anis_bajitpurআনিসুর রহমান, ভাটি অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষের প্রিয় আনিস ভাই। সমাজের পিছিয়ে পড়া বঞ্চিত মানুষের মুক্তির পথ খুঁজে বেরিয়েছেন আমৃত্যু। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের এক সচ্ছল কৃষক পরিবারে বাংলা ১৩৩৯ সালের ফাল্গুন মাসে জন্মেছিলেন এই মানুষটি। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা বলতে যা বোঝায় তা তার ভাগ্যে জোটেনি। তবে মানবমুক্তির পথ ও উপায় খুঁজে পেতে প্রয়োজনীয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় তার গভীরতা ছিল প্রশ্নাতীত। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে যে কখনো পরাজিত হয় না- এ সত্যটি তিনি ধারণ করেছিলেন নিষ্ঠা, সততা আর নির্ভীকচিত্তে।

শৈশবের সোনালি দিনগুলো পাড়ি দিতে না দিতেই শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির কঠিন পথে হাঁটতে শুরু করেন- যা চলমান ছিল তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এ জনপদে নানা সময়ে গড়ে ওঠা কোনো উদ্যোগ ও সংগ্রামের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল না- এমনটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুলের গণ্ডি পেরোবার আগেই শুরু হয় তার কারাজীবন। কারাগারে বসেই ১৯৫৫ সালে তৎকালীন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতকার্য হন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের জেলা পর্যায়ের মূল নেতৃত্বে ছিলেন। রাজনীতি তথা গণমানুষের মুক্তির পথ অন্বেষণকেই জীবনের প্রধান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে আমৃত্যু লড়েছেন নিঃশঙ্কচিত্তে। পাকিস্তানি জমানায় এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও দফায় দফায় কারাজীবনের স্বাদ নিতে হয়েছে এই বিপ্লবীকে। অসংখ্য দিন কেটেছে তার পাতাল জীবনে।

৫ ডিসেম্বর ছিল আনিস ভাইয়ের নবম প্রয়াণবার্ষিকী। ৭৬ বছরের ক্লান্তিহীন জীবনে মাতৃভূমির দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী সব গণআন্দোলনে সামনের কাতারে অবস্থান নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন সমাজ বদলের একজন প্রকৃত যোদ্ধা হিসেবে। জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি নিজ অঞ্চল ভাটি এলাকায় ভাসমান পানিতে জেলেদের মাছ ধরার নিরঙ্কুুশ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ স্থানীয় হাটবাজারগুলোতে ইজারাপ্রথা ও অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিরুদ্ধে গণমানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করে গড়ে তুলেছেন গণআন্দোলনে।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, নগেন সরকার, দেবেন শিকদার, হেমন্ত সরকার, সুখেন্দু দস্তিদার, হাজী দানেশ, আবদুল মতিনসহ বাম রাজনীতির সামনের কাতারের প্রায় সব রাজনীতিকের সংস্পর্শে কেটেছে তার জীবনের অনেক বছর।

মানুষের জন্য কোনো আত্দত্যাগই যে বৃথা যায় না- এ দর্শনকে তিনি ধারণ করেছিলেন আক্ষরিক অর্থেই। আজ দেশের রাজনীতির করুণ দশা এই মানুষটিকে দেখতে হয়নি। আনিসুর রহমান বা আনিস ভাই-এর মতো যারা জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন মানব কল্যাণে তথা মানবমুক্তির কঠিন লড়াইয়ে- আজকের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তাদের অভাব যে কত তীব্রভাবে অনুভূত হয় তা বোধকরি সমাজ সচেতন কোনো মানুষই অস্বীকার করবেন না।

আনিস ভাই তার নিখাদ দেশপ্রেম দিয়ে মানবমুক্তির সংগ্রামে নিঃশঙ্কচিত্তে এগিয়ে চলার যে পথ দেখিয়ে গেছেন- এসব কিছুই কি বিস্মৃত হয়ে যাবে এ প্রজন্মের কাছে? ইতিহাসের সত্যপাঠ যদি খুঁজে পেতে হয় তবে বার বার ফিরতে হবে আনিস ভাই ও তার মতো বিপ্লবীদের কাছে- যারা পরাভব মানেননি কখনো।

বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক নিকোলাই অস্ত্রভস্কি তার এক বিখ্যাত রচনায় লিখেছিলেন- ‘জীবন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। এ জীবন সে পায় মাত্র একটিবার। তাই এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবনযাপন করার যন্ত্রণা ভরা অনুশোচনায় ভুগতে না হয়- যাতে বিগত জীবনের গ্লানি ভরা হীনতার লজ্জার দগ্ধানি সইতে না হয়; এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর মুহূর্তে একজন মানুষ বলতে পারে- আমার সমগ্র জীবন, সমগ্র শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্য- মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামে।’ আমার বিশ্বাস আনিসুর রহমান সেই দর্শনকেই ধারণ করেছিলেন- যা লালন করেছেন শেষ দিন পর্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও পরম আন্তরিকতার সঙ্গে।

লিখেছেন – মনোজ রায়