chada

বালুবোঝাই ‘বাল্কহেড’ নৌযানটি (ডানে) উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকা থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে গত বুধবার সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার শানবাড়ি এলাকায় পৌছার পর এটির গতিরোধ করে স্থানীয় চাঁদাবাজরা। পরে এটির সঙ্গে ট্রলার বেঁধে জবরদস্তি অর্থ আদায় করা হয়।

চাঁদপুরে পাথর খালাস করে নৌযান নিয়ে ফিরছিলেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের পাটুলীর এলাজ ব্যাপারীসহ পাঁচ মাঝি। পথিমধ্যে মেঘনা নদীর চরে তাঁদের আটকে দেয় চাঁদাবাজরা। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলে। সন্ত্রাসীরা তাঁদের সবাইকে বেধড়ক পেটায়। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে বসে চার লাখ টাকা। জীবন বাঁচাতে এলাজ ব্যাপারী বাড়ি থেকে বিকাশের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা এনে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিয়ে মুক্তি পান। নৌযানে থাকা টাকা ও চাল-ডাল তো আগেই লুটে নেয় ওরা।

ঘটনাটি দেশের ছয় হাজার কিলোমিটার নৌপথে নৌযান শ্রমিকদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের খণ্ডচিত্র।

সুনামগঞ্জ সীমান্তের তিন শুল্ক স্টেশন বড়ছড়া, চারাগাঁও ও বাগলিসহ সুনামগঞ্জ সদর, ফাজিলপুর ও ছাতক থেকে কয়লা, পাথর, চুনাপাথর, বালু, সিমেন্ট প্রভৃতি জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী ঢাকাসহ সারা দেশে নৌপথে পরিবহন করা হয়। সে সুবাদে প্রান্তিক শ্রেণির লক্ষাধিক শ্রমিক নৌপরিবহন পেশায় জড়িত। কিন্তু চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের দৌরাত্বে ওরা ভালো নেই। প্রায় দেড় যুগ ধরে ওদের ওপর চলছে শোষণ-নির্যাতন। উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে ঢাকা এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চল মিলিয়ে নৌপথের শতাধিক স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের নামে চলছে চাঁদাবাজি। বছরে ৫০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির পুরোটাই যাচ্ছে দরিদ্র মাঝি-মাল্লাদের শ্রম-ঘামে অর্জিত অর্থ থেকে।

নৌপথে বছরে শত শত কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে জেনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। গত রবিবার এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, নৌপথে চাঁদাবাজি রোধে সরকার নৌ পুলিশ গঠনসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। চাঁদাবাজি অনেকটা কমেও এসেছে। তাঁর ছবি ছেপে ও নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী জানান, জাহাঙ্গীর আলম নামের এক শ্রমিক নেতাকে তিনি তাঁর ছবি ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিআইডাবি্লউটিএর নামে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে মন্ত্রী জানান, ইজারাদারদের নামে নৌপথে চাঁদাবাজি হতে পারে। এসব ইজারা বাতিল করা হবে। ইতিমধ্যে সদরঘাট ও মাওয়া ঘাটের ইজারা বাতিল করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কার্যত সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ ও মাস্তানদের দখলে দেশের নৌপথ। বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় এরা সক্রিয়। সুনামগঞ্জের সরকারদলীয় এক এমপির ঘনিষ্ঠ অনেকে চাঁদাবাজিতে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই এমপির পিএস এবং জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা চাঁদাবাজদের ইন্ধন দিচ্ছেন।

চাঁদাবাজের কবল থেকে বাঁচতে নৌযান শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নৌবহর নিয়ে কিশোরগঞ্জের হাওর সফরে এলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েক শ বাল্কহেড নৌযান ঘোড়াউত্রা নদীতে অবস্থান নেয়। চাঁদাবাজ, নৌ ডাকাত, সন্ত্রাসী ও পুলিশের অত্যাচার থেকে রক্ষার দাবি জানিয়ে তারা রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেয়।

সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে তা হয়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার কিলোমিটার। চলতি বছরের ১০ আগস্ট পর্যন্ত মালামাল ও যাত্রী পরিবহন ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত ১০ হাজার ১৪৩টি জলযান নিবন্ধনের আওতায় এসেছে। এর মধ্যে বাল্কহেড (দেশি লাগসই প্রযুক্তির ইস্পাত নির্মিত) নৌযান তিন হাজার ৭৬৭টি ও কার্গো দুই হাজার ১৪৯টি। আরো প্রায় ২০ হাজার ছোট নৌযান নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে।

পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর তথ্য মতে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত থেকে জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনকারী পাঁচ হাজার বাল্কহেড নৌযান ও কার্গো ভয়াবহ চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। শ্রমিকরা জানায়, একেকটি মালবাহী নৌযানকে সীমান্ত থেকে ঢাকায় পেঁৗছতে ঘাটে ঘাটে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। প্রতিটি নৌযান বছরে ২৪ থেকে ৩০ বার মাল পরিবহন করতে পারে। সেই হিসাবে প্রতিটি নৌযান থেকে বছরে সাত থেকে আট লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পরিবহন ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, কেবল নৌপরিবহন খাত থেকে বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ কার্গো-ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়নের নামে নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। শ্রমিকদের অভিযোগ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছাতক, আনোয়ারপুর, লিপসা, খালিয়াজুরিতে শ্রমিক ইউনিয়নের শাখা অফিস রয়েছে। এরা নৌপরিহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ছবি দিয়ে রীতিমতো পোস্টার ছেপে চাঁদাবাজি করছে। চাঁদাবাজরা নিরীহ শ্রমিকদের কাছে নিজেদের ‘মন্ত্রীর লোক’ বলে প্রচার করে। সংগঠনের ‘লাল কার্ড’ না রাখার অজুহাতে নিরীহ শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার করে।

গত রবিবার দুপুরে নেত্রকোনার লিপসায় মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছিলেন ইটনার নন্দীগ্রামের চিহ্নিত চাঁদাবাজ সোহেল মিয়া। চাঁদপুরের মতলবের (উত্তর) মোহনপুরের আক্তার মাঝির বালুবোঝাই নৌযান ‘এমভি মেহেক আল ইব্রাহিম’ আটকের পর সোহেল ‘লাল কার্ডের’ নামে ৩৫০ টাকা চাঁদা আদায় করেন। সোহেল প্রথমে জানান, শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়ন ও নৌপথে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধে তাঁরা কাজ করছেন! পরে নগদে চাঁদাবাজির ঘটনাটি জানালে তিনি চুপসে যান।

চাঁদাবাজির ঘটনায় হাজত খেটে সম্প্রতি ছাড়া পাওয়া সোহেল জানান, তিনি কার্গো-ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের লিপসা শাখার সাধারণ সম্পাদক। নৌপরিবহনমন্ত্রীর ছবিসংবলিত পোস্টার প্রদর্শনের কথা তিনি স্বীকার করেন। তবে মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করেন।

জানা যায়, নৌযানে চাঁদাবাজির অভিযোগে গত ১৪ জুলাই শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমকে জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশন কর্তৃপক্ষ অব্যাহতি দেয়। এর পর থেকেই তাঁর ইউনিয়নভুক্ত লোকজন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চাঁদাবাজি শুরু করে। জাহাঙ্গীর আলম জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশনেরও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। তবে জাহাঙ্গীর তাঁর সংগঠনের নামে চাঁদা তোলার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, ফেডারেশনের সভাপতি তাঁকে বহিষ্কারের এখতিয়ার রাখেন না। তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগও ভিত্তিহীন।

আক্রান্ত শ্রমিকরা জানায়, ইউনিয়নের লোকেরা মার্কার নামে প্রতিটি মালবাহী নৌযান থেকে ৫০০ থেকে হাজার টাকা করে চাঁদা তুলছে। সুনামগঞ্জ-ঢাকা নৌপথের ১০-১২টি স্থানে এরা নির্যাতন করছে। এলাকাগুলো হচ্ছে সুনামগঞ্জের ছাতক, তাহিরপুরের আনোয়ারপুর, জামালগঞ্জের লালপুর, নেত্রকোনার খালিয়াজুরির লিপসা, কিশোরগঞ্জের ইটনার এলংজুরি, নিকলীর ছাতিরচর, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনাঘাট, নারায়ণগঞ্জের ধর্মগঞ্জ, পাগলা ও কাঁচপুর।

শ্রমিকরা আরো জানায়, সুনামগঞ্জের ছাতকে পুলিশের ‘টোল’ ও পৌরসভার নামে আদায় করা হচ্ছে দেড় হাজার টাকা। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ সদরে বিআইডাবি্লউটিএর নামে দেড় হাজার, জামালগঞ্জে দেড় থেকে দুই হাজার, সুরমা নদীতে ৩০০, সীমান্তপুর, আছানপুর ও বেহেলি নদীতে ‘মার্কা’র নামে দুই হাজার, তাহিরপুরের আনোয়ারপুরে টোল ও মার্কার নামে এক হাজার, শ্রীপুরে নোঙরকারী নৌযান পাহারার নামে তিনটি আলাদা গ্রুপে ৯০০, বোয়ালমারায় ২০০, সোলেমানপুরে পাহারাদারের নামে ৬০০, ধর্মপাশার শানবাড়ীতে দুই থেকে তিন হাজার, খালিয়াজুরির লিপসা ও শতালে মার্কার নামে ৫০০ থেকে হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে।

অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মেঘনা নদীতে পুলিশের নামে ৬০০, সোনারগাঁর বৈদ্যেরবাজারে বিআইডাবি্লউটিএর নামে দুই থেকে তিন হাজার, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা সেতুর নামা থেকে ত্রিমোহনা পর্যন্ত দুই হাজার থেকে তিন হাজার, মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতুর নামায় ৫০০ থেকে এক হাজার, ঢাকার কেরানীগঞ্জে লাল কার্ডের নামে ৫০০ থেকে এক হাজার, কামরাঙ্গীরচরে রাসেল গ্রুপের নামে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। আরো অসংখ্য স্থানে নামে-বেনামে চলছে চাঁদাবাজি।

মার্কার নামেও বিচিত্র ধরনের চাঁদাবাজি চলছে। বর্ষায় হাওরাঞ্চলে বিপুল জলরাশি থাকায় নদীর চ্যানেল নির্ধারণের জন্য বিআইডাবি্লউটিএ মার্কা বা ‘আড় কাঠি’ বসায়। বাস্তবে এক শ্রেণির চাঁদাবাজ ভুল জায়গায় বাঁশ পুঁতে রাখে। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সবুজ সিকদার ও বাজিতপুর শ্রমিক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানান, মার্কার নামে চাঁদা দিতে গিয়ে গরিব মাঝিরা নিঃস্ব হচ্ছে।

নির্যাতনের শিকার শ্রমিকরা জানায়, বৈদ্যেরবাজারে চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন কথিত ইজারাদার জাকির। এ স্থানে চাঁদা দিতে গড়িমসি করলে মাঝিদের বেধড়ক পেটানো হয়। কামরাঙ্গীরচরেও চলে ব্যাপক নির্যাতন। গজারিয়ায় মেঘনা সেতু এলাকায় চাঁদা তোলে জেলে নামধারীরা। নারায়ণগঞ্জের পাগলা, আলীগঞ্জ, ধর্মগঞ্জ ও কাঁচপুরে চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দেন হারুন, জাহাঙ্গীর প্রমুখ। মুন্সীগঞ্জের মেঘনাঘাটে চাঁদা নেন শাহজাহান।

অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের নিকলীর ছাতিরচরে সমির, শাহীন, সাইদুর ও লাট মিয়া, শিংপুরে মো. আলী, ইটনার এলংজুরিতে খায়রুল, আব্দুল হাই ও শুক্কুর আলী, করিমগঞ্জের বালিখলায় হারেছ, লিপসায় সোহেল ও মজিবুর, আনোয়ারপুরে মহিবুর, ছাতকে মান্নাফসহ শতাধিক ব্যক্তি চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আলহাজ শুক্কুর মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চল সীমান্ত হয়ে আমদানি করা পাথরবাহী একেকটি কার্গো মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকার সদরঘাটে পেঁৗছতে এক দফায় ৩০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা দেয়। সিলেট অঞ্চল থেকে ঢাকা পর্যন্ত ৫০টির মতো স্থানে চাঁদাবাজরা সক্রিয়। মাস্তান, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনরা মিলেই চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা না দিলে মাঝিদের মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটছে। মাসখানেক আগেও লক্ষ্মীপুরে জাহাজের এক মাস্টারের পেট ফেড়ে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে বাল্কহেড নৌযান মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তফাজ্জল হোসেন বাদল জানান, নৌপথের অরাজকতা তাঁদের শঙ্কিত করে তুলেছে।