মা সন্তানকে খুন করতে সহযোগিতা করে- কথাটা একদম বিশ্বাস করতে পারল না ময়না।

– আহা, কী ফুটফুটে চেহারা রে। বলতে বলতে পত্রিকাটা তোতা মিয়ার দিকে এগিয়ে দিল মন্তাজ উদ্দিন। ময়নারও কৌতুহল হলো তিন বছরের তানহাকে দেখতে। উঁকি দিলো পত্রিকার পাতায়। ইস, ডাগর চোখের কী মায়াবি চাহনি! ফোঁকলা দাঁত। কপালে কাজলের টিপ। মেয়েটাকে আদর করে এ টিপ কে পড়িয়ে দিয়েছিলো? ‘আয় আয় চাঁদ মামা/টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ/টিপ দিয়ে যা…’ ছড়া কাটতে কাটতে মায়েরাইতো এ কাজটি করে থাকে। তানহার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়-ই এর ব্যতিক্রম হয়নি। হয়তো ছড়ার ছন্দে ছন্দে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওকে কাজল কালো করেছিলো মা-ই। তারপর চুমুতে চুমুতে কপাল ভরিয়ে ভনিতা করে বলেছিলো, এইতো আমার চাঁদের (তানহার) কপালে চাঁদ এসে টিপ দিয়ে গেলো। হ্যা, তখন তো মায়ের কাছে চাঁদের মতোই ছিলো তানহা। অমাবশ্যার অন্ধকার দূর করে মায়ের কোল জুড়ে সে এসেছিলো পূর্ণিমার চাঁদ হয়েই। দ্যুতি ছড়িয়েছিলো মায়ের মনে। সত্যিই কি তাই? এমনটিই তো হওয়ার কথা। ময়নার দেখা সব মায়েরাইতো এমন । মায়ের উষ্ণতাই সন্তানের প্রথম আশ্রয়। মাকে ছাড়া একটি দিনও কল্পনা করতে পারে না ময়না। কিন্তু কী এমন ঘটনা ঘটল যে, তিন বছরের ছোট্ট শিশুর মৃত্যু হলো নিজের মায়ের কারণে! অপরাধটা ছিলো কার, শিশুর নাকি ওর মায়ের? অপরাধ যার-ই হোক। কী কারণে একজন মা নিজের কোল থেকে পূর্ণিমার চাঁদ দূরে ঠেলে দিতে চাইবে? কোন অমোঘ টানে? তাহলে কি এখন মায়েরাও বদলে যাচ্ছে। সন্তানরা কি এখন মায়ের কোলেও নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারবে না!

– ও পুতু (চাচা) পুতুগো, তানহা কি মা’রে (মাকে) ত্যক্ত (বিরক্ত) করতঅ?
– নাহ্। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক কথায় জবাব দিলো মন্তাজ উদ্দিন। কিন্তু মন্তাজ চাচার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারটা মোটেই আঁচ করতে পারলো না ময়না।
– তে (তাহলে) ছেরিডা কী দুষ করছিন (করেছিলো) যে একবারে মাইরালান লাগব (মেরে ফেলতে হবে)!
– এই ছেরি চুপ র্ক। মুরুব্বিরার কতার মইদ্যে কতা কওঅন (বলা) বালানা। ধমকে উঠল তোতা মিয়া।
বাবার ধমকে একেবারে চুপসে গেলো সে। আর কথা বলার সাহস হলোনা। তারপরও ক্ষীণ একটি আশা ধরে রেখেছিলো যে, অন্তত: ভদ্রতার জন্য হলেও মন্তাজ চাচা বুঝি তার কৌতুহল নিবৃত্ত করবে। কিন্তু ওদিক থেকেও কোন সাড়া না পেয়ে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো ময়নার। চুপচাপ বসে রইল বাবার পাশে। মনযোগ দিলো অন্য কাজে। ভাব দেখালো যেনো এদিকের কোনো কথাতেই তার কান নেই।
– কী কইবা তোতা মিয়া, খালি পরকিয়া আর খুন না, আমরার দেশটা অহন নানা অপরাধে ভইরা যাইতাছে। ‘সামাজিক মূল্যবোধ’ কইতে (বলতে) একটা কতা আছে। হেই মূল্যবোধ কইম্মা যাইতাছে। কইম্যা যাইতাছে মানুষের নীতি-নৈতিকতা।
– হ, বাইছা (ভাই সাহেব)। তুমি উচিত কতা কইছঅ। আমরার সমাজ কিমুন জানি বদলাইয়া যাইতাছে। সবচে আপন বন্ধনগুলাও অহন ভাইঙ্গা চুরমার অইয়া যাইতাছে।
– বাতাস লাগছে বাতাস। একটা কতা কই হুনঅ, তুমি যুদি কোনো জাতিরে ধ্বংস করতা চাও, পইলা (প্রথমে) হেই জাতির সংস্কৃতি আর মূল্যবোধগুলা ধ্বংস কর। হেরপরে দেখবা আপনা-আপনি হেই জাতি এক অমোঘ নেশায় বুঁদ অইয়া যাইব। মেরুদণ্ড খাড়া কইরা দুইডা কতাও কইতে পারবনা।
– আমরারেও এমুন নেশার বাতাসে পাইছে নাকি?
– লক্ষণ খারাপ। জিরজিরায়া (ঝির ঝির করে) আজইরা (অশুভ) বাতাস ঘিইরা ধরতাছে আমরারে। আমরা ঠ্যাঙ্গের উপরে ঠ্যাঙ্গ তুইল্লা ঝিমাইতাছি। আমরার সরকারের তঅ এইদিকে কোন মনযোগঅই নাই। হেরা অহন ব্যস্ত নানান আজাইরা কামে। আর হেই সুযোগে খুন, রাহাজানি, ডাকাইতি, পরকিয়ায় ভইরা যাইতাছে দেশ। আর মানুষের কাছেও এউগুলা গা সওয়া অইয়া গেছে।
– হঅ, আজাইরা কামে মানুষের টেহা (টাকা) খরচ করতাছে। আমরার চিন্তাভাবনা থেইকা নীতি-টিতি একবারে উইট্টা গেছেগা দেহি!
-নীতিটিতির কতা আর কী কও তুমি! হেদিন পত্রিকার মইদ্যে দেকলাম গত এক মাসে সারা দেশে খুনঅই অইছে ২৮০ জন! অইন্য কতা নাঅয় বাদ অই দিলাম।
– পাবলিক এক্কেবারে ত্যক্ত বিরক্ত অইয়া গেছেগা। হুনলাম আওমী লীগের (আওয়ামী লীগের) এক নেতাও নাকি ত্যক্ত-বিরক্ত অইয়া কইছে যে দেশ বিপদের দিকে আউ¹াইতাছে?
– হ, তুমি ঠিকঅই হুনছঅ। কতা তঅ হাছা। পুরা তাইজ্জব কাণ্ডকারখানা শুরু অইয়া গেছে। প্রধান বিচারপতির মুখ দিয়া পর্যন্ত বাইরঅইছে যে, দেশঅ অহন ন্যায্য কতাডা পর্যন্ত কওনের স্বাধীনতা নাই।
এতক্ষণে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠলো ময়না। ভেবেছিলো কান খাড়া রাখলে হয়তো তানহা হত্যার রহস্য কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারবে সে। কিন্তু বাবা আর মন্তাজ চাচার কথাগুলো এমন দিকে মোড় নিয়েছে, যা ওর বোঝার কথা নয়। কিন্তু তবুও যে বোঝার চেষ্টা করে নি এমনটি নয়। আর চেষ্টা করলে কিছুনা কিছু তো সফল হওয়াই যায়।