২০১০। শীতের  শুরু।  নিউ ইয়র্ক-দুবাই লংফ্লাইট শেষে,  এয়ার পোর্ট লাউঞ্জে বসে আছি। বসে থাকতে হবে পাক্কা চারঘন্টা, তারপর ঢাকার উদ্দেশ্যে। মিসৌরি,সারলট নিঊইয়র্ক থেকে আনা বাসি খবরের কাগজ গুলুর বিজ্ঞাপন পড়া ছাড়া আর কিছু  বাকী নেই। টার্মিনালটা  কয়েকবার চক্কর দিলাম।  আমি ট্রানজিট এয়ারপোর্টে থাকলে  যে কাজ টা সাধারনত করি তাই করলাম  মিশে গেলাম বাঙ্গালী যাত্রীদের সাথে।

এ কাজটাতে আমার উপকার বহুমাত্রিক। প্রথমত অনেক ক্ষন পরে বাংলাতে কথা বলা যায়, অনেক  সুখ দুঃখের কথা জানা যায়।ট্রানজিট দেশ সমন্ধে জানা  যায়। আবার দেশ পর্যন্ত  কার সাথে বসলে  সময় টা ভালো কাটবে অর্থাৎ  আমার সিট মেট কে হবে তাও নির্বাচন করে নেয়া যায়। ইচ্ছা করেই  তাদের মাঝখানটাতে গিয়ে বসে পরলাম।  আমার সাথে নিউইয়র্ক থেকে আসা ফ্যামিলিটাকে দেখলাম বেশ দূরে বসে আছে বেশ ক্লান্ত।বাচ্চা দুটো বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘুমে কাতর। কর্তার অবস্থাও তাই। কর্ত্রী জেগে পাহারাতে। আসার সময় গোসল করে আসা হয়নি। নিউইয়র্ক এয়ারপোর্ট এও গোসলখানার সন্ধান পাইনি। সারারাত  ওখানে শুয়ে বসে কাটিয়ে সকাল এ ফ্লাইটে উঠেছিলাম। অস্বস্তি লাগছিলো।  খুজতে খুজতে পেয়ে গেলাম গোসলখানা, তার সাথে এক দেশী ভাই যিনি গোসলখানার তত্ত্বাবধানের কাজে নিয়োজিত। কথা বললাম ,ভাই এদেশে আছেন  তিনবছর। কুমিল্লার মানুশ।

আমাকে জিজ্ঞাশ করলেন আমি দুবাই এ কত দিন যাবত আছি,।আমি যখন বললাম আমি অনেক দূর থেকে এসেছি যানতে চাইলেন কোথা থেকে আমি বললাম। ঊনি আমার কথা শুনে কোথা থেকে যেন একটা নতুন সাবান এনে দিলেন। আমি ঊনার হাতে সাবানের টাকাটা আন্তর্জাতিক  দরে পরিশোধ করলাম, নিতে চাইলেন না। অনেক জোরাজোরিতে নিলেন।  চোখে মুখে  অনেক কৃতজ্ঞতার ছাপ।  আমি হাল্কা গরম গোসল করলাম।   গোসল থেকে বাইরে এসেও দেখলাম উনি দিব্যে দরজার বাইরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো  দাড়িয়ে। কুশল জিজ্ঞাস করলাম। জানতে চাইলাম দেশে কে আছে বিনম্র লজ্জায় জানালো নতুন বউ বিয়ে করেই চলে এসেছিলো। মা, বাবা বোন।

মানিব্যাগ থেকে বউয়ের ছবি বের করতে করতে বললেন “ দাদা  কি পাপে যে  এই দ্যেশ আইছিলাম,ঋন টা শোধ কইরাই দ্যাশে চইলা যামু”  আমি বললাম দেশে গিয়ে কি আমি আপনার বাড়ীতে যাব? আপনার পরিবার পরিজন কে আপনার কুশল জানাবো? বললো না স্যার, আমি  বাথরুমের ডিঊটি না করলে আফনেরে কইতাম আমার বাড়ীতে যাওনের জইন্য” আমি বললাম আপনি কোথায় ডিউটি করেন আমি বলবো না। জবাব দিলো” আপনার কষ্ট করা লাগব না। মোবাইলেই কথা অয়”। জিজ্ঞাস করলাম কবে যাবেন দেশে,  দীর্ঘশ্বাস এর সাথে জবাব দিলো “পাপ মোচন যেই দিন অইবো, সেদিন ই দাদা “ –নিশ্চিত কোন জবাব পেলাম না। চোখে মুখে অনিশ্চয়তার ছাপ।

নিজের জায়গায় ফিরে এসে দেখি কেউ নেই।  ডিপারচার মনিটরে দেখলাম আমার ফ্লাইট এর গেট পরিবর্তন।  নতুন গেটে গিয়ে দেখি বিরাট বড় লম্বা লাইন। সবাই বাঙ্গালী। দুবাই থেকে এবং দুবাই এর পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে  এসেছেন  ঢাকাতে যাবেন। আশ্চর্য হলাম  প্রায় সবার হাতেই কমপক্ষে দুটো করে ঢাঊস  সাইজের  গুড়ো দুধের  কৌটা। পরে জানতে পেরেছিলাম  দেশে এ দুধের দাম অনেক বেশী হওয়াতে  বিমান এ ঊঠার আগ মুহুর্তে  দেশী ভাইয়েরা শুল্ক মুক্ত বিদেশী দুধ যতখুশী দুবাই থেকে কিনে নেন। যাক খুশি হলাম।

আমি যাকে আমার প্বার্শে বসার জন্য অনুরোধ করেছি, বেশ রসিক। উনি ও দুধ পার্টি। মজার মজার কথা বলছেন। আমিও যোগ দিচ্ছি।  বেশ প্রফুল্ল। জিজ্ঞাস করলাম  কতদিন পরে দেশে ফিরছেন বললেন “তিন মাস। কোন পাপ যে করছিলাম ভাই। এত টাকা খরচ কইরা আইছিলাম, থাকতে  পারলাম না বউ বাচ্চারে রে যে কি  জবাব দিমু, আরবী হারামজাদারা  কিচ্ছু আনতে দেয় নাই। অনেক কাকুতি মিনতি কইরা বাইচ্চা দের জন্য কিছু দুধ নিয়া আসলাম”। অবৈধ কাগজের জন্য থাকতে পারেন নি। মজা করে বললেন “ভাই আপনার তো এয়ারপোর্টে বউ বাচ্চা আসবে কতই না আনন্দ!  আর আমি যে আসছি কেঊ  জানেই না”। আমি বলল্লাম ভাই আমার কেউ আসবেনা। সাধারনতঃ আমি  এয়ারপোর্টে কাঊকে আসতে বলিনা।  জানালেন উনি যাত্রাবাড়ীর  লোক। আমি বললাম কোন অসুবিধা নাই আমিও যাত্রাবাড়ীর কাছাকাছিই যাবো। আপনি আমার সাথেই যেতে পারবেন। আশ্বস্ত হলেন।

রাত প্রায় ন’টায়  অবতরন।  ব্যাগেজ নিতে নিতে প্রায় পৌনে এগারটা। যখন টার্মিনাল থেকে বেড়িয়েছি, ট্যাক্সির সংখ্যা খুবি কম। যাত্রাবাড়ীর ভাই, এগিয়ে গিয়ে  কোথা থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এলেন। বেশ বিধ্বস্থ চেহারার ট্যাক্সী, এত রাতেও  ঘেমে জুবুথুবু হয়ে ড্রাইভার সাহেব ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে আমাদের লাগেজ উঠালেন। যাত্রাবাড়ীর ভাই আমাকে  পেছনে বসালেন।  উনার আশংকা আমার হাতের আই ফোনের নিরাপত্তা জনিত বিষয়। বরাবরের মতই ভ্যপসা গরম। ট্যাক্সী ছুটে চলছে।  কিছুক্ষন যাবার পর  ড্রাইভার ভাই জানালেন । শর্টকাটে যাবেন।  আমি আপত্তি করলাম না কারন বরাবরই মানুষ মাপতে আমার ভুল কমই হয়।  জায়গাটার নাম বলতে পারবো না ,তবে একটা বাজারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বেশ জ্যাম। গরম।  গাড়ি এগুচ্ছে  কচ্ছপ গতিতে। ড্রাইভার মেজাজ খারপ করে  ইতিমধ্যে নিজে নিজেই  ছোটখাটো  গালিগালাজ  আরম্ভ করছে। একটু ফাক পেতেই  টান দিলো।  ঠিক এমনি সময়ে এক লোক হাতে জেনো কি  একটা ঝুলিয়ে  গাড়ীর সামনে দিয়ে এক দৌড়ে  রাস্তা অতিক্রম করে  ডিভাইডারের উপর  দাড়িয়ে  নিজেকে সামলে নিতে যাবে -তখনি আমাদের ড্রাইভার  আচমকা ব্রেক   কষে জানলা দিয়ে মুখ বের করে ঐ লোকের মা’কে তুলে অশ্রাব্য গালিটা দেয়া মাত্রই… ছপাৎ!! ছপাৎ !!

পর পরই রাস্তার কিছু  ছুরে ফেলার  ভাঙ্গা আওয়াজ! দেখলাম, ট্রাইভার সাহেব দু হাতে মুখ ধরে স্টেয়ারিং হুইলে আছেরে পরেছেন,  সামনে বসা যাত্রাবাড়ির ভাইয়ের চোখ মুখ সাদা, ড্রাইভার সাদা, উইন্সিল্ড সাদা, গাড়ির ভেতরে সবই সাদা।  এত দ্রত ব্যাপারটা ঘটলো,  আমি হতভম্ব , কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভাবলাম  নিশ্চিত পরে গেছি আজ ছিনতাইকারীর কবলে,  কিছুটা আচ করতে পেরেই  ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করলাম  বিষয়টা কি হলো ভাই , ড্রাইভার বল্লো “ হালার পুতে দুধ মারছে” আমি বললাম  জ্বি কি বললেন- ? -“হালায় দুধ ফিক্কা মারছে”  বলেই লাফ দিয়ে ডিভাইডারে দাড়িয়ে থাকা লোকটার সামনে আমাদের ড্রাইভার এগুতেই ডিভাইডারের লোকটা রাস্তার  ওপারে দাড়িয়ে থাকা কাকে জানি ডাকা মাত্রই ৫/৬ জন লোক বীরদর্পে আমাদের ড্রাইভার সাহেবকে  ধরার জন্য এগুতে থাকলো, ভাবলাম, এখন হবে লুট পাট। জানালা দিয়ে মুখ বের করে ড্রাইভার কে  ডেকে নিলাম। অবস্থা পর্যবেক্ষনে  বাইরে এসে দেখালাম রাস্তায় পরে আছে দুধের পাত্র। আনুমানিক ৫-৭ কেজির সাইজ। দুধ ভাই কে বুঝিয়ে বললাম। ঊনি বললেন –“স্যার হালায় আমার মা তুইল্যা গালি দিলো ক্যান”। আমি ও ড্রাইভার কে মৃদু শাষালাম।

গাড়ি চলতে থাকলো সাথে ড্রাইভারের মুখও সমান তালে। বারবার  নিজের শরীরে দুধের  গন্ধ নিচ্ছে আর গালিগালাজ পরিমানও বাড়ছে । উইন্সিল্ড উইপার  এপাশ ওপাশ করে দুধ পরিস্কার করছে!!  আঠালো হয়ে যাচ্ছে কাচ। বিরক্ত হচ্ছেন ড্রাইভার।  দারুন ভাবে  আনন্দিত হলাম ।। উইন্সিল্ডে বৃষ্টী দেখলাম, তুষার দেখলাম ,বরফ দেখলাম ,- বাকী ছিলো দুধ!!- আমি বললাম নেমে পানিতে কাচ টা পরিস্কার করার জন্য। এক বোতল পানি কিনে কাচ পরিস্কার করলেন ড্রাইভার। এখনো রাগ পরে নাই। গাড়ী চলছে। আমি বললাম ভাইসাব জীবনে  কি ঘোরতর পাপে জরিত ছিলেন?  ড্রাইভার বিরক্তসুরেই বল্লো “কেনো স্যার, এই কথা যে বলাতাছেন”  আমি বললাম আপনি বা আপনার গাড়ী যদি কোন  প্রকার পাপ  করে থাকেন তবে আজকে তা দুধ গোসলে পবিত্র হয়া গেলো! কজনের  ভাগ্যে এইটা হয়?  ড্রাইভার  একদম চুপ হয়ে গেলো। বলতে  লাগলাম দেখুন আপনি  ওরে মা তুইলা গালি দিলেন  আর  ও আপনেরে দুধ এর গোসল দিল। ড্রাইভারের মুখে হালকা হাসি দেখা গেলো।

বলতে থাকলাম, ভাই- আগের, দিনে রাজা মহারাজারা যা পাইতো না , আপনি আইজ তা পায়া গেলেন।  -যাত্রাবাড়ীর ভাই মুখ খুললেন “ আরে ঠিক ই তো” । দুধের গোসল!!  কত বিরাট ব্যাপার। ড্রাইভার  হেসে হসে বলতে লাগলো “স্যার আপনের কথাতে আমার রাগ তো একবারে পানি হইয়া গেলো।। আমি তো স্যার এই  ভাবে  জিনিষটা  চিন্তা করি নাই।  বউ রে যায়া আইজ রাইতেই কইতে অইবো  আইজ থেইক্যা তুমার স্বামীর চরিত্র দুধের মতো পবিত্র”। মনে মনে হাসলাম। বলতে লাগলাম ড্রাইভার ভাই দেখুন এই ভাই সুদুর দুবাই থেকে এত কষ্ট করে বাচ্চাদের জন্য গুড়ো দুধ নিয়ে আসছে আর আপনি আল্লাহর মেহেরবানীতে  দেশে বইসা ঐ ব্যাটার  চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার কইরা একদম খাটি দুধের  গোসল পাইলেন।  ড্রাইভার জবাব দিলো, “আহ যা কইলেন স্যার একদম একশ তে একশ”  যাত্রাবাড়ীর ভাই আলোছায়াতে আমার দিকে তাকালেন “ভাইসাব আমি ও তো দুধে  ভিজলাম, তয় উনার মতো পুরাপুরি না অর্ধেক, তাইলে আমার পাপ কি  অর্ধেক হইলেও মোচন হইলো?     জবাব দিলাম ভাইসাব, কারো  মুক্তি ত্যাগে,- কারো আবার ভোগে, কারো হয় যতনে- কারো মিলে রোদনে।

ট্যাক্সী টা  আমার হোটেলেরসামনে।  অনেক রাত। ট্যাক্সি থেকে নেমে ড্রাইভার কে ভাড়া দিতে থাকলাম, ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে বলতে  লাগলো “ একটা কথা বলি স্যার, রাখবেন” বলো  “আজকের রাইতটা কি আপনে আমার গরিব খানাতে  তসরিফ রাখবেন, আপনের কথা গুলু অনেক মনে ধরেছে, আমার সব পাপের যে আইজ মোচন হইলো, সেইঠা যদি আপনি দয়া কইরা আমার বউয়েরে আপনি নিজে বলতেন বউটা আমারে কোন দিনও বিশ্বাস করলো না”- বললাম আরেক দিন ভাই, খুব ভোরে আমাকে ধরতে হবে “হাওরবিলাস”।

লিখেছেনঃ আসিফ ইকবাল খোকন