তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালে রাজাকার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন বুঝতে পারলেন যে পাকিস্তানীদের পরাজয় অনিবার্য, তখন নভেম্বর মাসে মায়ানমান হয়ে পালিয়ে গেলেন পাকিস্তানে। তারপর থেকে নিবিরভাবে বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন জীবনের শেষ মহুর্ত পর্যন্ত। অবশেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ইসলামাবাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। কিন্তু বেঁচে থাকতে কোনদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করেননি, কিন্তু অপমান করার সুযোগ পেলে তা কাজে লাগিয়েছেন শতভাগ। তারপরেও তিনি মৃত্যুর আগে বাংলাদেশে সমাহিত হওয়ার খায়েশ জানিয়ে ছিলেন। মৃত্যুর পর সে ইচ্ছা পূরণের জন্য তার সন্তান বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার সে আবেদন মঞ্জুর করেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এখন রাঙ্গামাটিবাসী এই মহান রাজাকারের মরদেহকে যেকোন সময় কাছে পেয়ে সম্মান জানানোর অপেক্ষায় আছে! মহান বলছি কারণ, বেঁচে থাকতে যিনি কোনদিন বাংলাদেশ স্বীকার করেননি, এমনকি মৃত্যুর এই দেশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তা জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সম্মান জানিয়ে একটা আবেদন করারও প্রয়োজন যিনি মনে করেননি, তিনি মৃত্যুর পর কোন এক জাদুরকাঠির ছোঁয়ায় অনুমতি পেয়ে গেলেন! তা-ও আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে!! তাছাড়া এই সরকারই তো জাতিকে যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ক মুক্ত করতে রাজাকারদের বিচার করাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে তারা বিচার প্রক্রিয়াকে একটা চূড়ান্ত রূপও দিয়েছে, সরকারদলের নেতা-নেত্রীরা যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে হরহামেশাই গর্বও প্রকাশ করেও চলেছেন। সেই সময় যদি কোন আজীবন রাজাকার এমন সমীহ আদায় করতে পারে তাকে মহান রাজাকার না বলার কোন উপায় থাকে কি?

তাই এই মহান রাজাকারের কিছু অবদান তুলে ধরছি

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায় নিজেই রাজাকার বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানী হানাদারদের পরাজয় ঘনিয়ে এলে ত্রিদিব রায় তার পরিণতি আঁচ করতে পেরে নভেম্বর মাসে মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার না করে পাকিস্তানেই বসবাস করেছেন।

এ প্রসঙ্গে ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার বিতর্কিত বই The Departed Melody -তে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে তিনি (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোঃ হজরত আলী এবং আরো কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানীদের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরো কয়েকজন ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবেন। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙ্গামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়।’ ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত তৎকালীন রাজাকার বাহিনী এবং তাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে একাধিক গণহত্যা চালানো হয়েছিল। কিন্তু এ কারণে আজ পর্যন্ত রাজা ত্রিদিব রায় কোন প্রকার অনুতাপ স্বীকার করা তো দূরের কথা বরং মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ The Departed Melody -তে লিখেছে-

Increasing lawlessness and violence of the rebel Bengali forces promised no safety to anyone (Page-214) In Rangamati, from 26 March onward, Awami League cadres, in league with the rebel police and tha East Pakistan Rifles, began rounding up the Biharis (Page-216) . There was a constant supply of food and firearms in commandeered trucks to the Mukti Bahini, comprising rebel EBR (East Pakistan Regiment), EPR (East Pakistan Rifles), and the police. These elements were fighting the The Army at Chittagong and elsewhere. People were forced by Awami League cadres to pay money and rice under threat of violence. Many shopkeepers had closed shop and run away. ( Page- 217)

রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়

১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ন্যাশনাল এসেম্বলী ইলেকশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশের মুক্তিকামী জনতার পাশে না দাঁড়িয়ে যোগ দেন পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে। চাকমা রাজা হিসেবে তার প্রভাবাধীন হেডম্যান-কারবারীদের ব্যবহার করে চাকমা যুবকদের দলে দলে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করেন। তাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী জনতার বিরুদ্ধে। এসময় ত্রিদিব রায় এবং তার রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একাধিক গণহত্যা পরিচালনা করে। এতে নির্মমভাবে শহীদ হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তায় মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান।

বাংলাদেশ এবং বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব ও কার্যক্রমের পুরস্কার স্বরূপ ‘পাকিস্তানের জাতীয় বীর’ খেতাব এবং আজীবন মন্ত্রীত্ব নিয়ে আজো তিনি পাকিস্তানেই বসবাস করছেন। অপরদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের রেখে যাওয়া রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) গড়ে তোলে সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী। এ প্রসঙ্গে ১৩৯২ বাংলা সালে কলিকাতা, নাথ ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘প্রসঙ্গ: পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক গ্রন্থে সিদ্ধার্থ চাকমা লিখেছেন, … ‘উপজাতীয় রাজাকাররা এ সময় গভীর অরণ্যে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তারা সশস্ত্র ও সংগঠিত হয়ে শান্তিবাহিনী নামে সংগঠন গড়ে তোলে (পৃ. ৪৬)।’

২০০৩ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বই The Departed Melody -তে ত্রিদিব রায় নিজেই রাজাকার হিসাবে তার কর্মকাণ্ড বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছেন এবং এসব অপকর্মের কারণে তিনি অনুতপ্ত তো নয়ই বরং গর্ব প্রকাশ করেছেন তার বইয়ে। একই সাথে মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি পাকিস্তানী হানাদারদের গুণকীর্তন করেছেন। তার বইয়ে পাক হানাদারদের প্রশংসা করতে গিয়ে ত্রিদিব রায় লিখেছেন,

On the way back, at Ranirhat, 18 miles from Rangamati, a number of very frightened people asked us when the army was going to take over these areas. They said they were suffering at the hands of the Mukti Bahini. We told them that the army would be coming at any moment. That evening at dusk the army, in launches and speedboats made a sort of miniature Normandy landing (the Allied landing in France of 6 June 1944) at Rangamati and swiftly took command of the situation (page-221).

ঢাকার তাম্রলিপি প্রকাশনা থেকে ফেব্র“য়ারি, ২০০৯-এ প্রকাশিত ডা. এমএ হাসানের বই ‘যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ’-তে রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়ের সিরিয়াল এবং তার পরিচয় হিসাবে উল্লেখ রয়েছে, 948. Mr. Raja Tridiv Roy, Father Late Raja Nalinakhya Roy, Village Rajbari Rangamati, Thana Kotowaly, Chittagong (page- 152). আইন ও সালিস কেন্দ্র থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত বই ‘যুদ্ধাপরাধ’ এর ৮২ পৃষ্ঠাতে অনেকের পাশাপাশি রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়ের নামও উল্লেখ রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বের হওয়া হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’ (সশস্ত্র সংগ্রাম-১) নবম খণ্ডের (জুন, ২০০৯) ৯৩ পৃষ্ঠায় মে.জে. মীর শওকত আলী (বীর উত্তম) লিখেছেন, ‘চাকমা উপজাতিদের হয়ত আমরা সাহায্য পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়।’ অন্যদিকে ১৯৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) এইচটি ইমাম তার বই ‘বাংলাদেশ সরকার-১৯৭১’-এর (মার্চ, ২০০৪) ২৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রথম থেকেই নির্লিপ্ত এবং গোপনে পাকিস্তানীদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন।’

বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক)-এর বই ‘মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের বীর উত্তম’ (ডিসেম্বর, ২০০৮)-এর ৬৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মার্চ মাসের প্রথম থেকেই রাজা ত্রিদিব রায় এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কোনো কারণে মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন।’ ১৯৭১ সালে রাজাকার ত্রিদিব রায়ের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে বলাকা প্রকাশনী থেকে ২০১১ সালের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ এর ৩৭৯-৩৮০ পৃষ্ঠায় গবেষক জামাল উদ্দিন লিখেছেন, ‘‘…অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ওই দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙ্গামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না।

ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এ দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গামাটির আবদুল শুক্কুর, এসএম কামাল, শফিকুর রহমান, ইফতেখার, ইলিয়াস, অবদুল বারী, মো. মামুন ও আবুল কালাম আজাদ। ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী ছাড়া অন্যদের পাকবাহিনী নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে মানিকছড়িতে নিয়ে হত্যা করে।’’ অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত শরদিন্দু শেখর চাকমা তার ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক বইয়ের ২৬-২৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘রাঙ্গামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী কয়েকজন মুুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি স্পিডবোটে করে মহালছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি আসেন।

— স্পিডবোটে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এস এম কালাম, আবদুল শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, মামুন, সামসুল হক মাস্টার এবং রাঙ্গামাটি হাইস্কুলের তদানীন্তন হেডমাস্টার রহমান আলীর ছেলে ইফতেখার।

— এর মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য আবদুল আলীকে রাঙ্গামাটিতে পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর সেসব জায়গায় লবণ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে একটি জিপের পেছনে বেঁধে টেনে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছিল।’ একই বইয়ের ৩০-৩১ পৃষ্ঠায় শরদিন্দু শেখর চাকমা লিখেছেন, ‘ আমি তাকে (রাজা ত্রিদিব রায়কে) বলি, আমার তো মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে এবং তার পক্ষে স্রোতের বিপরীতে যাওয়া ঠিক হয়নি। রাজা ত্রিদিব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে না, যদি ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে না পারে। আর ভারত পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে পারবে না, কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে চীন এবং আমেরিকা রয়েছে। তারা কোনদিন পাকিস্তানকে ভারতের নিকট পরাজিত হতে দেবে না। রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তিনি তখন পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি পাকিস্তানী হয়েছেন।’

‘ইফতেখার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া প্রথম ব্যাচের সদস্য ছিলেন তিনি। তার বাবা যেহেতু রাঙ্গামাটি স্কুলের হেডমাস্টার, তাই রাঙ্গামাটি গিয়ে বাড়ির সবাইকে দেখবেন এবং যুদ্ধ করে তাদের মুক্ত করে আনবেন এমন ইচ্ছায় টগবগ করছিলেন তিনি।’ নিজের ছাত্র ইফতেখার সম্পর্কে ‘আমার একাত্তর’ (সাহিত্য প্রকাশন, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৪৮) বইতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এভাবেই স্মৃতিচারণ করেছেন। ত্রিদিব রায়দের সহায়তায় পাকিস্তানীরা পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রবসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই হত্যা করেছে। যার অনেক প্রামাণ্য দলিল এখনো সংরক্ষিত আছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকায় ত্রিদিব রায়
রাজা ত্রিদিব রায় সম্পর্কিত বিভিন্ন দলিল ও গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তায় মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে ওই বছরই ব্যাংকক প্রেরণ করে।জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত জেনারেল এসেম্বলীতে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রদানের প্রসঙ্গ আসলে পাকিস্তান সরকার-এর বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং করার জন্য ত্রিদিব রায়কে প্রধান করে এক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। বিষয়টি অনুধাবন করে ত্রিদিব রায়কে নিবৃত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ত্রিদিব রায়ের মাতা বিনীতা রায়কে এক প্রতিনিধি দলের সাথে জাতিসংঘে পাঠানো হয়। রাজ মাতা বিনীতা রায়সহ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা না করে তার মাতৃভূমিতে ফিরে আসার আহ্বান জানালেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ত্রিদিব রায়ের লবিংয়ের কারণে চীন ভেটো প্রয়োগ করে, ফলে সেবার বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

পাকিস্তানের পক্ষে তার এই সফলতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তার মন্ত্রিসভা জাতিসংঘ ফেরত ত্রিদিব রায়কে ‘জাতীয় বীর’ খেতাব দিয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা প্রদান করে। ১৯৭২ সালের জাতিসংঘের মিশনে বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা পালন করেই ত্রিদিব রায় ক্ষান্ত হননি। বরং তিনি ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে, প্রবন্ধ লিখে, বই লিখে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।

গত ২০০০ সালের ৪ অক্টোবর পাকিস্তানি ইংরেজী দৈনিক ডন পত্রিকায় ‘চিটাগং হিল ট্র্র্যাক্ট : লেট জাস্টিস বি ডান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ The Departed Melody তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। সোসাইটি ফর ন্যাশনাল রিসার্চ এন্ড প্রোগ্রেস (এসএনআরপি) কর্তৃক গত ১ নভেম্বর ২০১১ তারিখে মেঘনা প্রিন্টার্স, ঢাকা থেকে ‘প্রেক্ষাপট : পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়’ শীর্ষক প্রকাশিত এক গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, শুরু থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা চাকমা রাজপরিবারের সদস্যসহ বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব সম্পন্ন অন্যদের মধ্যে কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষভাবে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা চালিয়ে গেছেন ত্রিদিব রায়। যার পুরস্কার স্বরূপ ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে আজীবন মন্ত্রিত্বের পদমর্যদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ফেডারেল মন্ত্রী, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত পর্যটন ও সংখ্যালঘু বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার ৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত করে আর্জেন্টিনায় প্রেরণ, ১৯৯৫ সালের মে মাস থেকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ‘এ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ’ হিসেবে নিয়োগ, ২ এপ্রিল ২০০৩ থেকে পাকিস্তানের দপ্তর বিহীন ফেডারেল মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

এত কিছুর পরও তিনি বাংলাদেশে সমাহিত হওয়ার অনুমতি আদায় করতে পেরেছেন, তাই তাকে স্যালুট। স্যালুট আমাদের সরকারের আত্মসম্মানবোধকে, স্যালুট আমাদের যুদ্ধাপরাধবিরোধী( এবিষয়ে নিশ্চুপ) বুদ্ধিজীবী মহলকেও!!!

 

-লিখেছেনঃ সৈয়দ ইবনে রহমত