ময়মনসিংহের গৌরীপুর সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মোগল স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম কিল্লাতাজপুর। কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ঈশা খাঁর দৌহিত্র ফিরোজ খাঁ দেওয়ান আর কিল্লাতাজপুর এর নবাব উমর খার কন্যা বীরাঙ্গনা সখিনার স্মৃতিময় এই গ্রাম যা ইতিহাসে আজও অমর হয়ে আছে। কিন্তু সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

কিল্লাতাজপুরের অনেক স্মৃতিচিহ্ন আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সমগ্র গ্রামেই বিক্ষপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে অজস্র স্মৃতিচিহ্ন। এই গ্রামের কুমড়ীনামক স্থানে রয়েছে ইতিহাস বিখ্যাত বীরাঙ্গনা নারী সখিনার সমাধি। গ্রামের চতুর্দিকে রয়েছে ৪ মাইলব্যাপী মাটির উঁচু প্রাচীর চিহ্ন, কারো কারো মতে সেখানে ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। গ্রামের বেশ কিছু স্থানে রয়েছে প্রাচীর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। এই গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে সুরিয়া নদী। ২ মাইলব্যাপী বিস্তৃত এ নদীর স্থানে স্থানে এখনও পরিলক্ষিত হয় যুদ্ধের পরিখা খননের চিহ্ন। বিভিন্ন জায়গায় উঁচু উঁচু টিলা এখনো বিদ্যমান। এই গ্রামের জনৈক আব্দুল্লাহ মিয়ার বাড়িতে রয়েছে ৮ মণ ওজনের ১টি পাথর, এই পাথরের সাহায্যে কাগজের মন্ড তৈরি হত বলে জানা যায়।

 কদম আলীর বাড়িতে রয়েছে ১টি পুকুর, পাকা সিঁড়িযুক্ত এই পুকুরের সিঁড়িগুলো ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্যাঁচানো। কিল্লাতাজপুর গ্রামে সখিনার বাবা নবাব উমর খাঁর বাড়ির চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। দুর্গের ভিতর ২০ একর জমির ওপর প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল উমর খাঁর বাড়ি, কারুকাজ মন্ডিত ইটের গাঁথুনী দিয়ে তৈরি হয়েছিল সেই বাড়ি। বাড়ির পেছনে ছিল হাতি রাখার স্থান, যা গ্রামের মানুষের কাছে পিলখানা নামে পরিচিত। বর্তমানে উমর খাঁর মূল বাড়ির ধ্বংসাবশেষের ওপর ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে দেওয়ান আব্দুল হামিদ খাঁ ও তার পরিবার। তারা নিজেদের উমর খাঁর শেষ বংশধর হিসেবে দাবি করে। যদিও গ্রামের অনেকের এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। গ্রামের লোকের ধারণা, এই পরিবারের লোকজনের কাছে রয়েছে উমর খাঁর অনেক গুপ্তসম্পদ এবং ঐতিহাসিক অনেক দলিলপত্র।
অনেক দিন আগে এই বাড়িতে টিউবওয়েল বসানোর সময় টিউবওয়েলের পাইপ দিয়ে বের হয়ে এসেছিল একটি তলোয়ার। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অজ্ঞাত কারণে আজও প্রকাশ করা হয়নি।

সমগ্র কিল্লাতাজপুর গ্রামের মাটির নিচে ইট দ্বারা পরিপূর্ণ। মাটি খুঁড়লে এখনো ইটের দেয়াল পাওয়া যায়। ইটের গায়ে ফারসি ভাষা লিপিবদ্ধ। গ্রামবাসী বর্তমানে উঁচু টিলা কেটে সমতল করে ফসল ফলাচ্ছে। বনজঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি করছে ঘরবাড়ি। গ্রামের মানুষের কাছে এখনো ঐতিহাসিক কিছু নির্দশন বিদ্যমান, যা মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। উক্ত গ্রামের শাহগঞ্জ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে রয়েছে ৪ ফুট লম্বা ১টি শ্বেত পাথর, ১টি পিতলের বাটি, হাতির গলার ঘণ্টা, কারুকার্যখচিত কিছু ইটখন্ড। উমর খাঁর বাড়ির সামনে ও পিছনে রয়েছে ২টি মজা পুকুর। বাড়ির সামনের পুকুরটির নাম তালদীঘি ও পিছনের পুকুরটির নাম মলদীঘি। ইতিহাস মতে, ফিরোজ খাঁ দরবেশের ছদ্মবেশে সখিনাকে প্রথম দেখেছিল উক্ত মলদীঘির পুকরঘাটে। কথিত আছে, কিশোরগঞ্জ জঙ্গলবাড়ির ঈশা খাঁর নাতি ফিরোজ খাঁ তজবির (ছবি) দেখে পছন্দ করে সুবে বাংলা মুল্লুকের কিল্লাতাজপুরের নবাব উমর খাঁর কন্যা শাহজাদী সখিনাকে।

 সখিনার ছবি দেখে ফিরোজ খাঁ এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, ছদ্মবেশ নিয়ে জঙ্গলবাড়ি থেকে তিনি চলে আসেন কিল্লাতাজপুর। তখন সখিনার পিতা নবাব উমর খাঁ অসুস্থ। কিন্তু কি এক অজ্ঞাত কারণে দরবেশরূপী ফিরোজের অভয়নীতিতে ও তার ঐশী চেহারায় মুগ্ধ হয়ে উমর খাঁ সুস্থ হয়ে ওঠেন। ফলে অন্দর মহলে যাতায়াতের আর কোন বাধা রইলো না।

অত:পর মলদীঘি ঘাটে দরবেশরূপী ফিরোজের সাথে প্রথম দেখা হয় সখিনার। ফিরোজ সখিনার রূপ স্বচক্ষে দেখে এতটাই পছন্দ করে ফেলে যে সাথে সাথে জঙ্গলবাড়ি ফিরে তার বিশ্বস্ত দাসীকে নিজের ফটো দিয়ে পাঠিয়ে দেন কিল্লাতাজপুর সখিনার কাছে। ফিরোজের আসল ছবি দেখে সখিনারও পছন্দ হয় এবং সে মনেপ্রাণে ফিরোজ খাঁকে স্বামী বলে গ্রহণ করে নেয়। ফিরোজ খাঁ মূল্যবান উপহার সামগ্রীসহ বিয়ের প্রস্তাব পাঠান সখিনার পিতা উমর খাঁর কাছে। উল্লেখ্য, ওমর খাঁ ছিলেন দিল্লীর মোগল সম্রাটের অনুগত আর ফিরোজ খাঁ বংশানুক্রমে মোগলদের শত্রু। তাছাড়া উমর খাঁ ঘৃণাভরে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, ফিরোজের নানা ঈশা খাঁ বিধর্মীকে (সোনা বিবি) বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ফিরোজও সিদ্ধান্তে অনড়। হাজার হাজার সৈন্য, হাতি, ঘোড়া নিয়ে আক্রমণ করলেন কিল্লাতাজপুর।

ফিরোজের আক্রমণে ধ্বংস হল কিল্লাতাজপুর। ফিরোজ যুদ্ধে জয়ী হয়ে সখিনাকে বিয়ে করে নিয়ে গেলেন জঙ্গলবাড়ি। উমর খাঁ পালিয়ে আশ্রয় নিলেন দিল্লীর শাহানশাহ জাহাঙ্গীরের নিকট। চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে উমর খাঁ শাহানশাহকে বলেন, বিধর্মী ফিরোজ অতর্কিত তার রাজ্য আক্রমণ করে জোর করে তার কন্যা সখিনাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। খাজনা পরিশোধ না করায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের পূর্ব থেকেই প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল ফিরোজ খাঁর ওপর। আর তাই প্রচুরসংখ্যক সৈন্য, হাতি, ঘোড়া সাথে দিয়ে উমর খাঁকে পাঠিয়ে দিলেন জঙ্গলবাড়ি দখল করতে।
খবর পেয়ে বীর যোদ্ধা ফিরোজ দীর্ঘ পথ সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বাধা দিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের বাহিনীকে। দু’দিন দু’রাত একটানা যুদ্ধ করে ফিরোজ পরাজিত হয়ে বন্দি হন সংখ্যা ও শক্তিকে অধিক উমর খাঁর হাতে। এ খবর স্বামী যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসার প্রতীক্ষায় সখিনার কাছে পৌঁছে তখন তিনি বিচলিত না হয়ে পুরুষ বেশ ধারণ করেন এবং চারদিকে রটিয়ে দেন যে, ফিরোজ খাঁর মামাতো ভাই সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। অতঃপর সখিনার শাশুড়ি তথা ফিরোজের মাকে সালাম করে আপন পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সখিনার বীরত্ব আর রণকৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে থাকে তার পিতা উমর খাঁর বাহিনী। যুদ্ধ একটানা ২ দিন পর্যন্ত গড়ায় এবং বীরাঙ্গনা সখিনা তার স্বামীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।