সুয়েডীয় বিজ্ঞানী আলফ্রেদ নোবেল নোবেল পুরস্কারের প্রচলন করেন। ১৯০১ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা, উদ্ভাবন ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য এই পুরষ্কার দেওয়া হয়। মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হল: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি। নোবেল পুরস্কারকে এ সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তদেরকে ইংরেজিতে নোবেল লরিয়েট বলা হয়।

নোবেল মৃত্যুর পূর্বে উইলের মাধ্যমে এই পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে যান। অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে, কিন্তু অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে। আলফ্রেদ নোবেল তার উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেননি। ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট নোবেল লরিয়েটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮৭ যার মধ্যে ৭৬৮ জন (৩৩ জন নারী) ব্যক্তিবিশেষ এবং ১৯টি প্রতিষ্ঠান। লরিয়েটদের কয়েকজন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। নোবেল পুরস্কার মৃত কাউকে দেয়া হয় না। লরিয়েটকে অবশ্যই পুরস্কার প্রদানের সময় জীবিত থাকতে হবে।

 

বিষয়
বৈশিষ্ট্যসমূহ
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার
রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি (Kungliga Vetenskapsakademien ভেতেন্‌স্কাপ্‌স্‌আকাদেমিয়েন) কর্তৃক নির্ধারিত। “পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া হবে।”
রসায়নে নোবেল পুরস্কার
রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত। “যিনি রসায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উন্নয়ন করবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া হবে।”
চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার
কারোলিন্‌স্কা সমিতি (Karolinska Institutet কারোলিন্‌স্কা ইন্‌স্তিতেৎ) কর্তৃক নির্ধারিত। “যিনি চিকিৎসা অথবা জীব বিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া হবে।”.
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার
সুয়েডীয় একাডেমি (Svenska Akademien স্‌ভেন্‌স্কা আকাদেমিয়েন) কর্তৃক নির্ধারিত। “যিনি সাহিত্যের জগতে সবচেয়ে বিশিষ্ট রচনাটি সৃষ্টি করবেন যা অবশ্যই কোন আদর্শের জন্ম বা লালন করবে তাকে এই পুরস্কার দেয়া “
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার
নরওয়েজীয় নোবেল সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত। “যিনি জাতিসমূহের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং বৃদ্ধি, যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত সেনাবাহিনীর অপসারণ বা হ্রাস এবং শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া “
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার
এই পুরস্কারটিকে মূলত The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel নামে ডাকা হয়। এটি প্রদান করার ব্যাপারে আলফ্রেদ নোবেল তার উইলে কিছু বলে যাননি বরং সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর প্রচলন করে। রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত।
 
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার:

নরওয়েজীয় নোবেল সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত। “যিনি জাতিসমূহের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং বৃদ্ধি, যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত সেনাবাহিনীর অপসারণ বা হ্রাস এবং শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া “

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার

এই পুরস্কারটিকে মূলত The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel নামে ডাকা হয়। এটি প্রদান করার ব্যাপারে আলফ্রেদ নোবেল তার উইলে কিছু বলে যাননি বরং সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর প্রচলন করে। রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত।

পুরস্কার প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা:

পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োজিত তারা সবাই ঠিক অক্টোবর মাসে লরিয়েটদের নাম ঘোষণা করে। ঘোষণার পর ১০ অক্টোবর তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক প্রদান করা হয়। এই দিনটি আলফ্রেদ নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকী।  নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান পূর্বে নরওয়েজীয় নোবেল সমিতি (১৯০৫ – ১৯৪৬) এবং অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আউলা-তে (অডিটোরিয়াম) (১৯৪৭ – ১৯৯০) অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে অসলো সিটি হলে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছাড়া অন্য পুরস্কারগুলো প্রদান করা হয় স্টকহোম কনসার্ট হলে।

প্রতি বছর একই বিষয়ে সর্বোচ্চ তিনজনকে পুরস্কার দেয়া যায়। এই লরিয়েটদের প্রত্যেককে দেয়া হয়; একটি স্বর্ণপদক, একটি ডিপ্লোমা, সুইডেনের নাগরিকত্ব এবং একটি মোটা অঙ্কের অর্থ। বর্তমানে এই অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১০ মিলিয়ন সুয়েডীয ক্রোনার (১ মিলিয়ন ইউরোর সামান্য বেশি/ ১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই অর্থ প্রদানের মূল কারণ এই যে, লরিয়েটরা যেন পুরস্কার পাবার পর তাদের আরো উচ্চতর গবেষণা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যে সময় নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় সে সময় দেখা যায় অধিকাংশ লরিয়েটই অবসর জীবন যাপন করছেন।

১৯০২ সাল থেকে সুইডেনের রাজা স্টকহোমে পুরস্কার বিতরণ করে আসছেন। প্রথম বছর সুইডেনের রাজা ছিলেন রাজা ২য়অস্কার; তিনি এতো মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার বিরোধী ছিলেন। এজন্য তিনি পু্রষ্কার প্রদানে সম্মত হননি। পরবর্তীতে অবশ্য জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্য এবং সুইডেনের সম্মান রক্ষার খাতিরেই তাঁকে মত পরিবর্তন করতে হয়েছে।

১৯০৪ সালে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি গঠিত হয়। এর আগে নরওয়ের রাষ্ট্রপতি নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার দায়িত্ব পালন করতেন। গঠনের পর কমিটির ৫ জন সদস্য শান্তি পুরস্কার দেবার জন্য গবেষণামূলক কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করে। তাঁদেরকে নরওয়েজীয় আইনসভা মনোনয়ন দেয়, তথাপি তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। নরওয়ের আইনসভার সদস্যরা এই কমিটিতে অংশ নিতে পারেন না।

 

আলফ্রেদ নোবেলের উইল

সুইডেনের রসায়নবিদ ও শিল্পপতি আলফ্রেদ নোবেলের উইল অনুসারে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন, যার মাধ্যমে তার প্রচুর আয় হয়, আর এই আয়ের অর্থ দ্বারাই তিনি পুরস্কার প্রদানের কথা বলে যান। জীবদ্দশায় নোবেল অনেকগুলো উইল লিখেছিলেন, এর মধ্যে সর্বশেষটি লিখেন তার মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে নভেম্বর ২৭, ১৮৯৫ তারিখে। নোবেলের উদ্ভাবনটি ছিল অনেকাংশেই একটি বিস্ফোরক যা প্রভূত ক্ষতির কারণ হতে পারত। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে এই ডিনামাইটের ব্যবহার তাকে শঙ্কিত করে তোলে। নোবেল পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার দেয়ার জন্য তার মোট সম্পত্তির শতকরা ৯৪ ভাগ দান করে যান। এর মোট পরিমাণ ৩১ মিলিয়ন এসইকে (৩.৪ মিলিয়ন ইউরো, ৪.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

“The whole of my remaining realizable estate shall be dealt with in the following way:

The capital shall be invested by my executors in safe securities and shall constitute a fund, the interest on which shall be annually distributed in the form of prizes to those who, during the preceding year, shall have conferred the greatest be

nefit on mankind. The said interest shall be divided into five equal parts, which shall be apportioned as follows: one part to the person who shall have made the most important discovery or invention within the field of physics; one part to the person who shall have made the most important chemical discovery or improvement; one part to the person who shall have made the most important discovery within the domain of physiology or medicine; one part to the person who shall have produced in the field of literature the most outstanding work of an idealistic tendency; and one part to the person who shall have done the most or the best work for fraternity among nations, for the abolition or reduction of standing armies and for the holding and promotion of peace congresses.

The prizes for physics and chemistry shall be awarded by the Swedish Academy of Sciences; that for physiological or medical works by the Caroline Institute in Stockholm; that for literature by the Academy in Stockholm; and that for champions of peace by a committee of five persons to be elected by the Norwegian Sorting. It is my express wish that in awarding the prizes no consideration whatever shall be given to the nationality of the candidates, so that the most worthy shall receive the prize, whether he be Scandinavian or not.”

– আলফ্রেদ নোবেল

যদিও আলফ্রেদ নোবেল এই পুরস্কারের প্রচলন করেছেন, তথাপি তিনি এর কার্যক্রম দেখে যেতে পারেননি। কারণ তার পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ ছিল না। এছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু কারণে নোবেল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠায় কিছুটা দেরী হয়। প্রখম নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় ১৯০১ সালের ডিসেম্বর ১০ তারিখে।

মনোনয়ন এবং নির্বাচন

অন্যান্য পুরস্কারের তুলনায় নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন ও নির্বাচন পদ্ধতি বেশ দীর্ঘ এবং কঠোর। এই কারণেই নোবেল পুরস্কার পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারের মর্যাদা পেয়েছে।  নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট মনোনয়নপত্র রয়েছে। সমগ্র বিশ্ব থেকে নির্বাচিত ৩০০০ জনকে এই মনোনয়নপত্র দেয়া হয় যাতে তারা তা পূরণ করে পুরস্কারের আবেদন করতে পারে। নোবেল শান্তি পুরস্কার নির্বাচনের জন্য এমন সব ব্যক্তিদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয় যারা এ বিষয়ে বিশেষ কর্তৃত্বের দাবীদার।

উল্লেখযোগ্য নোবেল বিজয়ীবৃন্দ
মেরি কুরি, ইতিহাসে দুইবার করে নোবেল বিজয়ী চারজনের একজন ইতিহাসে মাত্র চারজন দুইবার নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। এরা হলেন:

মেরি কুরি
পদার্থবিজ্ঞান: ১৯০৩ (তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার)
রসায়ন: ১৯১১ (বিশুদ্ধ রেডিয়াম পৃথকীকরণ)

লিনাস পাউলিং
রসায়ন: ১৯৫৪ (অরবিটাল সংকরণ তত্ত্ব)
শান্তি: ১৯৬২ (নিউক্লিয় শক্তির পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ আইনের বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা)

জন বারডিন
পদার্থবিজ্ঞান: ১৯৫৬ (ট্রানসিস্টর আবিষ্কার)
পদার্থবিজ্ঞান: ১৯৬২ (অতিপরিবাহিতার তত্ত্ব)

ফ্রেডেরিক স্যাংগার
রসায়ন: ১৯৫৮ (ইনসুলিন অণুর গঠন আবিষ্কার)
রসায়ন: ১৯৮০ (ভাইরাসের নিউক্লিওটাইডের ধারা আবিষ্কার)

এছাড়াও আরও কয়েকজন নোবেল লরিয়েট কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এদের মধ্যে রয়েছেন:

অটো হাইনরিখ ওয়ারবার্গ
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস

জর্জ বার্নার্ড শ:
একমাত্র ব্যক্তি যিনি নোবেল পুরস্কার এবং অস্কার অ্যাওয়ার্ড, উভয়টিই লাভ করেছেন।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙ্গালীদের তালিকা:

মুহাম্মদ ইউনূস: বাংলাদেশী বাঙ্গালী
অমর্ত্য সেন: ভারতীয় বাঙ্গালী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ভারতীয় বাঙ্গালী

 

 

তথ্যসূত্রঃ
আলফ্রেদ নোবেলের উইল, নোবেল ফাউন্ডেশনের দাপ্তরিক ওয়েবসাইট থেকে নেয়া, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০০৭, উইকিপিডিয়া