– তোতা মিয়া এক কেজি ছোলা দ্যাও।
বলে ধীরে-সুস্তে বেঞ্চিটায় বসল উইল্লা চোরা। শুনতে অশোভন এ শব্দটি ছাড়া তার সত্যি কোন নাম আছে কি না এ তথ্য ময়নার জানা নেই। এ নামেই সবাই তাকে চেনে। ‘উইল্লা চোরা’ অবশ্য তার নাম নয় বরং পরিচয়। ‘নামে নয় গুণেই পরিচয়’ আরকি। উইল্লা বিলাইয়ের (হুলো বিড়ালের) মত ছেঁচড়া চুরির অভ্যাস নাকি তার ছোটকাল থেকেই। অমুকের গাছের লাউটা, গাছ পাকা কাঁঠালটা, সব্জি ক্ষেত থেকে মুলাটা প্রায়ই উধাও হয়ে যেতো আগে। আর এসবের দায়ভার উইল্লা চোরার উপরই বর্তাতো। তার আতঙ্কে নাকি ঘর খালি রেখে গ্রামের মহিলারা পাড়া বেড়াতে পর্যন্ত পারত না। পাছে কোন জিনিসটা চুরি হয়ে যায়!

সেই হিসাবে এখন বেশ শান্তিতেই আছে গ্রামের মানুষ। কারণ আগের সেই ছ্যাঁচরা চুরির অভ্যাসটা ছেড়ে দিয়েছে উইল্লা চোরা। তাই বলে যে চুরি-চামারি থেকে অবসর নিয়েছে এমনটি নয়। এখনও দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে তার নামে দরবার আসে মাসে তিন কি চারবার।

– তুমি ছোলা দিয়া কি করবা? জিজ্ঞেস করল তোতা মিয়া
– কি করাম মানে, রোজা রমজানের দিন ছোলা ছাড়া ইফতার অয় নাকি?
– আসার্য্য কারবার! তুমি অইলা গিয়া চুর (চোর) মানুষ, তুমি হিবার রোজা রাখছ নাকি?
একটু যেন লজ্জ্বাই পেল উইল্লা চোরা। তারপর ঘাঢ় নুইয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আরে বেশতি কতা কইঅ না। আমি চোর অইতাম ফারি, কিন্তুক স্বভাব বালা আছে।
– তাইলে তুমি হাছাহাছি রোজা রাকছ! যেন আকাশ থেকে পড়ে প্রশ্নটি করল তোতা মিয়া।
– রোজা লইয়া কেউ মিছামিছি কতা কয় নাকি? চিন্তা করছি এইবার থেইকা রোজা থাহুনের অভ্যাস করাম।
– বেশ বালা চিন্তা। কিন্তুক রোজা থাইক্কা চুরি-চামারি করলে কি আর রোজা অইব?
– চিন্তা করছি এইসব ছাইরা দিয়াম। এই মাসটা দেহি ইকটু পাক-পবিত্র অইয়া আল্লা-বিল্লা কইরা কাডায়া দিতারি কিনা।
– তাইলে এইমাসে তোমার কুকাম বন্দ থাকব?
– হ
– খালি এই মাসে থাকবঅ নাকি সারা বছর? ঈদের পরেই হিবার পাপ কামানি শুরু করবা!
– আরে নাহ, কইলামনা বালা অইয়া গেছি।
– বালা অইয়া গেলে বালা কতা। হুনঅ একটা কতা কই, রমজান মাস অইল গিয়া সংযমের মাস। এই মাসে সংযমের অভ্যাস করনের লাইগা আল্লায় কইছে। কারণ এই অভ্যাসের গতি যাতে সারা বছর থাহে। তুমি যুদি একমাস চুরি-চামারি ছাইরা বাঁচতে পার, তে সারা বছর পারতানা কেরে?
বাবার কথাটি বেশ ভালো লাগলো ময়নার। সাত্যিইতো একমাস ভাল হয়ে থাকতে পারলে সারাবছরইতো ভালো হয়ে থাকা যায়। দাদির কাছে সে শুনেছে রমজান মাস হলো অনুশীলনের মাস। রাতে সেহরি খাওয়া, ফজরের নামাজ পড়া, সকালে ঘুম থেকে উঠা, কাজে যাওয়া, ইফতার করা, তারাবির নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের সময় কাটে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। রমজান মাসে শয়তানকে নিয়ন্ত্রন করে রাখা হয় বলে মানুষের মাঝে খারাপ কাজ করার প্রবণতা কমে যায়। উইল্লা চোরাই এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

ততক্ষনে এক কেজি ছোলার প্যাকেট তোতা মিয়ার কাছ থেকে বুঝে নিলো উইল্লা চোরা। তারপর হাত বাড়িয়ে দশ টাকার চারটি কড়কড়ে নোট এগিয়ে দিলো।
– আরও পাঁচ টেহা দেওঅন লাগবঅ। দাম অহন বাড়তি, তোতা মিয়ার এ কথাতে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো উইল্লা চোরা।
– আরে কি কও, ছোলার দাম অত বাইড়া গেছেগা!
– খালি ছোলার দাম কেরে, রোজা উপলক্ষে অনেক কিছুর দামঅই অহন বাড়তি।
– রোযা অইলঅ গিয়া সংযমের মাস। আর বাংলাদেশের ব্যবসায়িরা এই মাসে সংযম করবতো দুরের কতা, লুটপাটের উৎসব লাগাইয়া দেয়। রোজার মাইদ্যে আমি উইল্লা চোরা গেলাম বালা অইয়া, আর ব্যবসায়ীরা শুরু করল ডেহাইতি (ডাকাতি)। হায় আফসোস!