সেই ভয়ঙ্কর খবরটা :
রাজবাড়ি পাংশা উপজেলার হাবাসপুর। গত ৫ এপ্রিল লালনভক্ত প্রবীণ বাউল মোহাম্মদ ফকিরের বাড়িতে সাধু সংঘের দুইদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া, পাবনা থেকে ২৮ জন লালন ভক্ত আসেন। সমাপনি দিনে তারা ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গান করছিলেন। এ সময় স্থানীয় প্রভাবশালীরা গিয়ে লালন ভক্তদের লাঞ্ছিত করে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। প্রভাবশালী ওইসব বীরপুত্ররা লালনভক্তদের মসজিদে নিয়ে গিয়ে গান না গাওয়ার বিষয়ে তওবা পড়ান। তওবা শেষে লালন ভক্তদের লম্বা চুল-দাড়ি ও গোফ কেটে দেন।

এই প্রভাবশালীরা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। বিএনপি’র লোকও নিশ্চয়ই আছে। বিরোধী দলে আছে বলে তাদের খবরটা পেপারে আসে নাই। আর জামাত—প্লানিংটা তাদের। বাম কাগুরা—ঘুমিয়ে আছেন। স্বপ্পন দেখছেন। আমার যেদিন ভেসে গেছে চক্ষেরও জলে…ইত্যাদি। বাকীটুক লেইখা লৈয়েন।

আগেও বাউল নির্যাতন কাণ্ড হত :
এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। অন্নদা শঙ্কর রায়কে ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া থেকে মহম্মদ গোলাম রহমান এক পত্রে জানাচ্ছেন, ১৯৪৩ সালে এক বিরাট সাধুসেবা চলাকালীন স্থানীয় আলেমগণ ফকিরদের উপর অমানুষিক মারপিট করে।
১৩৫৩ বঙ্গাব্দে মওলানা আফছার উদ্দীনের নেতৃত্বে একদল ব্যক্তি কুষ্টিয়ায় ছেঁউরিয়া আশ্রমে সমবেত লালনপন্থি সমস্ত বাউলের চুলের ঝুঁটি কেটে নেয়।

গবেষকের চোখে বাউল নির্যাতনের কিছু খবরাদি: আবুল আহসান চৌধুরী–
আবুল আহসান চৌধুরী বাঙলায় বাউলবিরোধী আন্দোলন : প্রেক্ষিত লালন শাহ’, নামে একটি বই লিখেছেন। তিনি লিখেছেন—বাউলধর্ম বাঙলার জনপ্রিয় লোকধর্ম। সর্বাপেক্ষা জনিপ্রয় বললেও বোধ করি অত্যুক্তি হয় না, অথচ এই জনপ্রিয় লোকধর্মকে লোকমানসপট থেকে মুছে ফেলার জন্য বিভিন্ন সময়ে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। এই কারণে বাউল সম্প্রদায়ের লোকদের বিভিন্নভাবে অনাদৃত ও নিগৃহীত হতে হয়েছে। তাঁর মতে লালনের জীবদ্দশাতেই লালনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ‘তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিকট থেকেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, ঘৃণা, নিন্দা ও শত্রুতা কুড়িয়েছেন। তাঁর প্রেম ও আধ্যাত্ম ধর্মশাস্ত্রবাদী ধর্মগুরু ও ধর্মগুরু ও সমাজপতিদের দ্বারা বারবার লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছে।

হিন্দুকর্তৃক বাউল নির্যাতন : সুধীর চক্রবর্তী
সম্ভবত ঊনিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম সংস্কার আন্দোলন,মিশনারীদের প্রচার,ব্রাহ্মধর্মের উত্থান এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-বিজয়কৃষ্ণদের জীবন সাধনা এমন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে এইসব উপসম্প্রদায়ী পিছোতে পিছোতে গ্রামের প্রত্যন্তে লুকিয়ে পড়ে। একদিকে উচ্চ ধর্মাদর্শ আরেকদিকে কট্টর মুসলমানদের সক্রিয় দমননীতি বাউল ফকিরদের ধ্বংস ক’রে দিল অনেকটা।

শ্রীরামকৃষ্ণ তো এ’সব লোকায়ত ধর্মসাধনাকে সরাসরি অভিযুক্ত ক’রে বললেন : বাড়িতে ঢোকার দু’টো পথ- সদরের খোলা দরজা আর পায়খানা দিয়ে ঢোকা। সদর দিয়ে ঢোকাই ভালো, পায়খানা দিয়ে ঢুকলে গায়ে নোংরা লাগা স্বাভাবিক। তাঁর মতে কামিনীকাঞ্চনের সাধনা বিপজ্জনক।

শ্রীসদগুরুসঙ্গ’ দ্বিতীয় খণ্ডে ১২৯৭ সালের ডাইরিতে বিজয়কৃষ্ণ বলেছেন–
‘বাউল সম্প্রদায়ের অনেকস্থলে বড়ই জঘন্য ব্যাপার। তা আর মুখে আনা যায় না। ভাল ভাল লোকও বাউলদের মধ্যে আছেন। তাঁরা সব চন্দ্রসিদ্ধি করেন। শুক্র চান,শনি চান,গরল চান, উন্মাদ চান, এই চার চান সিদ্ধি হলেই মনে করেন সমস্ত হ’লো। … আমি বললাম, “ওটি আমি পারবো না। বিষ্ঠামূত্র খেয়ে যে ধর্ম লাভ হয়, তা আমি চাই না।” মহান্ত খুব রেগে উঠে বললেন, “এতকাল তুমি আমাদের সম্প্রদায়ে থেকে আমাদের সব জেনে নিলে, আর এখন বলছ সাধন করব না। তোমাকে ওসব করতে হবে।” আমি বললাম, “তা কখনই করব না।” মহান্ত গালি দিতে দিতে আমাকে মারতে এলেন :শিষ্যরাও “মার্,মার্” শব্দ করে এসে পড়ল। আমি তখন খুব ধমক দিয়ে বললাম, “বটে এতদূর আস্পর্ধা,মারবে? জানো আমি কে?” আমি শান্তিপুরের অদ্বৈত বংশের গোস্বামী,আমাকে বলছ বিষ্ঠামূত্র খেতে?” আমার ধমক খেয়ে সকলে চমকে গেল।’
‘পাষন্ড দলন’ জাতীয় বৈষ্ণবীয় বুকলেট বেরোয় অজস্র,যাতে কর্তাভজা ও অন্যান্য উপসম্প্রদায়দের আক্রমণ করা হয় ‘অনাচারী’,‘ভ্রষ্ট’,‘নিষিদ্ধাচারী’ আখ্যা দিয়ে, তাদের নারীভজন ও সহজিয়া সাধনতত্ত্বকে অপব্যাখ্যা ক’রে। উনিশ শতকে দাশরথি রায় তাঁর পাঁচালিতে গালমন্দ করলেন এসব সম্প্রদায়কে, কলকাতার জেলেপাড়ার সং বেরলো কর্তাভজাদের ব্যঙ্গ ক’রে।

উচ্চস্তরের হিন্দু সাধকদের এই সব প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ নানাধরনের উপধর্মের লোকদের যতটা কমজোরী ক’রে দিয়েছিল তার চতুর্গুন লড়াই হয়েছিল ফকির দরবেশদের সঙ্গে নিষ্ঠাবান মুসলমানদের। বাংলার সামাজিক ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন তাঁরা এসব ঘটনা, কেন জানি না এড়িয়ে গেছেন।
হিসেব নিলে দেখা যাবে শেষ আঠারো শতকে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের বিপুল পরিমাণ শূদ্র ও গরীব মুসলমান বাউল বা ফকিরী ধর্মে দীক্ষা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ত্যাগ করতে থাকে। দেখা যায়, বাউল ফকিরদের মধ্যে মুসলমান ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ছিল খুব বেশি। লালন শাহ থেকে আরম্ভ ক’রে বহুসংখ্যক উদাসীন ধর্মগুরু তাঁদের সৎ জীবনযাপন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শপ্রচার এবং সমন্বয়বাদী চিন্তাধারায় বহু সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ ক’রে নেন তাঁদের উপধর্মে। এতে বৃহত্তর হিন্দু মুসলমান ধর্ম, বিশেষ করে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব সমাজ এবং কট্টর ইসলামী সমাজ খুব বড় রকমের অর্থনীতিক ও সামাজিক ধাক্কা খায়। স্বভাবত প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জাগে।

মুসলিম মৌলবাদিদের ছেনি-কেচি:
শাস্ত্র বিরোধী বাউলদের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম শুরু হল উনিশ শতকের নদীয়া,যশোহর ও উত্তরবঙ্গের শরীয়তী মুসলমানদের সঙ্গে। বাউলদের অন্যান্য আচরণের, যেমন চারিচন্দ্রের সাধনা, ঘৃণ্যতার বিবরণ দিয়ে শরীয়তবদীরা বেশি জোর দিলেন বাউলদের গান গাওয়ার বিরুদ্ধে। ইসলাম ধর্মের একদল ব্যাখ্যাকারী জানালেন ইসলামে গান গাওয়া জায়েজ নয়। বাউলদের গানের আসরে তাঁরা দাঙ্গা বাধালেন। আলেম সম্প্রদায়ের নির্দেশে বাউলদের ওপর নানারকম দৈহিক নিপীড়ান শুরু হল এবং প্রায়শ তাদের ঝুঁটি কেটে নেওয়া হতে লাগল।* ভয়ে বাউলরা আত্মগোপন করল বা বহির্বাস ত্যাগ করল।

এই সময়কার ওহাবী, ফারায়জী ও আহলে হাদীস আন্দোলন মুসলমান বাউলদের খুব ক্ষতি করল। তাদের জোর ক’রে শরীয়তমতে ফেরানো হতে লাগল। বহু মুসলমান সংস্কারক এই সময় বাউলদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী ক’রে লড়াইয়ে নামলেন। সে সময়কার কিছু লেখকের রচনায় বাউলফকির-বিরোধী ভাষা চোখে পড়ে। যেমন মীর মশারর্ ফ হোসেন লিখেছেন :
ঠ্যাঁটা গুরু ঝুটা পীর
বালা হাতে নেড়ার ফকীর
এরা আসল শয়তান কাফের বেইমান।
লোককবি জোনাব আলী হুংকার দিয়ে লেখেন :
লাঠি মার মাথে দাগাবাজ ফকিরের।

রংপুরর মৌলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদের লেখা ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’ বইটি কট্টর মুসলিম সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়। ১৩৩২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি লিখেছেন : ‘এই বাউল বা ন্যাড়া মত মোছলমান হইতে দূরীভূত করার জন্য বঙ্গের প্রত্যেক জেলায়,প্রত্যেক গ্রাম,মহল্যা জুমা ও জমাতে এক একটি কমিটি স্থির করিয়া যতদিন পর্যন্ত বঙ্গের কোন স্থানেও একটি বাউল বা ন্যাড়া মোছলমান নামে পরিচয় দিয়া মোছলমানের দরবেশ ফকীর বলিয়া দাবী করিতে থাকিবে ততদিন ঐ কমিটি অতি তেজ ও তীব্রভাবে পরিচালনা করিতে হইবে। মোটকথা মোছলমানগণের কর্ত্তব্য এই যে মোছলমান সমাজকে বাউল ন্যাড়া মত হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত না করা পর্যন্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে হইবে।’

১৩৩৩ সালে ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’ বইটির দ্বিতীয় খণ্ড বের হয়। তিনি সেখানে মত দেন , লালন সাহার ধর্মের কোনো ঠিক ছিল না। বরঞ্চ তাহার ভাবের গান ও কবিতাবলীর ভিতর দিয়া পরিস্ফুটিত হয় যে, তিনি হিন্দু জাতির একজন উদাসীন ছিলেন। তিনি কেবল মুসলমানের হস্তে অন্নব্যঞ্জনাদই ভোজন করিয়াছিলেন বলিয়াই হিন্দুসমাজ তাঁহাকে সমাজচ্যূত করিয়াছিলেন। তিনি মোছলমানের অন্নভোজন ব্যতীত এছলাম গ্রহণ করেন নাই বা মোছলমান বলিয়া নিজেকে স্বীকার করেন নাই বা এছলামের আকিদা, বিশ্বাস ও নামাজরোজা প্রভৃতির কোনো চিহ্ণই কিম্বা আচার-ব্যবহার কিছুই তাঁহার মধ্যে বর্তমান ছিল না, যদ্বারা তাহাকে মোছলমান বলা যাইতে পারে। তিনি মোছলমানের হোলিয়া অনুসারে মোছলমানের দরবেশ ফকির হওয়া দূরে থাক, একজন মোছলমান বলিয়াও পরিগণিত হইতে পারেন না। তিনি যত বড় মুনি ঋষি উদাসীন হউন না কেন, মোছলমানের তিনি কেহই নহেন।

১৯৬২ সালে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে সরকারী উদ্যোগে লালনের আস্তানায় একটি স্মৃতিসৌধ ও একটি লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ইতিমধ্যে কুষ্টিয়াকে জেলায় পরিণত করা হয়। জেলার নতুন নামকরণের প্রস্তাব ওঠে। তখন মওলানা মেছবাহুর রহমান একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়—শোনা যাচ্ছে কুষ্টিয়া জেলার নাম পরিবর্তন করে ‘লালন শাহী’ এবং কুষ্টিয়া শহরের নাম পরিবর্তন করে ‘লালন নগর’ করার ষড়যন্ত্রে কেউ কেউ মেতে উঠেছেন এবং তা জেলা কাউন্সিলের সভায় পাশ করার চেষ্টা করছেন। সকলেই জানে লালন একজন বেদ্বীন, বেশরা, জাতধর্মহীন নাড়ার ফকির যাদেরকে কুষ্টিয়াবাসী ঘৃণাই করে থাকে। লালনের ধর্মমতের ‘চারিচন্দ্রভেদ’, ষড়চক্র, দ্বিদলপদ্ম, মূলাধারচক্র, সহস্রদলপদ্ম, অধর মানুষ, ‘সহজ মানুষ’, ‘ত্রিবেনী, ‘ আল’, বিন্দু, সাধনসঙ্গিনী, প্রেমভজা প্রভৃতি কাম আরাধনার সঙ্গিতপূর্ণ শব্দসমূহের তাৎপর্য কী তা জানলে বা তাঁর অবতারবাদের সংবাদ জানলে যে কোন রুচিসম্পন্ন মানুষ লালন এবং তাঁর অনুসারীদের নাম মুখে আনতেও ঘৃণা বোধ করবে।

এমন বিবরণ প্রচুর মেলে। বাউল ফকিরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও অপপ্রচার উনিশ শতকের সীমান্ত পেরিয়ে বিশ শতকে ব্যাপ্ত হয়েছে। ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’বই থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলায় ষাট-সত্তর লক্ষ বাউল ছিল। উৎপীড়ন ও অত্যাচারে তারা সম্প্রদায়গতভাবে শীর্ণ ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। লিখিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে মওলানা আফছার উদ্দীনের নেতৃত্বে একদল ব্যক্তি কুষ্টিয়ায় ছেঁউরিয়া আশ্রমে সমবেত লালনপন্থি সমস্ত বাউলের চুলের ঝুঁটি কেটে নেয়।

বাংলাদেশে লালন বিপদে আছেন:
বাংলাদেশে লালন বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন করেছেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী। আর সবচেয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণ আলাপ করেছেন ফরহাদ মজহার। তিনি দুই তিনটা কিতাব লিখেছেন। একটা তার অতি বিখ্যাত ভাবান্দোলন ওরফে গরলপাঠনামা। দ্বিতীয়টি মোকাবেলা ওরফে তালিবাননামা। আরেকটি সাঁইজী দৈন্যগান।
ফরহাদ মজহার এই কিতাবসমূহে পশ্চিমদেশীয় নানা লোকের গ্রন্থ থেকে নানা প্যাঁচাল পেড়ে অবশেষে বলেছেন–লালন ছিলেন লাদেনপন্থী উগ্র ইসলামী বিপ্লবী। রবীন্দ্রনাথের চেয়েও তিনি বড় কবি। কারণ রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ও জমিদার। লালন যা লিখেছেন সবই এবাদতনামার অন্তর্গত। অর্থাৎ তিনি সেক্যুলার ছিলেন না। কারণ সেক্যুলাররা আওয়ামীপন্থী। ইত্যাদি।

গত ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে বিমানবন্দর চত্বরে লালন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে মৌলবাদিচক্র। খবর দেখুন—‘খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের আমির ও মূর্তি প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান মুফতি নূর হোসাইনের নেতৃত্বে মঙ্গলবার গোলচত্বর এলাকায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২২ অক্টোবরের মধ্যে ভাস্কর্য সরিয়ে না ফেললে সরকারকে কারবালার পরিস্খিতির মুখোমুখি হতে হবে বলে হুশিয়ার করে দেয়া হয়। ভাস্কর্যগুলোকে অশ্লীল মূর্তি বলে আখ্যা দেয় সংগঠনটি। আর এ আল্টিমেটামের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং বিমানবন্দর থানা কর্মকর্তাদের উপস্খিতিতে ভেঙে ফেলা হয় ভাস্কর্যগুলো’।

মজার কাণ্ড হল এই ভাঙ্গাভাঙ্গির মধ্যে হিজবুত তাহরীর নামের অধুনা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনও অংশ নিয়েছিল। ফরহাদ মজহার সেই হিজবুত তাহরীর তাত্ত্বিক। তখন মজহার লালন ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে টু শব্দটি করেন নাই। শোনা যায়—মখন তিনি উষ্মাভরে বলেছেন, লালন খুবই কুতার্কিক। আর তার সাঙাৎ ব্রাত্য রাইসুকে দিয়ে লিখিয়েছেন—ওরা লালন ভাস্কর্য ভেঙে ইঠক কাজটিই করেছে। দরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের তাবৎ ভাস্কর্যসমুহ ভেঙ্গে ফেলা। সেই কথাটিই ফজলুল হক আমিনী জনসভায় হুমকী দিয়েছিলেন– ক্ষমতায় গেলে দেশের সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হবে।

সেই ভাস্কর্য আর স্থাপিত হয় নাই।হবেও না কোনো কালে। কারণ সুরঞ্জিত বাবুর সেই ব্যাঁকা মুখের শব্দ–বাস্তবতা। হায়, বাস্তবতা–তোমার বাপও নাই, মা-ও নাই।

আওয়ামী লীগ কী করে:
বিএনপি যা করেছে আওয়ামী তাই-ই করে। বিএনপি লুটপাট করে আর খালেদার হাজবেন্ড জিয়াউর রহমান নামে শিঙ্গা ফোঁকায়। আওয়ামী লীগ লুটপাট করে আর শেখ হাসিনার বাপের নামে সাইনবোর্ড বানায়। দুদলের ফাঁকে মৌলবাদ ঘাড়ে গর্দানে মোটা হয়। তাতে খালেদা বা হাসিনার কিছুই যায় আসে না। তাদের দুজনের দরকার ক্ষমতা। আর কিছু নয়। তাতে মৌলবাদিরা যদি বলে, আসো—লালনকে ধইরা মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে দেই। অথবা ক্রস ফায়ারে দেই। তখন তারা বলে—ওহে কাগু, চিন্তা নাই। আমরাই তোমাগো কামডা কইরা দিতাছি।

তাই হচ্ছে দেশে। জামাত পাকিস্তান আমল থেকে এইসব ক্রসফায়ারগিরী করছে। বিএনপি জন্মের পর থেকে করছে। আওয়ামী একাত্তর সালের পর থেকে করছে। আর বামপন্থীরা কলাম লিখতেছে।

এছাড়া আর কি করবেন তারা? লালন? ফুঁ। লালন ফকির কি কামে লাগে? হ্যার চেয়ে ব্লাক ট্যাকার কুম্ভীর সালমান এফ রহমান মেলা কামের।
সুতরাং লালন—তোমার অবস্থা কেরাসিন।

লিখেছেন : কুলদা রায়

সূত্র:
মহাত্মা লালন ফকির : হিতকরী পত্রিকা–১৮৯০, ৩১ অক্টোবর।
লালন ফকির ও তাঁর গান : অন্নদাশঙ্কর রায়
গভীর নির্জন পথে : সুধীর চক্রবর্তী
বাঙলায় বাউলবিরোধী আন্দোলন : প্রেক্ষিত লালন শাহ : আবুল আহসান চৌধুরী