প্রবাস থেকে বাংলাদেশ দেখা আর দেশ থেকে বাংলাদেশ দেখার মধ্যে যে কতটা পার্থক্য তা এতোদিন মনে করতাম, বোধহয় আমি ছাড়া আর কেউ ঐ ভাবে অনুভব করেনা। আর করলেও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারেণ তা দলীয়ভাবেই করে। বিদেশে এসে যে শুধু এতোদিনের রীতি সিদ্ধ পশ্চিম দিকে সম্মুখ হয়ে নামাজ পড়ার বদলে পূর্ব দিকে ফিরে নামাজ পড়ার অভ্যাসই আত্মস্থ করতে হয়েছে তা কিন্তু নয়। পরিবর্তন এসেছে দৃষ্টিভঙ্গিতে, পরিবর্তন এসেছে জীবন বোধে, পরিবর্তন এসেছে চিন্তা-চেতনায়। যারা বিদেশে থাকে বিশেষ করে যাদের মধ্যে ন্যুনতম সচেতনতা বোধ টুকু আছে তারা পরিবার পরিজনের জন্য যতটুকু চিন্তা করে তার চেয়ে কোন অংশেই কম চিন্তা করেনা দেশ মাতৃকার জন্য।

দেশ কিভাবে চলছে, দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে, শেয়ার বাজার নিয়ে কি আবারো তুলকালাম শুরু হয়ে গেল কিনা, বিরোধী দল কি আবার হরতাল ডেকে বসলো কিনা কিংবা বর্তমান ডিজিটাল মন্ত্রিসভার সম্মানিত তিন আবুল-ফারুক-শাহজাহান মন্ত্রী মহোদয়গন কে কি বললেন… প্রবাসীদের নিত্যদিনের আলোচনায় ঘুরে ফিরে এই বিষয়গুলোই চলে আসে। যাহোক, প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আসি। এই সাইটে অর্থাৎ আমাদের কিশোরগঞ্জ এ গত ২৩ আগষ্ট আমরা কী কিছুই বলবো না ! এই শিরোনামের সিডনী প্রবাসী ফজলুল বারী সাহেবের একটি লেখা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। দেশের বাইরে এরকম বারী সাহেবের মতো অনেক কলম সৈনিক আছেন যাদের কলম নামক অস্ত্রটা দামামার শব্দ শুনতে পাচ্ছে এবং তাই তাদের কলমে ধার উঠতে শুরু করেছে।

আশরাফ সাহেব যেটা বলেছেন সব সাংবাদিক, সাংবাদিক না আবার সব সংবাদপত্রও সংবাদপত্র না। তবে কি মিঃ কিশোরগঞ্জের রত্ন্ এটাও সত্যি নয় যে সব মন্ত্রীও মন্ত্রী না ? সব শাসকও শাসক না ? মন্ত্রীত্বের মানে যদি হয় পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ে বেড়ানো, যে দেশের একটা বিশাল জনগোষ্টী দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে সে দেশের মন্ত্রী যখন জ্ঞান দেয় কম খাওয়ার জন্য তখন ব্যাপারটাকে নিতান্তই উপহাস করা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। ক্ষমতা থাকলে যদি একটু ক্ষমতার দাপটই না দেখানো গেল তাহলে এই ক্ষমতা থেকেই লাভ কি, তাই না ?ক্ষমতা হাতে থাকলেই তো মানুষকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করা যায়, মানুষের দারিদ্রতাকে নিয়ে উপহাস করা যায়, মানুষকে নিজের কর্ম দিয়ে, কথা দিয়ে বুঝানো যায় দেখ আমার ক্ষমতা।ক্ষমতার এই অপসংস্কৃতি থেকে কি আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গন পিছিয়ে থাকা উচিত ?

বঙ্গবন্ধু তার একটি ভাষনে বলেছিলেন- ”আমরা এমন গনতন্ত্র চাই যে গনতন্ত্র হবে শোষিতের গনতন্ত্র, আমরা শোষকের গনতন্ত্র চাইনা।” আজকে বঙ্গবন্ধু বেচে থাকলে হয়তো নিজেই অবাক হয়ে বলতেন- এ কোন গনতন্ত্র আমার দেশে চলছে, এটা কি শোষিতের নাকি শোষকের গনতন্ত্র ?

আশরাফ সাহেবদের মতো রাজনীতিতে তুলনামূলক , মেধাবী ও প্রতিভাবান নেতৃত্ব যখন দেশের তথা দলের গুরম্নত্বপূর্ণ পদে আসীন হলেন খুব স্বাভাবিক কারনেই দেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে একটা আসার সঞ্চার হয়েছিল। সবার মতো আমিও ভেবেছিলাম রাজনীতিতে বোধহয় এবার একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে কিন্তু ঐ যে একটা কথা আছে না চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। যেই লাউ সেই কদু। সরকার গঠনের পর থেকেই দল চলতে থাকলো এক স্রোতে বিশেষ করে ছাত্রলীগ আর সরকার চলতে থাকলো অন্য স্রোতে তাও আবার সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লাগামহীন কথাবার্তা এবং সর্বোপুরি ‘৭২ এর সংবিধানে ফেরত যাবার কথা বলে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যাবস্থা বাতিল করে এখন সংবিধানের যে রুপ দেওয়া হয়েছে সেটা না হয়েছে ‘৭২ এর সংবিধান, না হয়েছে খোদ আওয়ামী লীগের নেতারা যেমনটা চেয়েছিলেন। তাহলে কার স্বার্থে এবং কার পরামর্শে এই সংশোধনী আনা হলো। না খুশি করা গেল বামপন্থিদের না ডানপন্থিদের।

দুই গ্রুপকে খুশি করতে গিয়ে মূলত কাউকেই খুশি করা গেলনা।কিছুদিন আগে আশরাফ সাহেব তার বেশ কয়েকটি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে বিষয়টি বারী সাহেব তার লেখায় গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। আমি এ ব্যাপারে শুধু একটি কথা বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু কিন্তু পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর হাতে মৃত্যবরণ করেনি, তিনি কিন্তু তার নিজের হাতে গড়া সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ অফিসারের হাতে নিজ গৃহে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ ঘটনা থেকে একটা বিষয় আমাদের জন্য শিক্ষনীয় আর তাহলো একটা পরাধীন দেশে স্বদর্পে চষে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ, হত্যা তো দুরে থাক কোন ধরনের প্রতিকুলতা ছাড়াই, এমনকি দেশে যুদ্ধকালীন সময়ে শত্রু পক্ষের কারাগারে নিরাপাদে দিনাতিপাত করেছেন বঙ্গবন্ধু কিন্তু তারই হাত ধরে আসা একটি স্বাধীন দেশে নিজ গৃহে দেশের কর্ণধার থাকা অবস্থায় নিজের হাতে লালিত-পালিত সেনা সদস্যের হাতে নৃসংশভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে দেশের স্বপ্নদ্রষ্টাকে। কাজেই আশরাফ সাহেব, বনের ভাগে ভয় না পেয়ে ঘরের কুকুর সামলান।

দেশের মানুষ আজ ভাল নেই। কথার ফুলঝড়ি অনেক ছড়িয়েছেন, আর কথা নয় এবার কিছু করে দেখানোর সুযোগ থাকলে তাই করুন। আপনারা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্নোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসলেন অথচ দেশ চালাচ্ছেন সব এনালগ মন্ত্রী দিয়ে। এই গুগলের যুগে যখন কেউ বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় কেউ ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করে তখন তাকে আসলে কি বলা যায় তা আমার জানা নাই। আপনারা যদি বিগত জোট সরকারের সাথে নিজেদেরকে তুলনা করেন তাহলে আমার কিছু বলার নাই। বিলেতে বাংলা পত্রিকার একজন অতি নগন্য মিডিয়া কর্মী হিসেবে আপনাদের অনেক এম পি, মন্ত্রীকে বিভিন্ন সুধি সমাবেশে বলতে শুনেছি গত জোট সরকারের আমলে দেশে বাংলা ভাইয়ের উত্থান হয়েছিল, দেশের ৬৩টি জেলায় একসাথে বোমা হামলা করা হয়েছিল, ২১ আগষ্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেট হামলা করা হয়েছিল, তৎকালীন সংসদ সদস্য শাহ এম এস কিবরিয়া, আহসান উলস্নাহ মাষ্টার এমপি কে দিনে-দুপুরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু বর্তমান সরকারের গত আড়াই বছরে এরকম কোন একটা ঘটনা কি দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুবই সহজ… না, এমন কিছু দেশে আজো দেখা যায়নি। কিন্তু এর মানে কি এই যে দেশে এখন খুব ভালো আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বিরাজ করছে ? দেশের সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, শেয়ার বাজার কেলেংঙ্কারী, শিৰ প্রতিষ্টান গুলোতে ছাত্রলীগের খবরদারি এই সব গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় গুলোকে সরকার দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করবে এমনটাই সবাই আসা করে।

পাশাপাশি আরেকটি বিষয় বলতে চাই, আওয়ামী লীগ সেই শুরম্ন থেকেই রাষ্ট্র ধর্মের ব্যপারে নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ  হিসেবে বলে আসছে অর্থাৎ যার যার ধর্ম সে তার মতো করে অন্যের অসুবিধা না করে পালন করবে তার মানেই হচ্ছে তারা ধর্মীয় দিক থেকে নিজেদেরকে পরমত সহিস্ঞু মনে করে কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে আমরা দেখছি আওয়ামী লীগেরর ঠিক বিপরীত অবস্থান। বিরোধী দলের মতের প্রতি তাদের ন্যুনতম শ্রদ্ধা টুকু তারা প্রদর্শন করতে রাজি নয় বরং উল্টো বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে কিভাবে কাবু করা যায় সেই চিন্তাই বেশী ব্যস্ত। অথচ বিরোধী দল হীন গনতন্ত্র যে স্বৈরতন্ত্রের ই প্রকারন্তর তা বোধহয় উনারা ভুলে যেতে চাচ্ছেন। আমাদের মতো প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে যদি একজন মানুষেরর উপকার হয়ে থাকে তবে সেই মানুষটির কথা চিন্তা করে সরকারের কাছে বলবো দয়া করে দেশে একটা স্থিতিশীল টেকসই রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলুন এবং অন্তত জাতীয় ইস্যু গুলোতে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলুন।

লেখক: গাজী মহিবুর রহমান
সাংবাদিক, ম্যানচেষ্টার- যুক্তরাজ্য।