‘মন মোর মেঘের সঙ্গী উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম’ …

মেঘ জমেছিল আকাশে। টিপ টিপ বৃষ্টি হয়ে জিরাচ্ছিল আকাশ। রাত দ্বিপ্রহর। ভদ্রতার সীমা ছাড়ানোর সময়। ফোনকর্তা এ কথা বলার সঙ্গেই জোছনা বিলাসে যাবার নিমন্ত্রণ জানালেন। হঠাত্ প্ল্যান। রাত ১২টার পরিকল্পনায়, বেলা ১২টায় রওনা দিতে হবে। আসতে হবে কেন্দ্রে। সঙ্গে নিতে হবে দুদিনের ব্যবহার্য পরিধেয় বস্ত্র, মশারি, কাঁথা, বালিশ, পারলে একটা বঁটি। যেমন কথা তেমন কাজ। সাঁইত্রিশ বছরের যুবকসহ (স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) আমরা জনা দশেক রওনা হলাম দুপুর ১টায় মাইক্রোবাসে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায়। তখনও জানি না। কী হবে? কোথায় যাচ্ছি? তবে যাচ্ছি কোনো এক অজানালোকে। পৌঁছাতে রাত প্রায় ৮টা। ঝিরিঝিরি হাওয়া আর রিমঝিম বর্ষা, বরষা বিলাসে আমন্ত্রণ জানালা। অপার এক সৌন্দর্যে এসে পড়লাম। ঠাণ্ডা গোলগাল হাওরের ওপর ভেসে বেড়ানো চাঁদ তখন ডাকছে। বজরা ভাড়া করা আগেই ছিল। উঠে পড়লাম। ছেড়ে দিল বজরা। সারা রাত বজরা দুলবে। আর ওপরে চাঁদ তার জোছনা বিলাবে। নড়েচড়ে বজারার মাথার দিকে গিয়ে বসলাম… ঝিরিঝিরি বর্ষায় নিজেকে নারী রবীন্দ্রনাথ লাগছে।

রবীন্দ্রনাথ বোটে ঘুরেছিলেন পদ্মার ঢেউয়ে। আর আমরা নিকলীর হাওরে। সে কি উত্তাল ঢেউ। আছড়ে পড়ছে…দুলছে…চলছে বোট অজানা কোনো হিজরের উদ্দেশ্যে…কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের আকর্ষণীয় দিক এই হাওর। কেবল ভূপ্রকৃতিগত বৈচিত্র্যের কারণে নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই হাওর এক বিরাট স্থান জুড়ে আছে। হাওর মূলত সাগর শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। উচ্চারণ বিকৃতিতে সাগর থেকে সায়র এবং সায়র থেকে হাওর হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে বিশাল হাওর এলাকায় অথৈ জলরাশি দেখলে সাগরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। হাওর আর কিছু নয়, এটা অপেক্ষাকৃত বড় জলাভূমি।

শীতকালে যে প্রান্তর ফসলে পূর্ণ বা শুকনো মাঠ কিংবা বালুচর, বর্ষাকালে সেখানে এমন জলধারা যে চারদিক প্লাবিত করতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শুধু পানির প্রবাহ নয়, প্রচণ্ড ঢেউ আর দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি সাগরের বিশালত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়। দ্বীপের মতো গ্রামগুলো যেন ভেসে আছে পানির বুকে। বর্ষাকালে হাওরের এই পাগল করা ঢেউয়ের দোলায় তিন বৈঠার নৌকার পাল উড়িয়ে চলার সময় উল্টিয়ে পড়ছে যেন, সেই হাওরে নাকি শুষ্ক মওসুমে পানি থাকে না এক ফোঁটা, যতদূর চোখ যায় শুধু ধানের সবুজ শিষ বা সোনারঙা ধানের সুবিপুল সমারোহে ভরপুর হয়ে ওঠে। বিশ্বাস হচ্ছিল না এমন থৈ থৈ পানি দেখে। সুমন ভাইয়ের তোলা শুকনো মওসুমের ছবি দেখে বিশ্বাস হল। এখানে আরও অবিশ্বাস্য এক রাস্তা আছে। সাবমার্সিবল রোড। বর্ষায় ডুবে থাকে। আর শুকনোর সময় দিব্যি পথ চলার রাস্তা। পানির জন্য এ রাস্তার কোনো ক্ষতি হয় না। পানির ভেতর থেকে শুধু লাইটপোস্ট দেখা যাচ্ছিল।

কিশোরগঞ্জ জেলা হাওর এলাকা ‘গেইটওয়ে’ নামে খ্যাত। সীমানা দক্ষিণে অষ্টগ্রাম থানা, উত্তরে মিঠামইন, উত্তর-পূর্ব কোণে ইটনা, উত্তর-পশ্চিমে কটিয়াদী, পশ্চিমে নিকলী এবং পূর্বে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানা। নিকলী হাওর ছাড়া কিশোরগঞ্জে আরও অনেক হাওর রয়েছে। যেমন হুমাইপুর হাওর (বাজিতপুর), সোমাই হাওর (অষ্টগ্রাম), বাড়ির হাওর (মিঠামইন), তল্লার হাওর (বাজিতপুর-নিকলী-অষ্টগ্রাম), মাহমুদুর হাওর (নিকলী), সুরমা বাউলার হাওর ইত্যাদি।

বর্ষায় আমরা এই হাওরে নৌকা ভাসালাম, মনে হল অকূল দরিয়া পার হতে হচ্ছে। কূল নাই কিনার নাই, শুধু অশান্ত ঊর্মিমালা ওঠানামা করছে বিরামহীনভাবে। বিদ্যুৎবিহীন জোছনামাখা এই হাওর আমাদের দিল অপার ভালো লাগা। রাত পেরিয়ে প্রত্যুষের আলো ফুটেছে। চারদিকে ঝিলিমিলি নীল আলো। পাহাড় খান (রহঃ) মাজারের সামনে হিজল গাছের সঙ্গে বজরা বাঁধা হল। ঢেউয়ের ছন্দদোলায় মনে হতে লাগল রক্তলাল সূর্য একবার পানির নিচে ডুবছে, আবার ভেসে উঠছে। ভোরের আলোয় দেখতে পেলাম ছোট ছোট নৌকা নিয়ে হাওরের মাছ ধরছে জেলে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।

বোট আবার ছেড়ে দিল। যেন কোনো একদিকে রওনা হয়েছি আকাশে বিমান নিয়ে। শ্রী দীনেশ চন্দ্র দেবনাথের স্মৃতিচারণ হাওর এলাকায় বর্ষাকালের এই রূপ। চারদিকে শুধু পানি আর পানি, মাঝে মাঝে পানির ওপর ভাসমান গ্রাম। যেন দ্বীপ। দার্জিলিং পাহাড়ে টাইগার হিলে বসে সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। পৃথিবীর আরও অনেক সৌন্দর্য আমি দেখিনি। তবে এই সৌন্দর্য দেখলাম। এ আমাদের খুব কাছের। এ যেন ‘ধানের শিষের ওপর একটি শিশির বিন্দু’। তিন দস্যির সঙ্গে হাওরে নামলাম। হাওরের তোরঙ ভরা উদোম ঢেউয়ের বুকে আছড়ে পড়ে নিজেকে আরেকবার তরঙ্গায়িত করলাম।

ইউএনওর বাংলোয় ফয়সালের হাতের খিচুরি আর মরিচ ভর্তায় দুপুরের আহার শেষে বসলাম হাওরের মাঝে জলটুঙ্গি বরষা বিলাসে। রেওয়াজের কণ্ঠে-

‘তোল ভাটিয়ালি, এ নদী রুপালি ঢেউয়ের তালি নৌকা বাজাও
ছইয়ের নিচে কর্কট বিছে হাওয়ার পিছে দৃশ্য সাজাও…’

গানে গানে ফেরার সময় হয়ে এল। গোধূলির মুখে বিস্তীর্ণ হাওর, বরষা বিলাস ছেড়ে আমাদের চক্রযান যাত্রা শুরু করেছে চিরচেনা শহর ঢাকার পথে।

যাত্রাপথঃ
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে নিকলীর সরাসরি বাস আছে। বাস ভাড়া ১৫০ টাকা। আবার সায়েদাবাদ থেকে কিশোরগঞ্জের বাসে গিয়ে কালিয়াচাপরা সুগার মিল গিয়ে টেম্পুতে নিকলী হাওরের সামনেই নামা যাবে। ১৬০ কি.মি. দূরত্ব। সময় লাগবে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা (যাত্রাবাড়ীর ট্রাফিক জ্যাম বাদে)। জিরাতে পারেন ইনএনওর বাংলোয়। বাংলো থেকে কাছেই ঘাটে গিয়ে বিভিন্ন আকারের ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করতে পারেন বা আগে থেকে চুক্তি করে নিতে পারেন মসিয়াপুর বাজারের নজরুল সাউন্ড থেকে। ৬০-৭০ জন বজাকারের নৌকায় অনায়াসে যেতে পারে।

মোবাইল নম্বর : ০১৯১৪৩২১৯৭৫। ঘুরে আসুন আপনিও। তবে দল বেঁধে যাওয়াই ভালো।

লিখেছেনঃ  আঁখি সিদ্দিকা