টিপাইমুখে বাঁধ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান না হতেই ভারত এবার ব্রহ্মপুত্র নদের উপর বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে । আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে  বাংলাদেশের কৃষিসহ পরিবেশ নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ।  ব্রহ্মপুত্র নদের উপর চীনের বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ  নির্মাণের  খবর এবং তা নিয়ে  ইন্দো-চীনের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যে ভারতের এই পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে।

টরন্টোয় বসবাসরত বাংলাদেশী পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. এম মনিরুল কাদের মির্জা  নতুনদেশ ডটকমকে এই তথ্য প্রকাশ  করে বলেন, বাংলাদেশের কৃষির বড় একটি অংশ সেচসহ নানা কারণে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি প্রবাহের উপর নির্ভরশীল। চীন এবং ভারতের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশের উপর বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে।

উল্লেখ্য, ২ হাজার ৯০৬ কিলোমিটর দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র এশিয়ার বৃহত্তম নদী। এর প্রায় ১৬২৫ কিলোমিটার  চীনের তিব্বত এলাকায়  প্রবাহমান। আর ভারতের ভেতর প্রবাহিত হয়েছে ৯১৮ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়ার আগে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে রয়েছে মাত্র ৩৬৩ কিলোমিটার প্রবাহ।
খোঁঝ নিয়ে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র  নদীর পানি প্রবাহের পর্যালোচনা করতে ভারতের সরকারি উদ্যোগে বিদেশি বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। জার্মানীর ফ্রেডারিক গিলবার ইউনিভার্সিটির জিওইনফরমেটিক্স,হাইড্রোলিক্স বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে পরিচারিত সমীক্ষার প্রতিবেদন নয়াদিল্লি উদ্যোগি হয়ে আসামের রাজ্য সরকারের কাছে দিয়েছে।  ব্রহ্মপুত্র  নদের উত্তর পূর্ব উপত্যকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় রেখে নদী নিয়ন্ত্রণের লক্ষে এই সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এই প্রসঙ্গে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. এম মনিরুল কাদের মির্জা  বলেন, ভুটান থেকে  আসা ব্রহ্মপুত্র  উপনদীর উপর সুবর্ণসিঁড়িতে ইতিমধ্যেই ভারত  বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করেছে। মূল ব্রহ্মপুত্র নদীর উপরও বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করছে তারা।  অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই নানা ধরনের উদ্যোগের কথা চিন্তা করছে ভারত । ফলে ব্রহ্মপুত্রের উপর ক’টি বাঁধ হবে তা আমরা এখনো  জানি না।

এদিকে চীনের তিব্বত এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের উপর বড় ধরণের বাঁধ নির্মাণে ১৯৯৬ সালে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও গত বছর এটি আলোচনায় উঠে আসে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে  প্রথম তিব্বত অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর বিশ্বের বৃহত্তম একটি বাঁধ তৈরির  উদ্যোগের খবর প্রকাশিত হয়।  খবরে বলা হয়, মূলত  হাইড্রোলিক প্রকল্প নির্মাণের অংশ হিসেবে এই বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও চীনের সানস্কা, হেবেল, বেইজিং এবং তিয়ানজিন অঞ্চলের পানি সংকট দুর করতে ব্রহ্মপুত্র থেকে  পানিপ্রবাহ পরিবর্তন করে ২০০ বিলিয়ন কিউসিক মিটার পানি  ইয়েলো রিভারে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা রয়েছে চীনের।

চীনের গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হলে ভারতের সরকারি মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। দুই দেশের কূটনৈতিক এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা  হয়।  প্রতিটি আলোচনায়ই চীনা কর্তৃপক্ষ ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর কোনো বাঁধ নির্মাণ করার উদ্যোগের কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু  ভারতের ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং এজেন্সী (এনআরএসএ) স্যাটেলাইটে তোলা ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করে  সেখানে ট্রাক দিয়ে পণ্য পরিবহন এবং নির্মাণ কাজ চলার প্রমাণ পায়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সেই ভিডিও চিত্র দেখানোও হয়।

গত মাসে চীন সফরকালে ভারতের  পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণ  চীনা সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন। ভারতে ফিরে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, চীন বাঁধ নির্মাণের কথা সম্পূর্ণই অস্বীকার করেছে। তবে চীনের সরকারি পর্যায় থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীর তিব্বত অঞ্চলে পাঁচটি বাধ দিয়ে হাইড্রোলিক প্রকল্প তৈরির কথা স্বীকার করা হয়েছে বলে তনি উল্লেখ করেন। ভারতীয়মন্ত্রী পরে লোকসভায় জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে নেওয়া এই প্রকল্প ভারতের জন্যে কোনো ক্ষতির কারণ হবে না। চীনা প্রকল্পে পানি সংরক্ষণ বা পানিপ্রবাহ পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না বলে চীনের আশ্বাসের কথাও সংসদকে জানান।

একই সময়ে চীনের মিডিয়ায় খবর বেরোয়,  বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় চীন ব্রহ্মপুত্রের উপর পাঁচটি বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও চীনের সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, চীনের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি হোয়ানেঙ এই প্রকল্পের অর্থায়ন করছে। আর বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বড় বাঁধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গেজহাওবাকে ।

এদিকে গত ২৪ মে লণ্ডনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকা ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর চীনের বাঁধ নির্মাণের  পরিকল্পনা নিয়ে একটি সংবাদ পরিবেশন করে। দি গার্ডিয়ান লিখেছে, চীনের হাইড্রোপাওয়ার লবিষ্টরা ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ  নির্মাণের জন্যে সরকারে উপর প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। চায়না সোসাইটি ফর হাইড্রোপাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ঝেঙ বুটিং গার্ডিয়ানকে বলেন, ভারত বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন হলেও এতে বিশ্ব উপকৃত হবে। তবে চীনের সংশ্লিষ্ট সরকারি একটি সংস্থার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য উপাত্তের উদ্ধৃতি দিয়ে গাডির্য়ান বলছে, ওয়েবসাইটে  ৩৮ গিগাওয়াট প্ল্যান্ট  স্থাপনের প্রস্তাব  বিবেচনায় রয়েছে বলে  উল্লেখ  করা হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেঙ আলি-ইন্দাজের উপর বড় ধরনের বাঁধ নির্মাণের সময় চীন পাকিস্তানকে কিছুই জানতে দেয়নি। বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেলে পরে পাকিস্তান তা জানতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের উপর বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও চীন একই ধরনের কৌশল নিতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন।

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ  ড. এম মনিরুল কাদের মির্জা  বলেন,  যদিও চীনের বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগটি এখনো আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে, এটি  বাস্তবায়িত হলে চীন এবং ভারতের মধ্যে পানি নিয়ে সমস্যা তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে ভারতও পানি পাবে না, আমরাও পাবো না। বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

ড, মনিরুল কাদের মির্জা বলেন, ১৯৭৮ সালে ভারত বাংলাদেশ সরকারি পর্যায়ে ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল তৈরির একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। তাতে রংপুরের উপর দিয়ে খাল খনন করে ফারাক্কার উজানে পানি প্রবাহ তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছিলো। বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। বাংলাদেশের বড় একটি অংশকে মূল খণ্ড থেকে বিভক্ত করে ফেলবে আশংকায় বাংলাদেশ তাতে সম্মত হয়নি।

তিনি জানান, পানি নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে  চীনকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর অববাহিকাভিত্তিক সহযোগিতা  গড়ে তোলা যায় কী না তার প্রস্তাব করেছে। বৃহত্তর সহযোগিতা গড়ে না উঠলে এই অঞ্চলে পানি নিয়ে ভবিষ্যতে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।

সম্পাদকীয় – শওগাত আলী সাগর