পহেলা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব। বছরের প্রথম দিনের এই উৎসব শুধু বাঙালিই করে না, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চৌহদ্দির মধ্যে বসবাসকারী অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষও বিভিন্ন নামে এই উৎসব করে থাকে। উৎসবের সঙ্গে আনন্দ এবং আনন্দের সঙ্গে প্রাণশক্তির সম্পর্ক।  স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির সম্পর্ক। কাজেই যেকোনো উৎসব কারা কিভাবে পালন করবে,  কখন পালন করবে আর কখন করবে না, এটা নির্ভর করে মানুষের প্রাণশক্তি,  স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির ওপর। ধর্মীয়, জাতীয়, পারিবারিক, নানা ধরনের  প্রাতিষ্ঠানিক উৎসবের সব ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।

১৪১৭ সনের নববর্ষের উৎসব যখন পালিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের জনগণ বহুমুখী সংকটে জর্জরিত ও বিপর্যস্ত। এই সংকট তাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি হরণ করে তাঁদের প্রাণশক্তি দুর্বল করছে। স্বল্পসংখ্যক লোক ছাড়া জনগণের সমগ্র অংশেরই আজ এই অবস্থা। এ ক্ষেত্রে যারা ব্যতিক্রম, তাদের বেশির ভাগই দুর্বল। চুরি, দুর্নীতি, প্রতারণা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমেই তারা নিজেদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিযুক্ত আছে। কিন্তু ব্যাপক জনগণের জীবনে সংকট সৃষ্টি করে যারা নিজেদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, তাদের জন্য সমাজ কোনো শান্তি বরাদ্দ করে না।

সারা বছর দেশে এখন নানা ধরনের উৎসব পালিত হতে দেখা যায়। এসব মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও ঢাকার বাইরেও অন্যান্য শহরে এটা অল্পবিস্তর দেখা যায়। ১৯৭১ সালের পর নব্য ধনিক ও মধ্য শ্রেণীর আকার ও ধনসম্পদ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধার ছড়াছড়ি। এই সুযোগ-সুবিধার কাঠামোর মাধ্যমে এখন অনেক রকম উৎসব এদের দ্বারা পালিত হচ্ছে, যা এভাবে পালিত হতে আগে দেখা যেত না। এসব উৎসবে আনন্দের থেকে লঘু ফুর্তির উপাদানই থাকে বেশি।

পহেলা বৈশাখও বর্ষ শুরুর দিন হিসেবে যেভাবে এখন জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়, সেটাও আগে ছিল না। বাংলাদেশের জনগণের জীবনে ওপরে যে সংকটের কথা বলা হয়েছে, তা সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখের উৎসব জনজীবনে এক ইতিবাচক ব্যাপার। এ উৎসব যেভাবে এখন পালিত হয়, তার স্পষ্ট শ্রেণী চরিত্র সত্ত্বেও ধর্ম ও শ্রেণীর বন্ধনে এ উৎসব আবদ্ধ নয়।

আগের দিনে বাংলাদেশে বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখের থেকে বছরের শেষ দিন ৩০ চৈত্রই বিশেষভাবে পালিত হতো। সেটা হতো মূলত গ্রামাঞ্চলে। শহর ও গ্রামাঞ্চলে ব্যবসায়ীরাই অনেকটা ঘটা করে পালন করতেন চৈত্রসংক্রান্তি। এখন চৈত্রসংক্রান্তির পরিবর্তে পহেলা বৈশাখই প্রধান উৎসবের দিন এবং এই উৎসব মূলত নগরকেন্দ্রিক। ঢাকা শহরেই এই উৎসবের জৌলুস স্বাভাবিকভাবে বেশি। শুধু তা-ই নয়, এ উৎসবের দিন ঢাকার মানুষ যেভাবে স্রোতের মতো পথে নামে, এটাও এই উৎসবের একটা নতুন দিক।

এখানে এ কথা বলা দরকার, বর্ষ শুরুর দিন উদ্যাপনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ও গ্রামের মানুষ যেভাবে বৈশাখী উৎসবে অংশ নেয়, বাঙালিদের সে ধরনের কোনো অংশগ্রহণ দেখা যায় না। এদিক দিয়ে বলা চলে, পহেলা বৈশাখের উৎসব প্রধানত নগরকেন্দ্রিক। পহেলা বৈশাখের উৎসব ঘটা করে ঢাকায় পালন করা হলেও এটা মনে রাখা দরকার, দেশের মানুষ এখন যেভাবে নানা সংকটে বিপর্যস্ত; যেভাবে এখন জীবিকা, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে তাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি নেই। স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির অভাব তাদের প্রাণশক্তিকে দুর্বল ও নিঃশেষ করছে। উৎসবের মানসিকতার পরিবর্তে এক গভীর নিরানন্দ তাদের জীবন আচ্ছন্ন রেখেছে। কাজেই উৎসবের হৈহল্লা সত্ত্বেও এর মধ্যে প্রকৃত প্রাণশক্তির পরিবর্তে একধরনের যান্ত্রিকতার পরিচয়ই বেশি পাওয়া যায়। এদিক দিয়ে বলা চলে, পহেলা বৈশাখের এই উৎসব একধরনের নিরানন্দ বা নিষ্প্রাণ আনন্দ উৎসব।

বাংলাদেশের সমতলভূমিতে বর্ষ শুরুর উৎসবের এই অবস্থা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অবস্থা এদিক দিয়ে আরো খারাপ। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির সাজেকে এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে তাদের বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ ও খুনখারাবি ঘটনার পর সেখানে তাদের ওপর নানা নির্যাতন নতুনভাবে চলছে। এই পরিস্থিতিতে বৈশাখী উৎসব পালন থেকে তাদের অনেকেই বিরত থেকেছে এবং অন্যরা তা পালন করেছে নিরানন্দ এক উৎসব হিসেবে। উৎসবের সঙ্গে প্রাণের যে সম্পর্ক থাকে, তার অনুপস্থিতি তাদের বৈশাখী পালনের ক্ষেত্রে এবার বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

সারা দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে এ কথা বলা যায়, এ দেশের বর্তমান শাসকশ্রেণী জনগণের ওপর শোষণ-নির্যাতন এমনভাবে চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর ওপর এমনভাবে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে, যাতে আনন্দের সঙ্গে উৎসব পালনের শর্ত সমাজে এখন আর নেই। এদিক থেকে বলা চলে, শাসকশ্রেণী দেশের সাধারণ নাগরিকদের উৎসবের অধিকার পর্যন্ত হরণ করেছে। কাজেই বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ থেকে সব ধরনের বর্ষ শুরুর উৎসব এখন নিরানন্দ আনন্দ উৎসব ছাড়া আর কী?

বদরুদ্দীন উমর