দেবব্রত বিশ্বাস (২২ আগস্ট ১৯১১ – ১৮ আগস্ট ১৯৮০) এক স্বনামধন্য ভারতীয় বাঙালি রবীন্দ্রসংগীত গায়ক ও শিক্ষক। দেবব্রত বিশ্বাস ভারতের গণনাট্য আন্দোলনেরও অন্যতম পুরোধাপুরুষ ও একজন বিখ্যাত গণসংগীত গায়কও বটে। রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি দরবারের অব্যবহিত পূর্বে জন্ম বলে তাঁর ডাকনাম রাখা হয় জর্জ। পরবর্তীকালে অনুরাগীমহলে তিনি জর্জ বিশ্বাস বা জর্জদা নামেও সমধিক পরিচিত ছিলেন।

জীবন:দেবব্রত বিশ্বাসের জন্ম কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার নন্দীহাটিতে। বাড়ীর ভগ্নাবশেষ এখনো জন্মস্থানের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রমোহন বিশ্বাস। পিতামহ কালীমোহন বিশ্বাস ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে নিজগ্রাম ইটনা থেকে বিতাড়িত হন। শৈশবে কিশোরগঞ্জের বিদ্যালয়ে দেবব্রত সেই কারণে ‘ম্লেচ্ছ’ বলে বিবেচিত হতেন। শিশুবয়সেই মা অবলা দেবীর মাধ্যমে ব্রহ্মসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে পরিচিত হন। মহেন্দ্র রায়ের কাছে দেশাত্মবোধক গান শেখেন এবং কিশোরগঞ্জের স্বদেশী সভায় অল্পবয়স থেকেই গান গাইতেন।

১৯২৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। এই সময় ব্রাহ্মসমাজ ও পরে শান্তিনিকেতনে গান গাইবার আমন্ত্রণ পান। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে। ১৯২৮ সালের ব্রাহ্ম ভাদ্রোৎসবে কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখেন দেবব্রত। ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন এবং ১৯৩৪ সালে হিন্দুস্থান ইনসিওরেনস কোম্পানিতে বিনা মাইনের চাকরিতে যোগদান করেন। পরের বছর চাকরি পাকা হয় ও বেতন ধর্য হয় ৫০ টাকা। এই চাকরি সূত্রে রবীন্দ্রনাথের ভাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র সুবীর ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ হয়ে দেবব্রতের। মূলত এঁদেরই সূত্রে রবীন্দ্রসংগীত জগতে পদার্পণ করেন দেবব্রত। ১৯৩৮ সালে কনক দাশের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে প্রথম তাঁর রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড। এই সময় থেকে হিজ মাস্টার্স ভয়েস ও অন্যান্য রেকর্ড সংস্থা তাঁর গান রেকর্ড করতে শুরু করে। রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি গণসংগীত ও অন্যান্য গানও গাইতেন। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, এই সময় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়েছিল এবং নজরুল তাঁর গান শুনে তাঁকে দুটি শিখিয়ে সেগুলি রেকর্ড করিয়েছিলেন। একটি গান “মোর ভুলিবার সাধনায় কেন সাধো বাদ” অপরটি আত্মজীবনীতে তিনি স্মরণ করতে পারেননি। যদিও এই রেকর্ডদুটি প্রকাশিত হয়নি।

১৯৪৪ সালে তাসের দেশ নৃত্যাভিনয়ে রাজপুত্রে গানগুলি গাওয়ার নিমন্ত্রণ পান দেবব্রত। এই সময় থেকেই প্রথাগত রবীন্দ্রসংগীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ শুরু হয়। তাসের দেশ নৃত্যাভিনয়ের একটি মনোজ্ঞ ছবি দেবব্রতের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়ঃ

“দু তিন রাত অভিনয় হয়ে যাবার পর পরিচালক মহাশয় (শান্তিদেব ঘোষ) নাটকের শেষ গানটি (“বাঁধ ভেঙে দাও”) আমায় গাইতে নির্দেশ দিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “গানটি With pleasure গাইব, না “without pleasure গাইব?” তিনি with pleasure গাইবার নির্দেশ দিলেন।… গানটি গাওয়া হত খুব পেলব ভঙ্গীতে। সেদিন আমি গণনাট্য সঙ্ঘের অনুষ্ঠানগুলিতে যেভাবে গানটি গাইতাম ঠিক সেই ভঙ্গীতে দ্রুতলয়ে গাইতে আরম্ভ করলাম। দেখতে পেলাম দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যশিল্পী কেলু নায়ার প্রাণের আনন্দে স্টেজের ধুলো উড়িয়ে নেচে নেচে বেড়াচ্ছেন কিন্তু অন্যরা ঠিক সুবিধা করতে পারছেন না।… বলা বাহুল্য ওই গান পরে আর আমায় গাইতে হয়নি।”

পরে কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে কয়েকটি গান রেকর্ড করলেন। তার মধ্যে ছিল তুমি রবে নীরবে গানটি। এই গানটি প্রথমে বিশ্বভারতী অনুমোদন করতে অস্বীকার করে। দেবব্রত বিশ্বাসের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়,

“তিনি (অনাদিকুমার দস্তিদার, বিশ্বভারতী স্বরলিপি সমিতির সম্পাদক) আমায় ডেকে বললেন, গীতবিতানে গানের কথা লেখা আছে – মম দুঃখ বেদন মম সফল স্বপন, এই সফল কথাটিকে তুমি সকল গাইলে কেন? আমি তখন অনাদিদাকে বললাম ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকায় যে স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল তাতে ‘সকল’ আছে। অনাদিদা বললেন, “ওটাতে ভুল হয়েছিল” ; আমি বললাম, “ভুল যদি হয়েই থাকত তাহলে এক বৎসরের মধ্যে নিশ্চয়ই শুদ্ধিপত্র বার করা হত – কিন্তু তাতো করা হয়নি।” তবু অনাদিদা গানটি অনুমোদন করতে রাজী হলেন না। নীহারবিন্দু সেন ইতিমধ্যে ইন্দিরা দেবী চৌধরানীকেই এই ব্যাপারে মতামত চেয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার স্মৃতি ও যুক্তি ইহাই সাক্ষ্য দেয়” অর্থাৎ সকল কথাটিই ঠিক। আমি তখন নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে সব ব্যাপার বুঝিয়ে বললাম। তাঁদের নির্দেশে পরে অবশ্য অনাদিদা গানটি অনুমোদন করেছিলেন।”

দেবব্রত বিশ্বাস হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে অনেকগুলি গান রেকর্ড করেন। হিজ মাস্টার্স ভয়েস প্রথম দিকে তাঁর কিছু গান রেকর্ড করলেও পরে আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। হিজ মাস্টার্স ভয়েস-এ প্রথম দিকের তাঁর কয়েকটি গান হল – আকাশ জুড়ে শুনিনু, এখন আমার সময় হল, ওই আসনতলের মাটির পরে, ওগো পথের সাথী, তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম এবং এই তো ভালো লেগেছিল। হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্-এ প্রকাশিত গানগুলিতে তাঁর প্রতিভার বিকাশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – আকাশভরা সূর্য্যতারা, যেতে যেতে একলা পথে, গায়ে আমার পুলক লাগে, পুরানো সেই দিনের কথা, এ মণিহার আমায়, আমি যখন তাঁর দুয়ারে, তোমার দ্বারে কেন আসি, পুরানো জানিয়া চেয়োনা, অনেক দিনের আমার যে গান ইত্যাদি..ইত্যাদি। হিন্দুস্তানে তাঁর কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত ইংরাজী অনুবাদ সহ (সম্ভবতঃ শিবদাস ভট্টাচার্য্য-কৃত) প্রকাশিত হয়েছে – বড়ো আশা করে ও With a high hope, ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু ও This weariness forgive me এবং তোমার হল শুরু আমার হল সারা ও Thine is this a beginning – এবং বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এছাড়া দুর্লভ কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত-ও তিনি গেয়েছেন, যেগুলির স্বরলিপি এখনও প্রকাশিত হয় নি – এ যে মোর আবরণ ঘুচাতে কতক্ষণ, তোমার রঙীন পাতায় লিখব প্রাণের কোন বারতা, আমার হারিয়ে যাওয়া দিন, মেঘেরা চলে চলে যায়, যার মধ্যে প্রথম দুটি গান ১৯৭০-এর দশকে আকাশবাণী কলকাতায় কয়েকবার সম্প্রচারিত হয়েছিল, কিন্তু হয়তো সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পরের দুটি গান একটি সিডি-তে প্রকাশিত হয়েছে।

এই সময় গণনাট্য সংঘ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (অবিভক্ত) সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘনিষ্ট হয়। তবে দেশভাগের সময় পার্টি কংগ্রেসকে সমর্থন করলে তিনি পার্টির প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন।

“ …যে পূর্ববঙ্গের মাটিতে আমার জন্ম হয়েছিল, যে পূর্ববঙ্গে আমি শিশুকাল থেকে বড় হয়েছি, যে পূর্ববঙ্গে আমার নিজের ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন রয়েছে সেই পূর্ববঙ্গ এখন আর আমার স্বদেশ নয় – তা হয়ে গেল বিদেশ – এতে আমার মন একেবারে ভেঙে পড়েছে। এই কারণে আমাদের এই স্বাধীনতা যে আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছিল, সেটাই ওদের (গণনাট্য সঙ্ঘের নেতৃবৃন্দ) জানিয়েছিলাম। তাছাড়া যেসব কারণে কমিউনিস্ট পার্টির “Support Neheru Govt.” থিসিস আমার কাছে নিতান্তই অযৌক্তিক মনে হয়েছিল তাও ওদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলাম।

১৯৪০-এর দশকের শেষভাগে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তিনি গোপনে পার্টির জন্য অর্থসংগ্রহও করেন। ১৯৫৩ সালে ভারতীয় শান্তি কমিটির উদ্যোগে চিন পরিভ্রমণ করেন ও সেই অভিজ্ঞতা অন্তরঙ্গ চীন নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পুনরায় চিন যান এবং সেই বছরই ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মিয়ানমার) বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের আহ্বানে সংগীতানুষ্ঠান করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি সংগীতানুষ্ঠান করেছিলেন।

১৯৬৪ সাল থেকে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের গায়ন বিষয়ে তাঁর মতভেদ শুরু হয়। মতভেদ তীব্র হলে তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়াই বন্ধ করে দেন। ১৯৭১ সালের পর থেকে আর তিনি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেননি। তাঁর শেষ রেকর্ড এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁরই রচিত ও সুরারোপিত একটি গান – “এরা কারা আমারে গাইতে দিল না/আমি গাইতে পারলাম না।” এই কারণে শিক্ষিত মহলে বিশ্বভারতীও কম সমালোচিত হয়নি। ২০০১ সালে ভারতে রবীন্দ্ররচনার কপিরাইট বিলুপ্ত হলে তাঁর বহু অপ্রকাশিত ও অননুমোদিত গান প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতাতেই নিজ বাসভবনে দেবব্রত বিশ্বাসের মৃত্যু হয়। তাঁর আত্মজীবনী ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত থেকে তাঁর জীবন ও বিশ্বভারতীর সঙ্গে তাঁর মতভেদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

গান ও চলচ্চিত্রায়ন

দেবব্রত বিশ্বাস প্রায় ৩০০ রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেন। তাঁর অন্যান্য রেকর্ডের মধ্যে আছে ‘ত্বমাদিদেব’ ও ‘ত্বমীশ্বরাণাং’ বেদগান, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ‘তুমি দেবাদিদেব’ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত “অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে” ও “প্রণমামি অনাদি অনন্ত” ব্রহ্মসংগীত, কবি বিষ্ণু দে রচিত কবিতার সুরারোপ “কোথায় যাবে তুমি” এবং বেশ কয়েকটি আধুনিক গান। তবে রবীন্দ্রসংগীতই তাঁর প্রধান সংগীতক্ষেত্র ছিল।

তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রায়ণ করেন ঋত্বিক ঘটক। মেঘে ঢাকা তারা ছবিতে গীতা ঘটকের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে যে রাতে মোর দুয়ারগুলি; কোমলগান্ধার ছবিতে আকাশভরা সূর্যতারা এবং যুক্তি তর্ক ও গল্প ছবিতে স্বয়ং ঋত্বিক ঘটকের ওষ্ঠদানে কেন চেয়ে আছ গো মা গানগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল। এছাড়া ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার ছবির একটি ক্ষুদ্র চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেন।

মৃত্যুর প্রায় তিনদশক পরেও তিনি রবীন্দ্রসংগীত জগতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পীরূপে পরিচিত।

দেবব্রত বিশ্বাসের কিছুগানঃ

দেবব্রত বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুনঃ http://www.debabratabiswas.in