৬০ একর জমিতে অট্টালিকা, বাগানবাড়ি, সামনে অন্দরমহল, বাড়ির সামনে একটি বড় দিঘি, পেছনে সমান আয়তনের আরও দুটো দিঘি। বীরচন্দ্র মাণিক্যের অর্থানুকূল্যে, কুমিল্লার চর্থায় এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কুমার বাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র। এই প্রাসাদে ১৯০৬ সালের পয়লা অক্টোবর তাঁর ছোট সন্তান শচীন দেববর্মণের জন্ম। কুমিল্লার এই বাড়িটি হতে পারত শচীন দেববর্মণের প্রদর্শশালা। প্রতিবছর পয়লা অক্টোবর লোকগানের মেলা বসত। পুরোনো বাংলা গান, কুমিল্লায় বসে নজরুলের লেখা গানগুলো, শচীন কর্তার গান, সব মিলিয়ে এক বিশাল উত্সবের আয়োজন সারা বাংলাদেশের গানপাগল মানুষকে জড়ো করত। বাইরে থেকে আমন্ত্রিত লোকশিল্পীরা আসতেন, বেজে উঠত তাকদুম তাকদুম বোলে বাংলাদেশের ঢোল। এ যদি বাস্তবে হতো তাহলে কী অপার আনন্দে স্পর্শকের মতো ছুঁয়ে যেত প্রতিটি বাঙালির হূদয়। বাস্তবে কী হলো—দেশ ভাগের পর ওটা কিছুদিন মিলিটারি গুদাম, পরে পশু চিকিত্সা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং তারও পরে সরকারি হাঁস-মুরগির খামার। আর এখন বাড়িটির সামনে খামারের নতুন ভবন। আদি বাড়িটি আর চোখে পড়ে না।

পিতা নবদ্বীপচন্দ্র নিপুণ সেতার শিল্পী। ধ্রুপদাঙ্গ গানের ধারাল কণ্ঠ, মৃত্তিকাশিল্পী, অসামান্য মূর্তি গড়তেন। মা মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবী। পিতৃমাতৃকুলের ঋদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শচীন দেবকে ছোটবেলা থেকে সংগীতে বিপুলভাবে টেনেছিল। মার্গ সংগীতের প্রথম গুরু তাঁর বাবা। লোকসংগীতের প্রথম গুরু মাধব ও আনোয়ার। দুজনায় বাড়ির ভৃত্য। ‘মাধব নামে আমাদের এক বৃদ্ধ চাকর ছিল। রোববার ছুটির দিনে খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরে এই মাধব আমাদের সুর করে রামায়ণ পড়ে শোনাত। সে যখন সুরে রামায়ণ পড়ত তখন তার তান খটকী ছাড়া সরল সোজা গানের ধরন আমাকে পাগল করে দিত। কোনো ওস্তাদি নেই কিন্তু কত অনায়াসে সে গেয়ে যেত। আমাদের বাড়িতে আনোয়ার নামে আরেক ভৃত্য ছিল। আনোয়ার রাতে তার দোতারা বাজিয়ে যখন ভাটিয়ালি গান করত তখন আমার ব্যাকরণ মুখস্থ করার দফারফা হয়ে যেত। এরাই হলো লোকসংগীতে আমার প্রথম দুই গুরু মাদব ও আনোয়ার। আমি মার্গ সংগীত যত পছন্দ করতাম ঠিক ততখানি মাধব-আনোয়ারের গানেও মুগ্ধ হতাম।’ (সরগমের নিখাদ—শচীন দেববর্মণ)।

কুমিল্লা শচীন দেবকে গানের চেতনায় সম্পন্ন করে তুলেছিল এবং তা প্রধানত লোকসংগীত। লোকসংগীতের বিবর্তন-চিহ্নগুলো শচীন দেবের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যখন তিনি গ্রামে-গ্রামান্তরে গানের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন। নদী জলে, নৌকায়, জেলেদের সঙ্গে, চাষিদের সঙ্গে, বাউল বোষ্টম ভাটিয়ালি গায়কদের সান্নিধ্যে, গাজন দলের সঙ্গে—গান শুনে, শিখে, গেয়ে বিভিন্ন ধরনের গান সংগ্রহ করেছেন—‘পূর্ববঙ্গে ওই অঞ্চলের এমন কোনো গ্রাম নেই বা এমন কোনো নদী নেই যেখানে আমি না ঘুরেছি। আমার এখনকার যা কিছু সংগ্রহ, যা কিছু পুঁজি সে সবই ওই সময়কার সংগ্রহেরই সম্পদ। লোকসংগীতে আমার আত্মা যে প্রাণ পায়, আমি যে মাটির মানুষের সঙ্গে তাদের সান্নিধ্যে প্রকাশিত হয়েছি, তাই তাদের সহজ সরল গ্রাম্য সুর আমার গলায় সহজে ফুটে ওঠে। সেই সুরই আমার কল্পনার রাজ্য, আপনা থেকেই তা জাগে, গলায় আপনা থেকে তা বেজে ওঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা গলায় এসে যায়। এ সুর নিজের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে।’ (সরগমের নিখাদ—শচীন দেববর্মণ)।

বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় লোকসংগীতের ফর্মগুলো গড়ে উঠেছে, যেমন ভাটিয়ালি, সারি, ভাওয়াইয়া, বাউল, ঝুমুর, ধামাইল ইত্যাদি। এই বিবর্তনটা চাপিয়ে দেওয়া নয়, এটা নির্দিষ্ট সামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী ওই অঞ্চলের মানুষের ভেতরই প্রয়োজনে হয়ে থাকে। যেমন বাউল, ভিত্তিটা ছিল ঝুমুর। গ্রামের বা ওই অঞ্চলের কিছু অগ্রসরমান মানুষ তাদের ভাবনার, তাদের অনুভূতির কাজগুলো এই গানের মধ্যে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হন, তাতে আঙ্গিকের বদল হয় এবং সেটা ওই গ্রাম বা অঞ্চলের মানুষ অবলীলায় গ্রহণ করে নেয়। লালনের বাউল আর বীরভূমের স্টাইলাইজড বাউলের তফাত্টা স্পষ্ট। নতুন ভাবনা, নতুনভাবে উপস্থাপন করতে গেলে নতুন আঙ্গিকের প্রয়োজন আর সেই প্রক্রিয়ায় ফর্মটির পরিবর্তন ঘটে। একমাত্র লোকসংগীতের সুর শুনে অঞ্চল চিহ্নিতকরণ সম্ভব। চার ভাগে এই অঞ্চল বিভক্ত। উত্তরাংশে ভাওয়াইয়া, দক্ষিণে বনবিবি দক্ষিণ রায়ের গান, পূর্বভাগে ভাটিয়ালি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ঝুমুর শৈলীর প্রতিপত্তি। বাংলাদেশে ভাটিয়ালি গায়নশৈলী দ্বারা সব আঙ্গিকের লোকগান যেমন বাউল দেহতত্ত্ব, গুরুবাদী, মনঃশিক্ষা, ইসলামি, ফকিরি, মুর্শিদি ইত্যাদি কম-বেশি প্রভাবিত। স্মৃতি আর শ্রুতির সাহায্যে পুরুষপরম্পরায় এক আশ্চর্য ধ্বনিভঙ্গিমায় ও শৃঙ্খলায় অনুসৃত বলে এই স্বর বহুস্তরে ও বহুবিস্তারে আজও প্রাণময়।

যে কুমিল্লা লোকসংগীতে শচীন দেবের অন্তর্দীপ্ত করেছিল, যে সংগীত তাঁর আত্মাকে নিরন্তর স্বপ্নাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, রাজবাড়ীর আবহ, আদব-কায়দা যাঁকে বাঁধতে পারেনি, যে গ্রাম্য সুর গলায় ফুটে উঠত সহজে সেই কুমিল্লার সাংস্কৃতিক আবহটি কেমন ছিল সে সময় (১৯১০—১৯২০) তার একটা হদিস করা যাক। ঠাকুরপাড়ার সুরলোক, কান্দির পাড়ের সবুজ সংঘ নাট্যদল, দি গ্রেট জার্নাল থিয়েটার পার্টি, ইয়ং ম্যানস ক্লাব ইত্যাদি নিয়ে সংগীত ও নাট্যচর্চায় রীতিমতো গমগম করছিল কুমিল্লা। ত্রিপুরার মহারাজারা কুমিল্লায় শুধু বিশাল বিশাল দিঘি খনন করেননি; তৈরি করেছেন টাউনহল, নাট্যশালা, লাইব্রেরি এবং নানা সংস্কৃতিক কেন্দ্র। সাহিত্যচর্চা, সংগীত, নাটক ও খেলাধুলায় প্রাণবন্ত ছিল কুমিল্লা। শচীন দেবের বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, সমরেন্দ্র পাল, কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলবালা দাম, ধ্রুপদীয়া সৌরেন দাশ, সুধীন দাশ প্রমুখ; যাঁরা সুরলোকে একাট্টা হয়ে সংগীতচর্চা করতেন। সেখানে নিয়মিত আসতেন চলচ্চিত্র পরিচালক সুশীল মজুমদার, ননী মজুমদার, ব্রজেন ব্যানার্জি, জিতু দত্ত, অরুন মহলানবিশ প্রমুখ ব্যক্তি। ভোরকীর্তন, নগরকীর্তন, কবিগান, ঢপযাত্রা তো নিয়মিত হতোই। সাহিত্যিক সুরকার গীতিকার কবি ও সংগীতজ্ঞদের আড্ডা বসত ইয়ংমেন্স ক্লাবে।

আসতেন গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ, কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য, হিমাংশু দত্ত ও অধ্যাপক সুধীর সেন। আসতেন সবার নজরকাড়া নজরুল, আড্ডা থেকে ভেসে আসত নজরুল ও শচীন দেবের গান। নজরুল কুমিল্লা এলে থাকতেন অনেক দিন। তালপুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি ঘরে। বাঙালি সংস্কৃতির যে ব্যাপ্তিবৈচিত্র্য ও বিশ্বজনীন বিচারণা সেখানে কুমিল্লার রয়েছে একটি বিশেষ জায়গা। আর এই কুমিল্লা শচীন দেববর্মণের সংগীত ভিত্তিটি শুধু তৈরি করে দেয়নি ভবিষ্যত্টাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের গ্রামীণ বা পল্লীসংস্কৃতি সেই সময় সৃষ্টি করেছিল এক অসাধারণ ঐতিহ্য যে সমাজে মুসলিম-হিন্দু একই সঙ্গে রাখালিয়া ঐতিহ্য থেকে মার্গসংগীত সমানভাবে আত্মস্থ করেছে। সংগীতগুরু আলাউদ্দিন খাঁর কথা ভাবুন, শিবপুর তো গ্রামই, কী অসামান্য লোকগান গাইতেন, পরে মার্গ সংগীতে ভারত জয় করলেন।

কুমিল্লা থেকে শচীন দেব কলকাতা এলেন ১৯২৫ সালে। প্রবল ইচ্ছে ছিল নামকরা হিন্দুস্তানি ওস্তাদের কাছে সংগীত শিক্ষার। সেই সুত্রে কৃষ্ণচন্দ্র দে, বদল খাঁ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, শ্যামলাল ক্ষেত্রীর কাছে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে আয়ত্ত করলেন ভারতীয় মার্গসংগীত থেকে শুরু করে ঠুমরি, দাদরা, ভজন। বেনারসি ঠুমরি এবং ঠুমরির বোল বানানোর কায়দা শিখলেন শ্যামলাল ক্ষেত্রীর কাছে আর লয়কারি ও দাদরার সঞ্চয় ও নৈপুণ্য কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে। অমিয়নাথ সান্যালের কাছেও শিখেছেন ঠুমরির বোল বানানোর শুদ্ধ পদ্ধতি। ভারতীয় সংগীতের বিদগ্ধ রসিক ও সমঝদার ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর সংগীত সাধনায় উত্সাহদাতার অন্যতম।

১৯৩১ আর ১৯৩২, এই দুই বছরে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা সংকট ও অনিশ্চয়ের উত্কণ্ঠা সত্ত্বেও শচীন দেবের প্রত্যয় প্রতিজ্ঞাকে সংহত করেছিল, সংগীতে তাঁর অবস্থানকে করেছিল নিশ্চিত। ১৯৩১ সালে পিতা নবদ্বীপচন্দ্র কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীন দেব তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। পিতার মৃত্যুর পর ‘আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিল্লা গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোনো উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইরা আমাকে তাই করতে বললেন। আমার কিন্তু এ ব্যবস্থা মনঃপূত হলো না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সংগীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে একমাত্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমার আস্তানা বাঁধলাম।’ (সরগমের নিখাদ—শচীন দেববর্মণ) আর অন্যটি ১৯৩২ সালে, অডিশনে ফেল করলেন রেকর্ড প্রস্তুতকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এইচএমভিতে; কারণ কি? অনুনাসিক স্বর রেকর্ডের অনুপযুক্ত!

গভীরতর সমস্ত শিল্পই উঠে আসে কোনো এক গহন দুঃখের উপলব্ধি থেকে। একদিকে পিতা হারানোর গভীর শূন্যতাবোধ, অন্যদিকে প্রবল প্রত্যাখ্যান তাঁকে নিরেট বাস্তবের মুখোমুখি এনে শুধু দাঁড় করাল না, করল সংকল্পে দৃঢ়।

১৯৩২ সালে হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে বের হলো শচীন দেবের প্রথম রেকর্ডকৃত দুটি গান। পল্লীগীতির ঢঙে গাওয়া ‘ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে’, গীতিকার হেমেন্দ্র কুমার রায়, বিখ্যাত নাচঘর পত্রিকার সম্পাদক ও খাম্বাজ ঠুমরি অঙ্গের রাগপ্রধান ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’ গীতিকার শৈলেন রায়, মার্গ সংগীতের ছোঁয়ায় আধুনিক গান। ব্যস, আর পেছনে ফিরে তাকানোর অবকাশ হয়নি শচীন দেবের। তারপর তাঁর প্রতিটি গানে অসাধারণ সুরেলা কাজ, অপূর্ব মুন্সিয়ানা, বিচিত্র সুর গলায় তুলে নিয়ে গেয়েছেন অবলীলায়। তাঁর গলায় একটা জোয়ারীর আওয়াজ কণ্ঠের মূল সুরের সঙ্গে মিশে স্বপ্নাচ্ছন্ন করে রাখে। লোকসংগীত ও কাব্যর্সগীতের অন্তর্লীনতায় তিনি তৈরি করেছেন একটা নিজস্ব ইডিয়ম ও আইডেনটিটি। বাঁশি, তবলা, তালতরঙ্গ, সেতার, সরোদ, দক্ষিণামোহন ঠাকুরের দিলরুবা—এ নিয়ে তাঁর অধিকাংশ গান। সঠিক সুরে গাওয়াটা গানের একটি অংশ মাত্র। কিন্তু গানের আঙ্গিক যা কথা ও সুরে নির্দিষ্ট, তা গায়নভঙ্গিতে ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারছে কি না সেটাই প্রধান, সেটাই গানের প্রাণ।

সৃষ্টিশীল মানুষের অভিপ্রায়ে প্রবল থাকে পরিচয়চিহ্ন, যা দেখলে শুনলে বলে দেওয়া যায় এ অমুক শিল্পীর কাজ। শচীন দেব তাঁর সুরে ও প্রয়োগে যে শৈলীর উদ্ভাবন করলেন বাংলা গানে তা অভিনব এবং চিরকালীন। তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে রয়েছে গায়কি, সাবেকি উচ্চারণ, পরিমিতিবোধ, একধারে রাগসংগীত ও লোকসংগীতে সমান দক্ষতা এবং এ দুটিকে মিলিয়ে নিজস্ব উপলব্ধির মধ্য দিয়ে সুর ও বাণীর অন্তর্গত বোধের উন্মোচন, অবিচল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গানের ভেতর বাংলাদেশের লোকজীবনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার বিরল ক্ষমতা।

কাব্যসংগীতের যে মেধা ও মননতীব্র আন্দোলন জেগে উঠেছিল তিরিশের দশকে তার সঙ্গে লোকসংগীতের সমন্বয় ছিল শচীন দেবের একক কীর্তি। ১৯৩৪ সালে অল ইন্ডিয়ান মিউকিজ কনফারেন্সে তিনি গান গেয়ে ওস্তাদ করিম খাঁর আশীর্বাদধন্য হয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে ঠুমরি পেশ করে আফতাব এ মৌসকী ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে মুগ্ধ করেছিলেন। শেখ ভানুর রচনা ‘নিশিথে যাইয়ো ফুলবনে’ দেহ ও সাধনতত্ত্বের গানটিকে প্রেমের গানে রূপান্তর করলেন মরমী কবি জসীমউদ্দীনকে দিয়ে এবং রূপান্তরিত এই গানটি রেকর্ড করলেন ১৯৩৫ সালে। ২০০৯ সালেও গানটির আবেদন বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন হয়নি। এখানে তিনি অনন্য। অলংকার বর্জন করে ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বাউল, জারির সঙ্গে পশ্চিমি ফোক মিশিয়ে বাংলা গানের অন্য ভুবন নির্মাণ করলেন। গলার বৈশিষ্ট্যও একটি প্রধান বিষয়। শচীন দেবের কণ্ঠ অনুনাসিক, ভাঙা, ভেতরে একটি স্বর বাজে, আছে বিলাপধ্বনি, ক্রন্দনাকুলতা, আছে ঝোঁক, খোঁচ, নাটকীয়তা, আছে শব্দকে নিয়ে সুরের লহরী খেলানো, পল্লী বা লোকগীতির আঙ্গিকে সিদ্ধকাম এবং এসব একত্র করে তাঁর গান মার্জিত মৌলিক ও অননুকরণীয়।…‘গলার গঠনের একটা বাস্তব ভিত্তি আছে। তা শ্রমপ্রক্রিয়াগত, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ জলমাটি হাওয়াজাত কতকটা জাতি বা গোষ্ঠীগত কতকটা শারীরিকগত কতকটা বাকভঙ্গিগত। গলা ভাঙা, গলার খোঁচ বা লৌকিক অলংকার কোনো শহুরে ওস্তাদ হাজার রেওয়াজ করেও আয়ত্তে আনতে পারেন না। শহুরে কণ্ঠ লোকসংগীতের মেলডিক স্ট্রাকচারটা ঠিকই আয়ত্ত করতে পারেন কিন্তু কণ্ঠভঙ্গিটি আয়ত্ত করতে পারেন না। তাতে করে সেই গানে মাটির গন্ধটি পাওয়া যায় না, বড়ই আরবান মনে হয়। লোকসংগীত গুরুমুখী নয়, গণমুখী, ঘরানা নেই, আছে বাহিরানা। লোকসংগীতের ভাবানুষঙ্গটি সার্বজনীন, অনুভূতিও’ (হেমাঙ্গ বিশ্বাস)।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হেমাঙ্গ বিশ্বাস ম্যানুফ্যাকচারড ফোক মিউজিক নিয়ে বলতে গিয়ে লিখেছেন… ‘এক বৈঠকী আলোচনা আসরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছোটবেলায় গ্রামে শেখা এক লোকগীতি গেয়ে উঠলেন—

নিরলে কইও দুঃখ বন্ধুর লাগ পাইলে
আমার বন্ধু রঙ্গী চঙ্গী
হাওরে বানাইছে ঢঙ্গী
তবু পরান না জুড়ায় বাতাসে গো নিরলে…

পরিণত বয়সে তাঁর কণ্ঠে খাঁটি সুরে গ্রাম্য গায়কি শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন গায়কিটাই আসল কথা, বলেই সেই একই পর্দায় রাগসংগীতের গায়কিতে গেয়ে বললেন ‘এখন আর ইটা লোকসংগীত থাকল না…’

এখানেই শচীন দেববর্মণের কৃতিত্ব। রাগসংগীত ও লোকসংগীতের মিশেলে অভিজ্ঞতা শ্রুতি, কল্পনা ও কারুকৃতির অন্তরবয়ানে একটা স্বতন্ত্র গীতভাষা তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন ঐতিহ্যের দায়কে অতিক্রম করে। তার গানের অনবদ্য আবেদন, স্বচ্ছতা ও সারল্য এখনো বাঙালিকে বুদ করে রাখে। এটাকেই পল রবসন হয়তো বলেছেন মিউজিক অব দি পিপল।

মীরা ধর ছিলেন স্বর্গত জজ রায়বাহাদুর শ্রী কমলনাথ দাশগুপ্তের দৌহিত্রী। ১৯৩৭ সাল থেকে শচীন দেবের কাছে গান শিখতেন। এ ছাড়া তিনি ভীষ্মদেবের কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের কাছে ঠুমরি ও কীর্তন, অনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্রসংগীত এবং অমিতা সেনের কাছে নৃত্যে তালিম নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে শচীন দেবের সঙ্গে তাঁর পরিণয়। হলেন মীরা দেববর্মণ। জীবন ও কর্মের সুযোগ্য সঙ্গী। শচীন দেবের সংগীত রচনার আজীবন সাথী। আর গান লেখার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের গীতিকারদের কাতারে তাঁর বিশেষ জায়গাটি সংরক্ষিত। শোন গো দখিন হাওয়া, বিরহ বড় ভাল লাগে, সুবল রে বল বল, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে, কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া এবং ১৯৭১ সালে লেখা তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল।

শেষোক্ত গানটি গভীর তাত্পর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো শচীন দেব আরব সাগরের পাড়ে থেকেও প্রতিনিয়ত খবর নিতেন বাংলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধে কতটুকু জয় হাসিল করতে পারল। ভালো খবরের জন্য উত্সুক হয়ে থাকতেন। মীরাকে কুমিল্লার কথা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ঘুরে বেড়ানোর কথা, লোকগান সংগ্রহ থেকে যে ব্রাত্য সংস্কৃতিকে পরমাদরে আত্মস্থ করেছেন তার গল্প শোনাতেন অবিরত। তাঁর আত্মা তখন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম। মীরা কর্তার আবেগ ও আকুতি বুঝতে পেরেছিলেন আর তাই ১৯৭১ সালে রেকর্ড হলো ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’। এই গান দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার সবটুকু ঢেলে দিলেন। জন্মভূমির ধূলি মাথায় ঠেকিয়ে গাইলেন ‘বাংলা জনম দিলা আমারে/তোমার পরান আমার পরান/এক নাড়ীতে বাঁধারে/মা-পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারো নাই/সব ভুলে যাই তাও ভুলি না/বাংলা মায়ের কোল’। কী অসামান্য প্রাণস্পর্শী রচনা, কী হূদয়কাড়া সুর আর কী উদ্দীপক গায়নভঙ্গি।

১৯৭৫ সালে প্যারালিটিক স্ট্রোক হয় শচীন দেবের। কোমায় ছিলেন পাঁচটি মাস। প্রতিদিন মীরা দেববর্মণ ও পুত্র রাহুল কুমিল্লার গল্প, ত্রিপুরার গল্প, কলকাতার গল্প, বাংলাদেশের গল্প শুনিয়ে গেছেন, যদি জেগে ওঠেন গানের রাজকুমার শচীন দেববর্মণ। ৩১ অক্টোবর, অক্টোবর তাঁর জন্মমাস, তিনি চোখ বুজলেন।

কুমিল্লার চর্থায় শচীন দেববর্মণের আদি বাড়িটি আর চোখে পড়ে না। হাঁস-মুরগির খামারের নতুন বাড়িটি তাকে আড়াল করেছে। ‘হে পোড়া কপালে সোনার কাকন হানি’ কী হতভাগ্য আমরা। ভারতীয় সংগীতে প্রণম্য, সংগীতগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আদি নিবাস শিবপুরে তাঁর জন্ম দিনে কোনো উত্সব হয় না।
হয় না বলে আমরা চর্থার বাড়িটি ঘিরে তাই উত্সবের স্বপ্ন রচনা করি, না হোক সত্যি তবু ভাবতে ভালো লাগে তরুণ প্রজন্ম গিটার হাতে, লোকশিল্পীরা একতারা ও দোতারা নিয়ে গানের আসর বসিয়েছে। সারা বাংলার মানুষ উপচে পড়েছে কুমিল্লায়। কারণ আজ পয়লা অক্টোবর, আজ (২-১০) বাংলা গানের রাজকুমার শচীন দেববর্মণের জন্মদিন।