আজ রবিবার। ১৪১৭ বঙ্গাব্দের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিন, পহেলা ফাল্গুন। গণমানুষের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক/আজ বসন্ত।’ আবহমান বাংলার প্রকৃতিতে আজ ফাগুনের ছোঁয়া, আগুনরাঙা বসন্তের মোহময় সুর।

নগরজীবনেও বসন্ত ছন্দ তোলে মৃদু হিল্লোলে। ইট-পাথরের নাগরিক জীবনের যানজট, কোলাহল ছাপিয়েও যেটুকু প্রকৃতি খুঁজে পাওয়া যায়, তাকেই অতি আপন করে নেয় কর্মব্যস্ত মানুষ। নেচে ওঠে তাদের মন। যেন ‘হারিয়ে যেতে আজ নেইকো মানা।’

ষড়ঋতুর দেশে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতিতেই মূলত বসন্ত জানান দেয় তার আগমনী বারতা। গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড়, বৃক্ষরাজি, মাঠভরা ফসলের ক্ষেতবসন্তের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। চোখ বুজলেও টের পাওয়া যায় তার দৃশ্যপট।গ্রীষ্মের খরতাপের আগে ফাগুনে প্রকৃতি পায় শেষ পরিতৃপ্তি। নিসর্গের বর্ণচ্ছটায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে বাঙ্ময়। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালির মনে দোলা লাগে, হৃদয় উচাটন হয়।

কবির ভাষায়, আজ ‘ফাগুন এসেছে বনে বনে’। অশোকে-অশ্বত্থে-শিরীষে-শালে-পিয়ালে দখিনা হাওয়ার নাচন, নরম রোদের কাঁপনে যখন-তখন মাতামাতির দিন আজ। ফুল ফুটবার পুলকিত সময়। আজ মাতাল হাওয়ায়, উতরোল মৌমাছিদের গুঞ্জরণে, গাছের কচিপাতায়, কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার দিন।

শীতের রিক্ততা মুছে প্রকৃতিজুড়ে সাজসাজ রব এখন। বিবর্ণ প্রকৃতিতে জেগে উঠেছে নয়া জীবনের ঢেউ। নীল আকাশে সোনাঝরা আলোর মতোই আন্দোলিত হৃদয়। আপ্লুত। আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…। কবিগুরুর ভাষায়, ‘আহা, আজি এ বসন্তে/কত ফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে/কত পাখি গায়…।’ বৃক্ষলতা-পশুপাখি, মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাবে মায়াবী এক আবেশ। মনের সুখে বাজবে_’একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি/তাই নিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী।’ঋতুচক্র যেন এখন আর পঞ্জিকার অনুশাসন মানতে চায় না। কুয়াশার চাদরে মো

ড়া শীত জেঁকে বসতে না বসতেই বিদায়। প্রকৃতির দিকে তাকালে শীত-বর্ষার মতো বসন্তকে চেনা যায় না সহজে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুচক্রেও এসেছে নতুন ব্যঞ্জনা। সময়মতো শীত আসে না, বর্ষাও তাই। গ্রীষ্মের খরতাপও মানে না নিয়ম।আমাদের পুঁথি-পুস্তকে আছে ঢের বসন্তস্তুতি। বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি তো অনাদিকাল থেকেই। কবিতায়, গানে, নৃত্যে, চিত্রকলায় বসন্তের বন্দনা। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে নানা অনুপ্রাস, উপমা, উৎপ্রেক্ষায়।গরমানুষ যতই নিষ্প্রাণ, হিসেবি, প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন হোক না কেন, বসন্তের এই দিনে তারা গেয়ে ওঠে ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে/ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে…।’ ফাগুনের প্রথম দিনে সবাই মিলিত হবে মনকে বসন্তের রঙে রাঙিয়ে। প্রীতির বন্ধনে আপন মহিমায় খুঁজে নেবে বসন্তকে। সেই মিলনের তাগিদে আজ সারা দিন দেশের নানা প্রান্তে বসন্ত বরণে মেতে উঠবে জাতি।

বসন্তের প্রথম দিনে আজ নানা আয়োজনে আলোড়িত হবে রাজধানী ঢাকা। তরুণ-তরুণীরা বইমেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চারুকলার বকুলতলা মাতিয়ে রাখবে সারা দিন। নগরীর বিভিন্ন উদ্যান, ফাস্টফুড, ক্যাফে মুখর থাকবে। মোবাইল ফোনে এসএমএস আদান-প্রদান, ফেইসবুক, টুইটার, হাইফাইভ, অরকুট প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে বরণ করা হবে ঋতুরাজ বসন্তকে।

আজ রাজধানীতে বসন্ত উৎসবের বড় আয়োজনটি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায়। অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল ৭টায়। বসন্ত শোভাযাত্রা সকাল ১০টায়। বিকেলে থাকবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। আয়োজক জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ।তরুণ-তরুণীরা আজ বাসন্তী রঙের পোশাকে নিজেকে রাঙিয়ে নেবে। বসন্ত প্রকৃতির ছোঁয়া নিতে প্রজাপতি মন নিয়ে ঘুরে বেড়াবে।উৎসব আয়োজনে রাঙিয়ে দেবে নিজেকে। আজ মিলেমিশে একাকার হওয়ার দিন। বিভেদ-বিদ্বেষ, মান-অভিমান নয়। বসন্তের আগমনে পৃথিবীজুড়ে বাজবে আশাজাগানিয়া সুর। শোক-তাপ ভুলে সবাই মেতে উঠবে বসন্ত আবাহনে।

ফুলেল বসন্ত, মধুময় বসন্ত, যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনা বসন্ত, আনন্দ-উচ্ছ্বাস-উদ্বেলতায় মন-প্রাণ কেড়ে নেওয়া বসন্ত_তোমায় অভিবাদন।

-নওশাদ জামিল