে এক বৈঠক আয়োজিত হয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর। তার কিছুদিন আগে ১৪ জুন ভারত ঘোষণা দেয় প্রাথমিকভাবে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের নিরেট প্রমাণ পাওয়া গেছে এমন ১৫০ জন পাকিস্তানী অফিসারকে হস্তান্তরের, যার মধ্যে নিয়াজীও ছিলেন। বৈঠকের দিন দশেক আগে, ১৯ জুন শেখ মুজিব পাকিস্তানীদের বিচার করার ব্যাপারে তার সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান দেন আবারও। এখানে বলা উচিত যে ২ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি সাক্ষরিত হয়, কিন্তু তার কোথাও বাংলাদেশ বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো প্রসঙ্গই আসেনি। এসেছে কাশ্মীর, পশ্চিম রণাঙ্গনে (পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত) যুদ্ধবিরতি কার্যকর রাখা, দখলকৃত জমি ফিরিয়ে দেওয়া এবং সেই রণাঙ্গনের যুদ্ধবন্দীদের বিনিময় নিয়েই চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়। এতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এজন্যই আসেনি যে পাকিস্তান পূর্ব রণাঙ্গনে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। তাই ভারতের অধিকার ছিলো না বাংলাদেশের অনুপস্থিতিতে নিয়াজীসহ ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দী প্রসঙ্গে কোনো কথা বলার। (সিমলা নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে আরো বিস্তারিত থাকবে। 

simla_cia

পাকিস্তানের পাল্টা চাল : ৯০ হাজারের বদলে দু’লাখ যুদ্ধবন্দী!

সরকারী হিসেবে তখন পাকিস্তানী আটকে পড়া বাঙালীদের সংখ্যা ছিলো দুই লাখের ওপর। এদের সকলেই ছিলো কার্যত যুদ্ধবন্দী। পাকিস্তান তাদের আটক করেছিলো দরকষাকষির জন্য। সোজা কথায় বললে ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীর বিনিময় পণ হিসেবে। ১৬ হাজার সরকারী কর্মচারীকে চাকুরীচ্যুত করে তাদের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরা সবাই ছিলেন বাঙালী। বাংলাদেশ সরকার অভিযোগ করে যে আটকে পড়া বহু সামরিক কর্মকর্তাকে রীতিমতো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। ১৩ ডিসেম্বর ’৭২ নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন ছাপে যেখানে বলা হয় ২ হাজার বাঙালী পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী রয়েছে। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল রেসক্যু কমিটির (আইআরসি) বরাতে বেরিয়ে আসে আরো ভয়াবহ তথ্য। পাকিস্তানের কারাগারগুলোতে হাজার হাজার বাঙালীকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই বন্দী রাখা হয়েছে। যারা বাইরে আছে তাদের উপর বর্ণবাদী হামলা হচ্ছে নিয়মিতই। অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে পাকিস্তান থেকে পালানোর চেষ্টা করার অভিযোগে। অনেকে অবশ্য সত্যি পালাচ্ছিলেন। আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে এই পালানোয় সফলও হচ্ছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেটা টের পেয়ে পলাতকদের ধরে আনার জন্য ১ হাজার রূপী পুরষ্কার ঘোষণা করে।

jac smit

’৭২ সালের ৩১ অক্টোবর পাঠানো সিআইএর একটি দুষ্প্রাপ্য দলিলে দেখা যায় শেখ মুজিব আইআরসির ঢাকা প্রতিনিধি জ্যাক স্মিটকে অনুরোধ জানান পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালীদের অবস্থা তাকে জানাতে। স্মিট খোঁজ নিয়ে আর করাচি ও ইসলামাবাদের আইআরসির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারেন যে খুব শিগগিরই এদের ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে (স্মিটের আন্দাজ ছিলো দু’মাস, করাচি প্রতিনিধি ক্লার্ক সময়টা এগিয়ে এনেছেন ১৫ নভেম্বর)। ইসলামাবাদের বাঙালী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান একেএম আহসানের সঙ্গে কথা হয় তার। আহসান তাকে জানান মুজিবকে অনুরোধ করতে যাতে তিনি বাঙালীদের পালাতে উৎসাহিত না করেন। এই ডাকটা প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য বেশী প্রযোজ্য কারণ তাদের কেউ একজন পালালে বাকি বাঙালীদের ওপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে এবং পাকিস্তানে আটক বাঙালী সেনা কর্মকর্তারা ভালোই আছেন। পাশাপাশি লাহোরে আটকে পড়া ২৩০ জন হজ্বযাত্রীকে বাংলাদেশে ফিরতে দেওয়া নিয়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের কথাও উল্লেখ করা হয় ওই দলিলে।

সে বছর নভেম্বরে স্মিট নয়াদিল্লী যান। সিআইএর আরেকটি গোপন বার্তায় দেখা যায় সেখানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এআর মল্লিকের কাছে ৫ হাজার ডলার পরিমান অর্থ সাহায্য আটকে পড়া বাঙালীদের সাহায্য করার সুপারিশ করতে। এই টাকাটা দেওয়া হবে আহসান ও সিন্ধের ফজলুল করিমকে যারা তা বাঙালীদের পৌছে দেবেন। করিম জানান তার কাছে ভারতীয় মুদ্রা রয়েছে যা কাবুল দিয়ে পালানো বাঙালীদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার হচ্ছে। তবে প্রস্তাবিত অর্থ তিনি যোগাড় করে তা পাঠাতে রাজী। গোলমালটা হচ্ছিলো মাধ্যম নিয়ে। স্মিট তাকে লন্ডনের ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়, নিউইয়র্কের চার্চ ওয়ার্ল্ড সার্ভিস কিংবা মার্কিন সরকারের মাধ্যমে পাঠানোর সুপারিশ করেন। মল্লিক শেষ মাধ্যমটিকে পছন্দ করেন। বার্তার বাকিটুকু এতে রাজী হওয়া না হওয়া নিয়ে। (পর্ব- ২)

লিখেছেন : অমি রহমান পিয়াল