ঢাকায় বারোভুঁইয়াদের বংশধরদের কীর্তির মধ্যে একটি স্থাপনা বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে এখনো। এটি একটি মসজিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মলিন পুরোনো এ মসজিদ এখন চারপাশের বহুতল ভবনগুলোর আড়ালে পড়ে গেছে। তাই চট করে আর চোখে পড়ে না। নাম ‘মুসা খান মসজিদ’। ইতিহাসখ্যাত বারোভুঁইয়াদের অন্যতম মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খানের নামে মসজিদটির নামকরণ। মুসা খানের কবরও রয়েছে অদূরেই, মসজিদের পূর্ব-উত্তর পাশের মাঠের কোনায়। একটি হেলে পড়া পলাশগাছ নামফলকবিহীন সাদামাটা কবরটিকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে।

পিতা ঈশা খাঁর মতো অতটা পরাক্রমশালী ও খ্যাতিমান না হলেও বাংলার ইতিহাসে মুসা খানের নাম একেবারে উপেক্ষণীয় নয়; বিশেষ করে, রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা সুবাদার ইসলাম খান এখানে আসার পথে যাঁদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, দিওয়ান মুসা খান তাঁদের অন্যতম। বেশ কয়েক দফা প্রবল লড়াই হয়েছিল দিওয়ান বাহিনীর সঙ্গে সুবাদার বাহিনীর। তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়বীতে। শেষ পর্যায়ে অবশ্য মুসা খান সুবাদার ইসলাম খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সুবাদারের সঙ্গে সম্পর্কও সহজ হয়ে এসেছিল একপর্যায়ে। কার্জন হলের পশ্চিম দিকের চত্বরটি ‘বাগে-মুসা খান’ বা মুসা খানের বাগান বলে পরিচিত ছিল একসময়।

পূর্বদিকে ভূতত্ত্ব বিভাগ, উত্তরে বিজ্ঞান অনুষদের ডিনের কার্যালয় ও অগ্রণী ব্যাংক, দক্ষিণে শহীদুল্লাহ হল এবং আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদের ডিনের কার্যালয়। মাঝখানে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মুসা খান মসজিদ। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের পাশেই জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিমের কবর। তারপর সীমানাপ্রাচীর-সংলগ্ন নামিজউদ্দিন রোড। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের দ্বিতল বাসের সারি। ফলে একেবারে কাছে না গেলে মসজিদটি চোখে পড়ে না। দক্ষিণ দিকে ডিনের কার্যালয়ের সামনে দিয়ে একটি সরু রাস্তা ধরে আসতে হয় মসজিদে।

নাম মুসা খান মসজিদ হলেও তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা নন বলেই ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত। এর স্থাপত্যশৈলী শায়েস্তা খানের স্থাপত্যরীতির মতো। সে কারণেই সন্দেহ। শায়েস্তা খান ঢাকায় আসেন আরও পরে। অধ্যাপক এম হাসান দানীর মতে, মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন মুসা খানের নাতি মনোয়ার খান। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনও তাঁর ঢাকা: স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘দানীর মতোই যুক্তিযুক্ত।’ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়াও তাঁর বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, মসজিদটির নির্মাতা সম্ভবত মুসা খানের পুত্র মাসুম খান অথবা পৌত্র মনোয়ার খান। পিতা বা পিতামহের নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিল বলেই তাঁর অনুমান। নাজিমউদ্দিন রোডের নামও একসময় ছিল মনোয়ার খান রোড। মসজিদে কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি বলে এর সঠিক নির্মাণকাল ও নির্মাতার নাম নিয়ে এ ধরনের ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের শুরুর মধ্যে মসজিদটি নির্মিত বলে ঐতিহাসিকদের অনুমান।

মুসা খান মসজিদটি দেখতে অনেকটা খাজা শাহবাজের মসজিদের (তিন নেতার মাজারের পেছনে) মতো। ভূমি থেকে উঁচু মঞ্চের ওপর মসজিদটি নির্মিত। নিচে অর্থাৎ মঞ্চের মতো অংশে আছে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ। এগুলো এখন বন্ধ। দক্ষিণ পাশ দিয়ে ১২ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় মসজিদের দরজায়। পূর্ব দিকে খোলা বারান্দা। চওড়া দেয়াল। পূর্ব-পশ্চিমের দেয়াল ১ দশমিক ৮১ মিটার ও উত্তর-দক্ষিণের দেয়াল ১ দশমিক ২ মিটার চওড়া। পূর্বের দেয়ালে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে দুটি খিলান দরজা। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালের মধ্যে একটি প্রধান ও পাশে দুটি ছোট মেহরাব। চারপাশের দেয়ালে মোগলরীতির নকশা। বাইরের দেয়ালের চার কোণে চারটি মিনারখচিত আট কোণ বুরুজ। তার পাশে ছোট ছোট মিনার। বুুরুজ ও ছোট মিনার ১৬টি। ছাদে তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি বড়। ওপরের কার্নিশ নকশাখচিত। বাইরের দেয়ালের পলেস্তারা মাঝেমধ্যেই খসে গেছে। ছাদে ও কার্নিশে জন্মেছে পরগাছা।

২৪ বছর ধরে মসজিদের খাদেম সানাউল্লাহ। খণ্ডকালীন কাজ। ১০০ টাকা দিন হাজিরা। মনে খেদ নিয়ে তিনি বললেন, মসজিদটির সংস্কার হওয়া দরকার। ওজুখানা ও শৌচাগারও বেহাল অবস্থায় আছে। পশ্চিম দিকে একটি তোরণ নির্মাণ করলে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি সামনের পথ থেকে লোকজনের চোখে পড়ত। তবে যাঁরা মসজিদটি চেনেন তাঁরা আসেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় হয় এখানে। ঢাকার পুরোনো দিনের গৌরবের স্মৃতি হয়ে আছে স্থাপনাটি।