ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর প্রচারণার অভিযোগে সরকার দেশে সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেইসবুক সাময়িকভাবে বন্ধ (ব্লক) করার নির্দেশ দিয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরের পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) দেশের দুটি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়েকে ফেইসবুক পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। গতকাল রাতে বিটিআরসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

বিটিআরসির ওই কর্মকর্তা জানান, ফেইসবুকের অপব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও ম্যাঙ্গো টেলিকমের কর্মকর্তারাও এ নির্দেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বিটিসিএলের বিভাগীয় প্রকৌশলী (ইন্টারনেট) হাবিবুর রহমান প্রামাণিক গত রাতে কালের কণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘দুপুরের পর বিটিআরসি থেকে এ নির্দেশসংবলিত চিঠি আমাদের কাছে পাঠানো হয়। আমরা ফেইসবুক বন্ধ করে দিয়েছি এবং কয়েকবার পরীক্ষা করে বন্ধ করার বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি।’ তবে বিটিআরসির ওই নির্দেশের পরও রাতে কোনো কোনো বেসরকারি মোবাইল ফোন কম্পানির ফোন ব্যবহার করে ফেইসবুক ব্যবহার করা যাচ্ছিল। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে হাবিবুর রহমান প্রামাণিক বলেন, ‘মোবাইল ফোনে ফেইসবুক কেন খোলা পাওয়া যাচ্ছে, সে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া দরকার। এ বিষয়টি আমরা জানি না।’
বিটিআরসি সূত্র জানায়, কিছু দিন ধরেই ফেইসবুকের অপব্যবহারের বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। অভিযোগ আসে, ফেইসবুকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তির নাম ও ছবি ব্যবহার এবং তাঁদের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। এসব অভিযোগের ফলে ২৬ মে ম্যাঙ্গো টেলিকম ও বিটিসিএলকে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাদের পরিচালিত আইআইজি থেকে ফেইসবুকের বিশেষ কিছু লিংক বন্ধ করে দিতে। কিন্তু তারা তা করেনি। এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি সূত্রের মন্তব্য হচ্ছে, প্রতিষ্ঠান দুটি হয় কারিগরি দক্ষতার অভাবে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দেশটি পালন করেনি। এ অবস্থায় গতকাল বিকেলে ফেইসবুক পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এদিকে নাম প্র্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ফেইসবুক ব্যবহারকারী বলেন, তাঁরা এখনো ছদ্ম প্রক্সি ব্যবহার করে ফেইসবুকে ঢুকতে পারছেন। এ বিষয়ে তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, প্রক্সি জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচয় গোপন করে যেকোনো ব্লকড সাইটেই ঢোকা যায়। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কিছুই করার থাকে না। ফেইসবুকের ক্ষেত্রেও এমনটি হচ্ছে এবং হবে।
চলতি সপ্তাহেই পাকিস্তান সরকার সে দেশে ফেইসবুক ও ইউটিউব বন্ধ করে দেয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কার্টুন আঁকার মতো আপত্তিকর প্রতিযোগিতা আয়োজন করার পর এ ব্যবস্থা নেয় পাকিস্তান। ইউরোপের একটি দেশ থেকে এক ব্যক্তি ‘এভরিবডি ড্র মুহাম্মদ ডে’ নামের ওই প্রতিযোগিতা আহ্বান করে।
বন্ধ নয়, দরকার নিয়ন্ত্রণ : সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেইসবুক বন্ধ করে দেওয়ায় শিক্ষক ও প্রযুক্তিবিদসহ বিশিষ্টজনরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণভাবে বললে আমি বলব, তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহে হস্তক্ষেপ সব সময় ফলপ্রসূ হয় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘মহানবী (সা.)-কে নিয়ে আপত্তিকর প্রচারণার শক্ত ভাষায় প্রতিবাদ জানাই। একই সঙ্গে বিশিষ্টজনদের চরিত্র হননচেষ্টারও নিন্দা করছি। তবে আমি বলব, ফেইসবুকসহ এ জাতীয় সামাজিক নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। দুর্বৃত্তদের অপপ্রচারের আগেই যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে রকম কার্যকর ব্যবস্থা থাকা দরকার।’
ফেইসবুককে তথ্য-প্রযুক্তির অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেন তথ্য কমিশনার অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তবে এর অনেক অপব্যবহারও হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বন্ধু হওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত অনুরোধ, সঙ্গে বিভিন্ন বক্তব্য কিংবা বিকৃত ছবি জুড়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। এ জন্য কারো কারো পড়াশোনাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। প্রযুক্তির খারাপ ব্যবহার সামাজিকভাবেই যদি বন্ধ করা না যায়, আমরা সামষ্টিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘প্রথমত আমি ফেইসবুক ও ব্লগ বন্ধের পক্ষে না। কিন্তু আরেকটি বিষয় দেখতে হবে, সেটা হলো, স্বাধীনতার নামে যেভাবে এর অপব্যবহার হচ্ছে, সেটা জঘন্য অবস্থায় পেঁৗছেছে। কাউকে পছন্দ হলো না, তাকে হেয়প্রতিপন্ন করে যা ইচ্ছা তাই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ ‘উলঙ্গ স্বাধীনতা চাই না’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফেইসবুক একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা উচিত। মোস্তাফা জব্বার নিজেও এর অপব্যবহারের শিকার বলে জানান।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি ফেইসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্দেশ্যমূলক, বিকৃত প্রচারণা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বুঝে-শুনে নিয়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো স্পর্শকাতর বিষয় বাধাগ্রস্ত করতেও ফেইসবুক ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নিশ্চয় সরকার সাময়িকভাবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভবিষ্যতে আবার ফেইসবুক চালু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
দেশের বিশিষ্ট আইটি বিশেষজ্ঞ ও বিডিকম অনলাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তে আমি খুবই হতাশ। এটা একেবারেই শিশুসুলভ সিদ্ধান্ত।’
‘আমি খুশি’ : বিএনপির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আ ন হ আখতার হুসেন বলেন, সরকারবিরোধী প্রচারণার হাতিয়ার মনে করার কারণেই সরকার সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ফেইসবুক বন্ধ করেছে। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলে দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করার বিষয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে নেতা-নেত্রীদের নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ নাগরিক অধিকার।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী কয়েক দিন আগে দাবি করেছিলেন ফেইসবুক বন্ধ করে দেওয়ার। গতকাল বন্ধ করার খবর শুনে তিনি বলেন, ‘সরকার একটা ভালো কাজ করেছে। আমি খুশি।’
ফেইসবুক ইতিবৃত্ত : বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেইসবুক ডটকমের প্রতিষ্ঠা ব্যক্তিমালিকানায়, ২০০৪ সালে। ইন্টারসাইট পরিসংখ্যানকারী এলেক্সা ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ফেইসবুক বাংলাদেশে দ্বিতীয় জনপ্রিয় ওয়েবসাইট। সার্চ ইঞ্জিন গুগলের পরেই এর স্থান। অনলাইনে বিনা মূল্যে নিজের প্রোফাইল বানানো, ছবিসহ নিজের মনের কথা প্রকাশ, বন্ধু-বান্ধব তৈরি, চ্যাটিং, প্রিয় ব্যক্তিত্ব বা সাইটের নামে ফ্যান ক্লাব খোলা ইত্যাদি সুবিধার কারণে তরুণসমাজের কাছে এটি খুবই জনপ্রিয়।
ফেইসবেকার্স ডটকমের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ফেইসবুক ব্যবহারকারী প্রায় আট লাখ ৭৬ হাজার ২০ জন। এর মধ্যে প্রায় ছয় লাখ ৪২ হাজার ৯২০ জন পুরুষ ও দুই লাখ ২২ হাজার ৪৪০ জন নারী ব্যবহারকারী। ১ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ২৮ দিনেই দেশে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার।
ফেইসবুকে বিশ্বের প্রধান ভাষাগুলোর পাশাপাশি বাংলায়ও অ্যাকাউন্ট খোলা ও ভাববিনিময় করার সুযোগ আছে। সেখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তসহ বাঙালির গর্ব নানা ব্যক্তির নামে ফ্যান ক্লাব। এমনকি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি তারকার নামে রয়েছে একই রকম ফ্যান ক্লাব। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন তো বটেই; এমনকি অনলাইন একাধিক বাংলা পত্রিকা ও ব্লগের রয়েছে গ্রুপ। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে একাধিক গ্রুপও রয়েছে এ সাইটে। গ্রুপগুলো জনমত গঠনে বিনা মূল্যে তাদের প্রচার চালায় ফেইসবুকে।
তরুণসমাজ ক্ষুব্ধ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শারমিন শানু বলেন, একটি সামাজিক যূথবদ্ধতার নাম ফেইসবুক। কখনো প্রেম, কখনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, কখনো বা সামাজিক কোনো ঘটনাবলির সাবলীল বর্ণনায় মুখর থাকত ফেইসবুক। সরকার কিনা এ মাধ্যমটি বন্ধ করে দিল। অথচ সরকার দেশের মানুষকে ‘ডিজিটাল দেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। সরকার পাকিস্তানের পথ ধরে এগোচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও করেন শানু।
ফেইসবুকে ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর দল’ নামের গ্রুপের অধিকারী ও ব্লগার মাহমুদুল হাসান রুবেল একজন পুরনো ফেইসবুক ব্যবহারকারী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ১২৫ জন গ্রুপ সদস্য ফেইসবুক ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রায় চার লাখ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে। এখন সাইটটি বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।’
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী ওয়াসিফ বলেন, ফেইসবুক বন্ধ করে দেওয়া নতুন প্রজন্ম মেনে নেবে না। ‘আমার এক ব্যাগ রক্ত লাগবে_এ কথাটি ফেইসবুকে জানালে খুব দ্রুত জোগাড় হয়ে যায়’, বলছিলেন দেশের রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের কর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফিরোজ হোসেইন।