কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহম্মদ এর লেখা থেকে জানা যায়, “কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের বর্তমানের সুদৃশ্য সিংহ দরজা সামনের বেষ্টনী দেওয়াল এবং সদ্য নির্মিত নতুন ভবন সহজেই সকলের সসম্ভ্রম দৃষ্টি আকর্ষন করে।এই সুসজ্জিত ও সুদৃশ্য প্রেসক্লাব বর্তমান অবস্থানে পৌঁছতে অতিক্রম করে এসেছে দীর্ঘ সিকি শতাব্দী কাল।কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেকটা নাটকীয় মন্ডিত।

১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে কিশশোরগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক হয়ে আসেন মরহুম এস, এ বারী।আমি তখন ‘Morning News’পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতারুপে সাংবাদিকতার সাথে মোটামোটি জড়িত।একদিন বারী সাহেব আমাকে বললেন,আপনারা একটা প্রেসক্লাব করেন না কেন? আমি সহাস্যে বল্লাম যে, কিশোরগঞ্জ সাংবাদিক কুলে আমরা দুজন।দু জনে কি আর একটা প্রেস ক্লাব করা যায়?তিনি দমে না গিয়ে বললেন কেন? ভৈরব বাজিতপুরেও সাংবাদিক আছেন, তাদের কে নিয়ে ক্লাব গঠন করুন।তাছাড়া শহরের বিজ্ঞজনের অনেকেইপ্রেসক্লাবের সদস্য হতে উৎসাহী হবেন।

সেই প্রথমিক আলাপের পর এস,ডি,ও সাহেব আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে আরও একাধিক দিন পরামর্শ করলেন।তারপর মহকুমা জনসংযোগ অফিসার কে দিয়ে প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার জন্য মহকুমার সকল সাংবাদিকদের এক সভা আহব্বান করালেন। তারিখটা ছিল ২২ ডিসেম্বর ১৯৬৬ খ্রিঃ।মহকুমা প্রশাসকের অফিস ক্ষক সভায় উপস্টহিত হলেন ভৈরবের জনাব সিরাজুল হক,জনাব আঃ হেলিল মোল্লা ,বাজিতপুরের জনাব ইনছাব উদ্দিন, কিশোরগঞ্জের আমি এবং পাকুন্দিয়ার জনাব আঃ রশিদ ভূঞা। সর্বসন্মতিক্রমে প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হলো। সভাপতি পদাধিকার বলে মহকুমা প্রশাসক এবং জনসংযোগ অফিসারকে করা হলো সেক্রেটারী। সেই হলো প্রেসক্লাবের সূচনা”।

তখন কিশোরগঞ্জে কর্মরত সাংবাদিকের সংখ্যা দুইজন হলেও পূর্বে সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন আরো অনেকে।যেমন-অবজারভারের জনাব আজিমুদ্দীন আহমদ,সংবাদের জনাব মহিউদ্দীন ভূঞা,ইত্তেফাকের জনাব একরামুল হক,মর্ণিং নিউজের অধ্যাপক আবদুল্লাহ,দেশ বিভাগের পূর্বেও যারা সাংবাদিকতার পেশার সসাথে জড়িত ছিলেন তাঁদীর মধ্যে সবার আগে যার নাম আসে তিনি হলেন গাঙ্গাটিয়ার শ্রী গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী উল্লেখ্য। মসূয়ার শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভূট্টাচার্য, পাকুন্দিয়ার মৌলভী খুরশীদউদ্দীন, বাঁশগাড়ীয়ার জনাব রিয়াজউদ্দীন আহমদ, গচিহাটার শ্রী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার ,বিশিষ্ট সমাজসেবক শ্রী ললিতকৃষ্ণ রায় ও শ্রী ললিতমোহন দাস,কিশোরগঞ্জ শহরের শশাংকমোহন চৌধুরী ও শ্রী ভূপেন্দ্র কুমার অধিকারী।

১৯৬৬ তে প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠালগ্নে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকেরই চেষ্টায় ইউনিয়ন কাউন্সিল এসোসিয়েশন হলের সামনের দিকের একই উইং এ প্রেসক্লাব তার যাত্রা শুরু করে।ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর ষাটের দশকেই আরো কয়েকজন নতুন সাংবাদিক আত্নপ্রকাশ করেন।ইত্তেফাকের জনাব মুস্তাফিজুর রহমান খান,পূর্ব দেশের জনাব মোঃ সাইদুর,অবজারভারের জনাব এম,এ সামাদ সাংবাদিক হিসেবে প্রেসক্লাবের সদস্য হন।পূর্বদেশ সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে উন্নীত হলে জনাব সাইদুর যোগ্যতার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেন। কিশোরগঞ্জের আর একজন মহিলা সাংবাদিকের নাম উল্লেখ্য করতে হয়,তিনি হলেন সুলতানা খালেদ।অনেকদিন তিনি সংবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন।

 

মহকুমা প্রশাসক জনাব আনোয়ারুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ১৯৬৯ খ্রীঃ ১৩ ই জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ সভায় সর্বপ্রথম প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হয়।স্বাধীনতার পর সাংব্দিকতার ক্ষেত্রে নতুণ পান চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়। তরুন সাংবাদিকদের ভিড়ে প্রেসক্লাব জমজমাট হয়ে উঠে।নতুনদের মধ্যে সর্বপ্রথম এসেছিলেন জনাব লিয়াকত হোসাইন মানিক (বাংলার বাণী),গোলাম রব্বানী বুলবুল,(বি,পি,আই), আহমদ ইকবাল সিদ্দিকী(অবজারভার), সৈয়দ আজিজুল বারী,(ইত্তেফাক),মিজানুর রহমান(গণকন্ঠ),প্রমূখ।এছাড়া অধ্যাপক ফজলে এলাহী বাংলাদেশ তাইমসের প্রতিনিধিরুপে প্রেসক্লাবের সদস্য তালিকাভূক্ত হন।প্রেসক্লাব তার ক্ষুদ্র কক্ষেই সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরকে। দীর্ঘ যাত্রার পরও কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাব তার নিজস্ব ঠিকানা করতে ১৯৭৬ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।মহকুমা প্রশাসক জনাব এম,এ শহীদএর সক্রীয় সহযোগিতায় বর্তমান স্থানে ক্লাবটি স্থানান্তরিত হয়,তখন প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক জিয়াউদ্দীন আহমদ,ও সাধারন সম্পাদক জনাব মোঃ সাইদুর, সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে মহকুমার প্রশাসক।

পরবর্তীতে আরো কয়েকজন তরুন সাংবাদিকের ভিড়ে কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাব কর্মচঞ্চল হয়ে উঠে।এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সর্বজনাব সুধীর বসাক(ইত্তেফাক), আবুবকর সিদ্দিক হিরো(সংবাদ),মুঃ আব্দুল লতিফ(দৈনিক দেশ), মোঃ সাইদুজ্জামান, কাজী শাহীন খান প্রমূখ। ১৯৮৮ খ্রীঃ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন বিখ্যাত কবি, সাংবাদিক ও মুক্তিযুধের ইতিহাস প্রনয়ন প্রকল্পের চেয়ারম্যান হাসান হাফিজুর রহমান। এই সময়ই কিশোরগঞ্জে কিছু সংখ্যক সংস্কৃতিবান ব্যক্তি এককালীন একহাজার টাকা করে চাঁদা দিয়ে প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে১ লা ফেব্রুয়ারী কিশোরগঞ্জ জেলায় উন্নীত হয়।সর্বশেষ মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব এম,এ মোতালিব মিয়া।এ সময়ে তারই উদ্যোগে প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা হয়।আগে পদাধিকার বলে মহকুমার প্রাশাসক প্রেসক্লাবের সভাপতি হতেন, তা পরিবর্তন করে সাংবাদিক  অর্থাৎ সাধারন সদস্যদের মধ্যে থেকে সভাপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় । সর্বশেষ মহকুমা প্রশাসকের কথা এজন্য কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাব আজো স্মরণ করে ।

১৯৯১ সালটি কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব কাজী নাসিরুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এর নতুন ভবনের দ্বারোদঘাটন হয় । ভেঙ্গে ফেলা হয় বাইরের দিকের জড়াজীর্ণ ভবন । নতুন ভবন, বেষ্টনী দেয়াল, সিংহ দরজা দীর্ঘদিন কাজী নাসিরুল ইসলামের স্মৃতি বহন করবে ।

১৯৬৬ তে দুজন সাংবাদিক নিয়ে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ সংখ্যায়, আকারে এবং বৈভবে আরো আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে, অভিযাত্রা তাই এখন সামনের পানে ।