ভাবছি বসে, ঢাকা থেকে একটু দূরে কোথায় যাওয়া যায়? বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি দেখতে গেলে কেমন হয়? জায়গাটা কোথায় তা বুঝতে কি আর বাকি থাকল? অনেক কারণেই খ্যাত ছোট্ট জনপদ ‘কিশোরগঞ্জ’। ষোড়শ শতাব্দীর কবি চন্দ্রাবতী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, নীরদ সি চৌধুরী, চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পিতৃভূমি এই কিশোরগঞ্জ। বেশি চেনা ‘মসনদ-ই-আলা’ দেওয়ান ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দুর দুর্গের জন্য।

দুর্গের নামেই ট্রেনের নাম। সকাল ৮টায় ট্রেন। ঢাকা থেকে পূর্বদিকে কিশোরগঞ্জ ১৩০ কিলোমিটার। ৭টায় কল্যাণপুর থেকে কমলাপুরের উদ্দেশে রওনা হই। ভ্রমণের ব্যাগে রাখা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের একটি তালিকা দেখে গুছিয়ে নিই মোবাইল ফোনের চার্জার, ছাতা, রেইনকোট, ওষুধপত্র, চাবি; ড্রেসের সঙ্গে মিল রেখে কিছু জুয়েলারি এবং অবশ্যই কয়েকটি বই। বেড়ানোর জন্য রেলগাড়ির চেয়ে ভালো বাহন আর কী হতে পারে? রেল স্টেশনে বিভিন্ন ট্রেনের সময়সূচি দেখে মনে হলো প্রতি মুহূর্তে কত দিক থেকে মানুষ ছুটছে তো ছুটছেই।

টিকিটের নম্বর মিলিয়ে জানালার পাশের সিটটি পেয়ে যাই। ট্রেনের জানালা দিয়ে নিমিষে মিলিয়ে যাওয়া দৃশ্য দেখা অন্য রকম মজার। চার ধরনের আসন রয়েছে এগারসিন্দুরে। প্রথম শ্রেণী, শোভন চেয়ার, শোভন ও সুলভ। যাত্রা শুরুর ৩৫ মিনিট পরে বিমানবন্দর স্টেশন ছাড়িয়ে যাই। আরেকটু এগিয়ে পাই তুরাগের ওপর টঙ্গী ব্রিজ। শাঁ শাঁ গতিতে সব কিছুকে পেছনে ফেলে ছুটতে থাকে ট্রেন। পুবাইলের তালটিয়ায় সারি সারি তালগাছ যেন জায়গার নাম সার্থক করতে দাঁড়িয়ে আছে। শীতলক্ষ্যায় নৌকা চলছে তিরতির করে। দুই পাশের দৃশ্য যেন নির্জনতার, আমাদের নয়। আঁকাবাঁকা শাখা নদীর তীর ঘেঁষে প্রকৃতির সবুজ মায়া জড়ানো জনপদ, হাটবাজার আর অবারিত ফসলের মাঠ।

ঘণ্টাখানেক পরে শীতলক্ষ্যার পাড়ে আড়িখোলা ক্রসিংয়ে ট্রেন থামে কিছু সময়ের জন্য। ঘোড়াশালে রেল লাইন থেকে বেশ নিচে অবস্থান শহর, জনপদ আর হাটবাজারের। কোনো এক কৌতূহল থেকে নিচের মানুষগুলো ওপরে তাকিয়ে দেখে গন্তব্যে ছুটতে থাকা বাহন আর তার যাত্রীদের। ট্রেনে ভ্রমণের সুবিধা একনাগাড়ে বেশিক্ষণ বসে না থেকে এক বগি থেকে অন্য বগিতে ঘুরে বেড়ানো যায়। নরসিংদী স্টেশনে যাত্রা বিরতিতে ওই এলাকার বিখ্যাত সাগর কলা নিয়ে হকাররা আসতে থাকল একের পর এক। কাঁচা ও পাকা দুই রকমের দুই কাঁদি সাগর কলা বেশ সস্তায় কিনে নিলাম। দাঁতের মাজন, চিপস, কোমল পানীয়, পেঁয়াজ-মরিচে মাখানো চানাচুর ভাজা, বাদাম নিয়ে আরো অনেকে এল। ঝিরঝির বাতাসে বৃষ্টির ছোঁয়ায় চায়ের তৃষ্ণা টের পেলাম। রেল রেস্টুরেন্টের গরম গরম কাটলেটের সঙ্গে চায়ের অন্য রকম মজা, ভ্রমণের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। ট্রেনটি ইসলামপুর, রায়পুরা, মেথিকান্দা, দৌলতকান্দি স্টেশন পেছনে ফেলে এগোতে থাকে। গতি শ্লথ হয়ে আসে ভৈরব ও দৌলতকান্দির মাঝামাঝি এক জায়গায়। ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেসের ক্রসিংয়ের জন্য অনির্ধারিত এই যাত্রাবিরতি। মহানগর এক্সপ্রেস মহাগতিতে আমাদের অতিক্রম করে যায়। ধীরগতি ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে, ট্রেনটি ভৈরব জংশনে এসে পেঁৗছায়। তখন সকাল ১০টা। মেঘনার সুশীতল বাতাস গা জুড়িয়ে দেয়। বৃষ্টিতে ধুয়ে প্রকৃতি সতেজ হয়ে উঠেছে।

মেঘনা সেতুর একপাশে আশুগঞ্জ সার কারখানা, পাওয়ার হাউস আর অন্য পাশে নিঃসীম নীলাকাশ, নিচে বিশাল জলাভূমি। জানলাম জলাভূমির কচুরিপানার নিচে মেলা মাছ। ঢাকা থেকে অনেকেই ছুটে আসেন এই মেঘনা ঘাটে। সহজে দেখা মেলে না এমন দুর্লভ মাছ পাওয়া যায় এখানে। অন্য আরেকটি কারণে বিশেষ খ্যাত এই এলাকা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদিত হয় ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ এলাকায়। এ পথেই ব্রিটিশ আমলে জুট ট্রেডিং করপোরেশনের সি প্লেনে আসা-যাওয়া করত ইংরেজ বেনিয়ারা। এখনো নিকলী দামপাড়ায় বড় বড় পুরনো পাটের গুদাম সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। অন্য অনেক যাত্রীর মতো আমিও প্ল্যাটফর্মে নেমে কিছু মৌসুমি ফল কিনে নিলাম। ২৫ মিনিটের যাত্রাবিরতি শেষে আবার ছুটতে শুরু করে ট্রেনটি। ইঞ্জিন পরিবর্তনের কারণে হঠাৎই মনে হলো, যেন উল্টোরথে আবার ঢাকার দিকে ছুটছি। এরপর ট্রেন কুলিয়ারচরে পেঁৗছাল। এখানে বড় বড় কোল্ড স্টোরেজ এবং ফিশ প্রসেসিং প্লান্ট আছে। বিদেশ যাওয়ার আগে মাছেরা কুলিয়ারচর হয়ে যায়। পরবর্তী স্টেশনে পেঁৗছানোর আগেই সাদা এপ্রোন পরা যাত্রীদের ব্যস্ততা মনে করিয়ে দিল সামনে বাজিতপুর। এখানে দেশের একসময়ের সেরা ধনী জহিরুল ইসলামের নামে স্থাপিত হয়েছে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। ট্রেন আবারও চলতে শুরু করেছে। পাশের কামরা থেকে গান ভেসে আসছে। গিয়ে দেখি দুজন অন্ধ লোক সাহায্যের আশায় কোরাস গেয়ে যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। মানিকখালীর সামান্য পশ্চিমে বর্ষার পানিতে ভরা বিলে সাদা বেগুনি শাপলা শালুক তুলছে দুরন্ত ছোট ছেলেমেয়েরা। পাশেই তাল গাছের তৈরি ছোট ডিঙিতে চড়ে মাছ ধরাতে ব্যস্ত মধ্যবয়সী জেলেরা।

সরারচর, মানিকখালী স্টেশন পেরিয়ে গচিহাটা স্টেশন। এখানে মিনিট দুয়েকের বিরতি। দ্রুত নামছে যাত্রীরা, কেউ কেউ উঠছেও। কিশোরগঞ্জ আর মাত্র ১৫-২০ মিনিটের পথ। অবশেষে যখন ট্রেন গন্তব্য ছুঁয়ে দিল তখন ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১২টা। থাকা-খাওয়ার জন্য শহরে বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। স্টেশন রোডেই প্রিন্স হোটেল, গাংচিল, হোটেল নিরালা, হোটেল মোবারক। হোটেল নিরালায় ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রিকশা করে যেতে লাগলাম শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে নীলগঞ্জের পথে চন্দ্রাবতীর মন্দির দেখার জন্য। মন্দিরটি ফুলেশ্বরী নদীর পাড়ে পাতুয়াইল গ্রামে। অনেক কিংবদন্তি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতীকে নিয়ে। তাঁর ভালোবাসার মানুষ বিজয়ানন্দ আরেকজনকে মন দিয়ে ফেললে চন্দ্রাবতী নিজেকে পুরোপুরি দেবতার পায়ে সমর্পণ করেন। একটা ঘরের মধ্যেই সারা দিন কাটাতেন এবং বসে বসে পদ রচনা করতেন। চন্দ্রাবতীর বাবা সেই জায়গায় পরে একটা শিব মন্দির বানিয়ে দেন। ফেরার পথে সন্ধ্যায় শোলাকিয়া মাঠের পাশ দিয়ে রিকশা অতিক্রম করছিল। কোনো একসময় সোয়া এক লাখ লোকের জায়গা হয়েছিল এ মাঠে। তাই এর নাম শোলাকিয়া। সেখানে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের নামাজ হয় এখন। রাত্রি যাপন শেষে পরের দিন এগারসিন্দুর প্রভাতীতে ৬টা ২০ মিনিটে কিশোরগঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসি।

সময় ও ভাড়া
ঢাকা থেকে এগারসিন্দুর প্রভাতী সকাল ৮টায় এবং গোধূলি ৬টা ২০ মিনিটে ছাড়ে। কিশোরগঞ্জ থেকে ছাড়ে প্রভাতী সকাল সাড়ে ৬টায়, গোধূলি বেলা ১টায়। ভাড়া প্রথম শ্রেণী ১২৫ টাকা, শোভন চেয়ার ৮৫ টাকা, শোভন ৬৫ টাকা ও সুলভ ৫০ টাকা।